ঢাকা, সোমবার   ০২ ডিসেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১৮ ১৪৩১

ক্ষুদ্র হলেও ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ লেবানন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:০৩ এএম, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বৃহস্পতিবার

পৃথিবীর বুকে আয়তনে ক্ষুদ্র একটি দেশ লেবানন। মাত্র ১০ হাজার ৪৫২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি রাষ্ট্র। তবে ক্ষুদ্র হলেও আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় দেশটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে নানা আগ্রাসন, বাইরের হস্তক্ষেপ ও দেড় দশকের গৃহযুদ্ধ সেটাই প্রমাণ করে। 

লেবাননকে বলা হয় ‘মধ্যপ্রাচ্যের ইউরোপ।’ আরব বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর দেশ এটি। ভূমধ্যসাগরের পাড়ে অবস্থিত পশ্চিম এশিয়ার এ দেশটিকে বিশ্বের অন্যতম পুরাতন শহর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেখানকার প্রকৃতি সৌন্দর্যের এক আধার। আবার লেবাননের তরুণ-তরুণীরাও অসম্ভব সৌন্দর্যপ্রেমী। সুন্দরকে তারা নানাভাবে লালন করেন।

বিজ্ঞানসম্মতভাবে তারা মানুষের সৌন্দর্যকে ধরে রাখতে চান। অনেক লেবানিজ মজা করে বলেন, ‘লেবাননের তরুণীরা সকালে ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে যাওয়ার আগেও মেকআপ নেন।’ মূলত তারা সুন্দরের পূজারি এটাই বোঝানো হয়েছে।

লেবাননের রাজধানী বৈরুত। বৈরুতের সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান রাওশি। লেবাননের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শহর বৈরুত, বালবেক ও ত্রিপোলিত।

লেবাননের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হলো- বৈরুতের রফিক হারিরি মসজিদ। এই মসজিদ যেন ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অপূর্ব নিদর্শনও। মসজিদের অদূরে রয়েছে খ্রিস্টানদের গির্জা। দুই ধর্মের অনুসারীরা পাশাপাশি তাদের ধর্ম পালন করছেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লেবাননের দায়িত্ব দেয়া হয় ফ্রান্সের ওপর। ১৯৭৫-৯০ সালের গৃহযুদ্ধের আগ পর্যন্ত দেশটিতে বিরাজ করছিল শান্তি ও সমৃদ্ধশীল অবস্থা। পর্যটন, কৃষি, ব্যাংকিং ইত্যাদি নিয়ে বেশ ভালো সময়ই কাটায় লেবানন। বলা হতো সুইজারল্যান্ডের মতোই পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল লেবাননে। এক সময় আলেকজান্ডার এসে বিধ্বস্ত করে দিয়ে যায় লেবাননকে।

১৯৪৩ সালে লেবানন স্বাধীনতা লাভ করে অন্য রকম এক রাজনৈতিক পদ্ধতিতে, যাকে ‘কনফেসনালিজম’বলা হয়। ধর্মীয় জনসংখ্যানুপাতের ভিত্তিতে আসন বণ্টনের এমন রীতি লেবানন ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও নেই।

লেবাননে সুন্নি মুসলমানের অনুপাত ২৮ শতাংশ, শিয়া ২৮ শতাংশ, ম্যারোনেইট খ্রিস্টান ২২ শতাংশ, গ্রিক অর্থোডক্স ৮ শতাংশ, দ্রুজ ৫ শতাংশ ও গ্রিক ক্যাথলিক রয়েছে ৪ শতাংশ।

দেশটির ৯০%-এরও বেশি লোক আরবি ভাষাতে কথা বলে। লেবাননে মোট ১৮টি ধর্মীয় গোষ্ঠী বিদ্যমান। কিন্তু তাদের মধ্যে নজিরবিহীন সমঝোতা বিদ্যমান। লেবাননের প্রতিটা শহরে বাংলাদেশিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

আগে খ্রিস্টানদের সংখ্যা মুসলমানদের চেয়েও বেশি ছিল। কিন্তু তারা বিভিন্ন দেশে চলে যাওয়ায় তাদের সংখ্যা মুসলমানদের চেয়ে কমে গেছে। লেবাননে দেখা যায়, ধর্মীয় সংস্কৃতির চমৎকার সমঝোতার অনুপম চর্চা। এমন উদাহরণ পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।

কারণ সরকারের সর্বোচ্চ পদগুলো আনুপাতিক হারে ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতাদের জন্য নির্ধারিত। কেননা লেবানন ধর্ম ও গোষ্ঠীগতভাবে বিভক্ত একটি রাষ্ট্র। এখানে খ্রিস্টান, সুন্নি ও শিয়া মুসলমানরা একত্রে বাস করে। গোষ্ঠীগুলো লেবাননের ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যাপারে চুক্তি করে নিয়েছে।

চুক্তি অনুযায়ী লেবাননের রাষ্ট্রপতি হবেন একজন ম্যারোনীয় খ্রিস্টান, প্রধানমন্ত্রী হবেন সুন্নি মুসলমান ও স্পিকার হবেন শিয়া। সংসদের আসনগুলোও অর্ধেক খ্রিস্টান ও অর্ধেক মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত।

লেবাননের বিচারিক ব্যবস্থায়ও বৈচিত্র্যের ছাপ দেখা যায়। এ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে উসমানি আইন, নেপোলিয়ান কোড, গির্জার আইন ও বেসামরিক আইনের সমন্বয়ে। লেবাননের আদালত তিন স্তরের। প্রথমত, প্রারম্ভিক পর্যায়, দ্বিতীয় আপিলের, তৃতীয় পর্যায় হলো- চূড়ান্ত ফয়সালা। সাংবিধানিক আদালত আইন ও নির্বাচনী প্রচারণার বিষয়গুলো দেখে। এ ছাড়া সেখানে ধর্মীয় আদালত আছে। সেখানে সব ধর্মের লোকেরা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় আইন অনুযায়ী বিয়ে ও উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে বিচার পেতে পারে।

তবে বিগত কয়েক বছর ধরে চলমান আর্থিক মন্দা দেশটিকে আধুনিক বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ অর্থনৈতিক পতনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিশেষ করে কভিড-১৯ মহামারী ও ২০২০ সালে দেশটির একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর বৈরুতে বিস্ফোরণ চলমান এ পতনকে তলানিতে এনে ঠেকিয়েছে। বন্দরে থাকা ২ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিস্ফোরণে বন্দরটি একেবারেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। 

এর ফলে ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে দেশটি। এমনিতেই পশ্চিম এশিয়ার এ দেশ (লেবানন) দীর্ঘদিন বিদেশি আগ্রাসন আর গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত। দেড় দশক ধরে অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও রাজনৈতিক চুক্তির আওতায় গণতন্ত্রের মোড়কে গঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা কিছুটা স্থিতিশীলতা পেলেও দেশটির অর্থনীতি ভঙ্গুর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক অব্যবস্থা, দুর্নীতি ও দুঃশাসনে সেখানকার জনগণের ত্রাহি অবস্থা। করোনাকাল শুরুর আগে দেশটির শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে প্রচণ্ড গণবিক্ষোভ হয়। 

করোনা কালে মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়া, বেতন হ্রাস পাওয়া, মুদ্রার মান পড়ে যাওয়ায় অর্ধেক বেতন আবারও অর্ধেক হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনা দেশটির অর্থনীতিকে তলানিতে পৌঁছে দেয়। এর ওপর ছোট্ট এই দেশকে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর চাপও সামলাতে হয়। মাত্র ৬১ লাখ জনসংখ্যা যে দেশে, সে দেশে ১৫ লাখ সিরীয় ও ফিলিস্তিনি শরণার্থী। এমন একটি নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে যখন বৈরুত বিস্ফোরণ ঘটল, তখন সাধারণ লেবানিজদের অসহায় অবস্থার ওজন ঠিক কতটা, তা পরিমাপ করা সত্যিই কঠিন! 
এসএ/