সিরাজগঞ্জের দুগ্ধে স্বনির্ভর হতে পারে দেশ
শেখ মনোয়ার হোসেন
প্রকাশিত : ০৬:১২ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ রবিবার | আপডেট: ০৬:২৮ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ রবিবার
'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে' বাঙালি মায়ের এই চিরকালীন আকাঙ্ক্ষা আজো সমানভাবে অর্থবহ। দুধভাত-ই বাঙালির স্বচ্ছলতার প্রতীক। পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু আর ফসল ভরা মাঠ - মূলত: এইসব নিয়েই আবহমান বাংলা ও বাঙালির জীবনধারা। কিন্তু জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ এই প্রাকৃতিক জীবনধারা থেকে অস্তিত্বের কারণেই আমরা অনেকটা দূরে সরে এসেছি।
এখন সবকিছুতেই যুক্ত হয়েছে আধুনিকায়ন। এরপরও দুই একটি ব্যতিক্রম আদি অকৃত্রিম অবস্থায় এখনো বিদ্যমান। তারই একটি সিরাজগঞ্জের চরাঞ্চল কেন্দ্রিক বহু সংখ্যক গো-চারণ ভূমি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত সিরাজগঞ্জ পাবনা শাহজাদপুরের বিস্তীর্ণ মাঠে গো-চারণ এর জন্য নির্দিষ্ট ভূমি সংরক্ষিত ছিল।
শাহজাদপুরের পশ্চিমে বয়ে যাওয়া গোহালা নদীর কোল ঘেষে পোতাজিয়া ইউনিয়নের রাউতবাড়ি, বড়ভিটা, ছোটভিটা, বুড়িরভিটা, কুটিরভিটাতে এবং কাউয়ার্ক এবং হান্ড্রী এলাকায় রয়েছে সুবিশাল গোচারণ ভূমি। সেখানে আছে প্রায় ২৫টি বাথান। প্রতিটি বাথানে ৩ থেকে ৪ হাজার গাভী লালন পালন করা হয়। পৌষ থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস (ছয় মাস) পর্যন্ত গাভীগুলো বাথান এলাকায় অবস্থান করে।
সাধারণত বন্যার পানি গো চারণ ভূমি থেকে নেমে যাওয়ার পর সেখানকার ঘাস খাওয়ার উপযোগী হলেই গবাদিপশু বাথানে নেওয়া হয়। বাথানের অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে বাঁশের ঘেরা দিয়ে গরুগুলো রাখা হয়। তবে বকনা, থারি, ষাঁড় এবং বাছুরগুলোর জন্য রয়েছে আলাদা থাকার ব্যবস্থা। বিস্তীর্ণ গোচারণ ভূমিতে চরে বেড়ানোর পর বিকালে এরা তাদের নির্দিষ্ট থাকার জায়গায় (ঘেরায়) ফিরে আসে। খৈল-ভুসিসহ গো খাদ্য রাখার জন্য এবং রাখালদের থাকার জন্য রয়েছে আলাদা খড়ের তৈরি ঘর। প্রায় ছয় মাস রাখালদের থাকতে হয় এখানে। প্রতি রাখালকে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা বেতন, খাবার এছাড়াও সাপ্তাহিক হাত খরচও দেওয়া হয়।
বাথানের প্রতিটি গাভীর আলাদা আলাদা আলাদা নাম রয়েছে, যেমন- শাবানা, জোসনা, সাধনা, ববিতা, জাহানারা, তৃপ্তি, শাবনুর ইত্যাদি। দুধ দোহনের সময় নাম ধরে ডাকলে, সেই নামের গাভি সাড়া দেয়। আর ‘শাবানার ছাওয়াল’ বললেই বাথানের অন্য প্রান্ত হতে ‘শাবানা’র বাছুরও ছুটে আসে মায়ের দুধ পান করার জন্য। প্রতি লিটার দুধের মূল্য ৪০ থেকে ৪২ টাকা। গাভির বকনা বাছুর ছাড়া অন্য বাছুর বিক্রি করে দেওয়া হয়। বছরে এমন বাছুর বিক্রি করা হয় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার। এলাকার সকল দুগ্ধ খামারি সমিতির সদস্যভুক্ত। প্রতিদিন সকালে বিকালে এরা তাদের সমিতিতে দুধ প্রদান করে।
ওই এলাকায় খামারগুলোতে চরে জন্মানো প্রচুর কাঁচা ঘাস গবাদিপশুর প্রধান খাদ্য। ফলে গরু পালনের খরচ কম। উপরন্তু এসব কাঁচা ঘাস বেশি খাওয়ার জন্য গাভীগুলো দুধও দেয় বেশি। ওইসব এলাকায় চরগুলোর একটির সঙ্গে আরেকটির দূরত্ব ১৫ থেকে ৩৫ কিলোমিটার। এসব চরে বসবাসকারীর সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার বলে জানা যায়।
এখানে প্রায় বাড়িতেই রয়েছে গরুর ছোট ছোট খামার। সকাল ও বিকালবেলা দুই দফা এসব গরুর দুধ দোহন করে সমবায়ের মাধ্যমে বিশেষ ধরনের পাত্রে ভরে শাহাজাদপুর উপজেলা সদরের মিল্ক ভিটাসহ অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করা হয়। দুধের কল্যাণে একসময় অবহেলিত চর এলাকাগুলো হয়ে উঠেছে শিল্পসমৃদ্ধ।
ফলে দুগ্ধ শিল্পে ক্রমেই সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। এ রূপান্তরে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনায় গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড (মিল্ক ভিটা)। দেশের দুগ্ধ উৎপাদনকারী কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশের সমবায়ভিত্তিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সাফল্য তাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
মূলত স্বাধীনতা উত্তরকালে এই বিশাল গো-চারণ ভূমির সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধু আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে দুগ্ধ উৎপাদনের জন্য এই 'মিল্ক ভিটা' প্রতিষ্ঠা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হয় আড়ং ও প্রাণসহ অন্যান্য কর্পোরেট ব্রান্ডিং। সিরাজগঞ্জের চরাঞ্চলের ছোট বড় মাঝারি আকারের খামার এসকল প্রতিষ্ঠানে সরবরাহকৃত দুধের বড় জোগানদার।
১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে মিল্ক ভিটা সিরাজগঞ্জসহ আরও কয়েকটি প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দুধ সংগ্রহ করে গোটা দেশে দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রীর চাহিদা পূরণ করে আসছে। মিল্ক ভিটার সবচেয়ে বড় কারখানাটি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়িতে অবস্থিত। বর্তমানে মিল্ক ভিটার প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ দুধ শাহজাদপুরের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের দুগ্ধ খামার থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। ফলে ওই এলাকা ঘিরে এখন আট হাজার ৪৬৮টি দুগ্ধ খামার গড়ে উঠেছে, যা দেশের অন্য যে কোনো জেলার তুলনায় সর্বোচ্চ। মিল্ক ভিটা দুধ উৎপাদনকারী সমবায়ীর সংখ্যা দুই হাজার ৪০০। এসব সমবায়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন এক লাখ ২৪ হাজার মানুষ, যার অধিকাংশ সিরাজগঞ্জ জেলার।
আর প্রাণিসম্পদ সূত্র থেকে জানা যায়, ওই এলাকা থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রাণ প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার থেকে এক লাখ লিটার, ব্র্যাক ২৫ থেকে ৫০ হাজার লিটার, আকিজ পাঁচ থেকে ১০ হাজার লিটারসহ আড়ং, অ্যামুমিল্ক, আফতাব, বিক্রমপুর ডেইরি ও কোয়ালিটি ডেইরি প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করছে। এসব প্রতিষ্ঠান ওই এলাকায় গড়ে তুলেছে দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কারখানা, সংগ্রহ কেন্দ্রসহ অনেক প্রতিষ্ঠান, যেখানে এলাকার হাজার হাজার মানুষ কাজ করছে। এরপরেও সারাদেশে দুধের ঘাটতি থেকে যায়।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে মাথাপিছু প্রয়োজনীয় দুধের অনেক ঘাটতি রয়েছে। শিশু খাদ্য এবং গুড়া হিসাবে দুগ্ধ ও দুগ্ধ জাতীয় খাবার আমদানির পেছনে প্রতি বছর ব্যয় করতে হয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। দেশীয় সম্পদের সদ্ব্যবহার করে 'আমদানী বিকল্প' উৎপাদনের মাধ্যমে বিদেশ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের স্বনির্ভরতাকে আরো দৃঢ় করা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা।
একটি পরিকল্পিত এবং সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করে সিরাজগঞ্জের চরাঞ্চলসহ উত্তর বঙ্গের ছোট বড় সকল ধরনের গরুর খামারকে একসূত্রে গেঁথে সিরাজগঞ্জকে একটি বৃহৎ 'মিল্ক হাব'-এ পরিণত করা যায়।
এই 'মিল্ক হাব' - এর পাশেই রয়েছে সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন এবং শিল্প পার্ক। যেখানে এই দুধ প্রক্রিয়াজাত হয়ে দেশ বিদেশে সরবরাহ করা হবে। ফলে সুরক্ষিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা। নিশ্চিত হবে জনস্বাস্থ্য। খামারীগণকে আর কখনো কম মূল্য ও ক্রেতাশূন্যতার কারণে ক্ষোভে দুঃখে রাস্তার উপর দুধ ঢেলে দিতে হবে না। পরিকল্পিত সহযোগিতায় দুগ্ধ শিল্প হয়ে ওঠবে দেশের অন্যতম আয়ের উৎস। দেশ হবে সমৃদ্ধ। অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
এসি