স্থূলতা ও ফ্যাটি লিভার: কারণ, প্রতিরোধ ও নিরাময়
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:৪৭ পিএম, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বুধবার
প্রতিটি মানুষের উচ্চতা অনুযায়ী একটি আদর্শ ওজন থাকে। তার তুলনায় দেহের ওজন যখন বেশি থাকে, তখন বলা হয় অতিরিক্ত ওজন (over weight)। আর যখন আদর্শ ওজন থেকে ২০ শতাংশ বা তার বেশি বেড়ে যায় অথবা BMI (Body Mass Index) ৩০ কিংবা এর বেশি হয়, তখন বলা হয় স্থূল।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৩ জনে ২ জন ৬৫ শতাংশ অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতার শিকার এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ৪০ শতাংশ স্থূল। বাংলাদেশে ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ স্থূল এবং ১৪ শতাংশ শিশু অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতার শিকার।
অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতার কারণ
অতিরিক্ত প্রাণিজ আমিষ জাতীয় খাবার গ্রহণ: গরু খাসি ভেড়া ও পাঁঠার মাংস। অতিরিক্ত মুরগির মাংস রোস্ট কাবাবও ওজন বৃদ্ধির কারণ।
> তৈলাক্ত ও চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ: পোলাও, রোস্ট, বিরিয়ানি, কাচ্চি, তেহারি, লুচি, পুরি, সিঙ্গাড়া, পেঁয়াজু, সমুচা, বেগুনি, পরোটা, চপ, কাবাব, কাটলেট ও চিকেন ফ্রাই, ফাস্ট ফুড ইত্যাদি।
> চিনি ও চিনির তৈরি সকল খাবার গ্রহণ: কোমল পানীয়, চিনিযুক্ত চা-কফি ও জুস, কেক পুডিং, পেস্ট্রি, পায়েস, পিঠা, মিষ্টান্ন ইত্যাদি।
> সাদা চাল ও সাদা ময়দার তৈরি খাবার গ্রহণ: ভাত, রুটি, পাউরুটি, নুডল্স, পাস্তা, বার্গার, পেটিস, স্যান্ডউইচ, ইত্যাদি।
> পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের অভাব।
স্থূলতার নেপথ্যে চিনি, সাদা চাল ও সাদা ময়দার ভূমিকা
কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়ার পর হজম শেষে গ্লুকোজ ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে রক্তে প্রবেশ করে। রক্ত থেকে প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ ইনসুলিনের সাহায্যে প্রবেশ করে বিভিন্ন দেহকোষে। এরপর গ্লুকোজ থেকে শক্তি তৈরি হয় এবং শরীর এই শক্তি ব্যবহার করে।
যদি কেউ অতিরিক্ত পরিমাণ শর্করা জাতীয় খাবার খায়, তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্লুকোজ রক্তে প্রবেশ করে। এই অতিরিক্ত গ্লুকোজ লিভার কর্তৃক গ্লাইকোজেনে রূপান্তরিত হয়ে গ্লাইকোজেন স্টোরেজে (লিভার ও পেশি) জমা হতে থাকে। প্রয়োজনের সময় গ্লাইকোজেন দ্রুত গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়ে শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু গ্লাইকোজেনের পরিমাণ যখন এতটাই বেড়ে যায় যে, গ্লাইকোজেন স্টোরেজে আর কোনো ফাঁকা জায়গা থাকে না, তখন লিভার এই অতিরিক্ত গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেনের পরিবর্তে ট্রাইগ্লিসারাইড নামক চর্বিতে রূপান্তরিত করে।
অতিরিক্ত গ্লুকোজ থেকে রূপান্তরিত এই নতুন চর্বি ট্রাইগ্লিসারাইড হচ্ছে স্যাচুরেটেড ফ্যাট, যা বডি ফ্যাট নামেও পরিচিত। এই ট্রাইগ্লিসারাইড বা বডি ফ্যাট লিভার থেকে তৈরি হয়ে জমা হতে থাকে শরীরের নানা অংশে, বিশেষ করে পেটের মধ্যকার নানা অঙ্গে এবং এর চারপাশে। প্রয়োজনের সময় এই ট্রাইগ্লিসারাইড ভেঙে ফ্যাটি এসিডে রূপান্তরিত হয়ে শক্তির জোগান দেয়। এ-ছাড়া অতিরিক্ত প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাবার খেলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অ্যামাইনো এসিডও (আমিষের ক্ষুদ্রতম অংশ) লিভার কর্তৃক ট্রাইগ্লিসারাইডে রূপান্তরিত হয়ে জমা হতে থাকে, যা স্থূলতা, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
ফ্যাটি লিভার
একপর্যায়ে এসে এই রূপান্তরিত চর্বি বা ট্রাইগ্লিসারাইড জমা হতে শুরু করে লিভার বা যকৃতে। লিভারের পাঁচ শতাংশ এই চর্বিতে পূর্ণ হয়ে গেলে সূচনা হয় ফ্যাটি লিভার ডিজিজের। লিভারে চর্বির পরিমাণ বাড়তে থাকলে ফ্যাটি লিভার ডিজিজের মাত্রাও (গ্রেড) বাড়তে থাকে।
আর এ সকল ঘটনার নেপথ্য নায়ক বা অনুঘটক হিসেবে কাজ করে ইনসুলিন। একপর্যায়ে শরীরে দেখা দেয় ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বা ইনসুলিন প্রতিরোধিতা, যার পরিণতি টাইপ-২ ডায়াবেটিস। আর এজন্যেই টাইপ-২ ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রধান কারণ অতিরিক্ত চিনি, সাদা চাল ও সাদা ময়দা এবং এই সকল রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট দিয়ে তৈরি খাবার।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ৩৩ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ প্রতি তিন জনে একজন ফ্যাটি লিভার ডিজিজে আক্রান্ত। আর প্রতি ১০ জনে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
স্থূলতা কমানোর ফলপ্রসূ উপায়
> আপনার উচ্চতা অনুযায়ী আদর্শ ওজন জেনে নিন। এ-ক্ষেত্রে ওজন সারণি বা BMI Standard Chart-এর সাহায্য নিতে পারেন।
> খাবার গ্রহণে সংযত হোন। তৈলাক্ত চর্বিযুক্ত ভাজাপোড়া খাবার বর্জন করুন। বিরিয়ানি-তেহারি-কাচ্চি এবং ফাস্ট ফুড পরিহার করুন। সপ্তাহে অন্তত দুদিন নিরামিষ খান। পর্যাপ্ত শাকসবজি, সালাদ, সবুজ পাতা, ফল ও বাদাম, বীজ, বিন খাওয়া শুরু করুন।
> চিনি ও চিনিযুক্ত খাবার পুরোপুরি বর্জন করুন। সাদা চাল ও সাদা ময়দার পরিবর্তে লাল চাল, লাল আটা ব্যবহার করুন। সকালে ১-২টি লাল আটার রুটি খান, সাথে সবজি ডাল সালাদ ডিম। দুপুরে এক কাপ লাল চালের ভাত, সাথে সবজি ডাল শাক সালাদ মাছ-মাংস।
> হাই গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ফুড (High GI Food) এর পরিবর্তে লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ফুড (Low GI Food) খাওয়ার অভ্যাস করুন।
> সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে নিন। রাতে ভাত-রুটির পরিমাণ খুব কম রাখুন অথবা বন্ধ রাখুন ওজন না কমা পর্যন্ত। শুধু কিছু সবজি ও সালাদ খান। অল্প পরিমাণে মটরশুঁটি খেতে পারেন। এতে পেট ভরে যাওয়ার অনুভূতি হয় যা ওজন কমাতে সাহায্য করবে।
> মিষ্টি ফল আপাতত পরিহার করুন। কম মিষ্টি ও টক জাতীয় ফল যেমন: কমলা, মাল্টা, জাম্বুরা, জাম, আমড়া, আনারস, লেবু, স্ট্রবেরি, পেয়ারা ও সবুজ আপেল খেতে পারেন।
> প্রতিদিন সকালে ও রাতে ৩ চা চামচ অ্যাপল সাইডার ভিনেগার এক গ্লাস পানিতে মিশিয়ে খান। এ ভিনেগার পেট ভরে যাওয়ার অনুভূতি দেয়; ফলে খাবারের চাহিদা কমে। এ-ছাড়াও এটি রক্তের সুগার লেভেল কমিয়ে ওজন কমাতে সাহায্য করে।
> প্রতিদিন ঘণ্টায় ৪ মাইল বেগে একঘণ্টা হাঁটুন। প্রয়োজনে কিছু সময় জগিং করুন। সপ্তাহে দুই-তিন দিন রোজা রাখুন। রোজা বা উপবাস ওজন কমাতে সাহায্য করে।
ওজন কমাতে তাড়াহুড়ো করবেন না। রাতারাতি ওজন কমাতে গিয়ে শরীরের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করবেন না। ওজন কমানোর পুরো প্রক্রিয়াটি উপভোগ করুন।
লেখাটি ডা. মনিরুজ্জামান ও ডা. আতাউর রহমান এর লেখা এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই ‘হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ’ শীর্ষক বই থেকে নেয়া।
এমএম/