ঢাকা, সোমবার   ০২ ডিসেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১৮ ১৪৩১

কদর নেই শাণওয়ালাদের

সোহাগ আশরাফ

প্রকাশিত : ১২:১৮ পিএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ শুক্রবার | আপডেট: ১২:২৬ পিএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ শুক্রবার

শাণওয়ালা। অনেকে হয়তো তাদের চেনেন, আবার নতুন প্রজন্মের কারো কারো কাছে অপরিচিত মনে হতে পারে। গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায়, মফস্বল শহরগুলোতে দা, বঁটি, পাটা ইত্যাদি ধারালো করতে কাঁধে প্যাডেলচালিত বিশেষ যন্ত্র নিয়ে ঘুরতে থাকা একধরনের পেশার মানুষ তারা।

নব্বই দশকের সময়ে গ্রামে-গঞ্জে ইস্পাতের দা, বঁটি, চাকু, ছুরি ইত্যাদি শাণ দেওয়ার জন্য এই যন্ত্রের বেশ কদর ছিল। সেই সঙ্গে কদর ছিল শাণওয়ালাদেরও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে লোহা ইস্পাতের তৈরি ধারালো অস্ত্র। কারণ, বাজার দখল করেছে চীন, কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিক করা রেডিমেড ছুরি, চাকু, বঁটি। ফলে কদর কমেছে শাণওয়ালাদের। আগের তুলনায় আয়-রোজগারও কমেছে তাদের। অনেক এলাকায় এখন তো আর তাদের দেখাই মেলে না।

শাণওয়ালাদের বিশেষ এ যন্ত্রটির মাধ্যমে ভোঁতা ছুরি, বটি, লোহার যেকোন অস্ত্র (যা দিয়ে কোনকিছু কাটা হয়) ধার দেওয়া হয়। তাদের এই যন্ত্রে থাকে একটি চাকতি। লোহার বস্তুটি চাকতির কার্নিশে ধরতেই আগুনের ফুলকি ছিটিয়ে কিচকিচ শব্দ হয়। চাকতি ঘোরানোর জন্য পা দিয়ে প্যাডেল মারতে হয়। লোহা ও চাকতির ঘর্ষণে ভোঁতা ছুরি চকচকে হয়ে উঠছে। পায়ের প্যাডেল থামিয়ে একটু পরপর হাতের আঙুল দিয়ে চলে ধার পরীক্ষার কাজ।

কয়েক দশক ধরেই এভাবে দা-বঁটি-চাকু-ছুরিতে ধার দেন শাণওয়ালারা। তাদের বেশিরভাগই ভ্রাম্যমান (অনেক স্থানে দোকানেও এই যন্ত্রটি দিয়ে ধার দেওয়া হয়)। জীবিকার তাগিদে শহর থেকে শহরে, মহল্লা থেকে মহল্লায় ঘুরে বেড়ান তারা। ছোট একটি কাঠের কাঠামোর গায়ে বিশেষভাবে চাকা, প্যাডেল আর চাকতি লাগানো ‘শাণ মেশিন’ কাঁধে নেয় ঘুরে বেড়ান পথে পথে।

আগে শাণওয়ালারা মুখে ডাক দিয়ে জানান দিতো। ‘এই শাণ দিবেন শাণ, দা-বটি-ছুরি-কাচিতে ধার, ইত্যাদি। কিন্তু তাদের সেই কষ্টটি এখন সহজ হয়ে গেছে। বিশেষ করে শহরের উঁচু উঁচু ভবনের উপরের তলার মানুষরা তাদের কন্ঠ শুনতে পারেন না। তাই পিঠের ছোট ব্যাগে রাখা হ্যান্ডমাইক দিয়েই ডাক দেন শাণ দিতে।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাজারো মানুষ দা-বঁটিতে ধার দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে এ কাজ করতেন তারা। কাঁধে শাণ মেশিন নিয়ে জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়াতেন শাণওয়ালারা। কোনো জায়গায় আস্তানা গাড়লে এক থেকে তিন মাস সেখানে থাকতেন। এরপর বাড়িতে ফিরে কয়েক দিন থাকার পর অন্য জায়গায় যেতেন। প্রতিদিন সকালে শাণ মেশিন কাঁধে নিয়ে দিনভর কাজ করে বিকেলে ফেরেন বোর্ডিংয়ে। দিন শেষে দু’শ থেকে তিনশ’ টাকা আয় হয়।

বর্তমানে যাতায়াতের খরচের পাশাপাশি জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। শাণ কারিগরদের রোজগারের বড় একটি অংশ খরচ হয়ে যায় থাকা-খাওয়া ও যাতায়াতে। আগে বোর্ডিং ভাড়া কম ছিল, এখন অনেক বেড়ে গেছে। খাওয়ার খরচও বাড়ছে অনেক। তাছাড়া মানুষের চাহিদাও অনেক কম। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে শাণওয়ালারা।

শাণওয়ালারা শুধু যে দা-বটি ধার করেন তা নয়, তারা শীল পাটাও ধার করেন। তবে আধুনিক প্রযুক্তির ছোয়ায় শহরের গৃহিণীরা এখন মসলা বাটার জন্য শীল- পাটার ব্যবহার করেন কদাচিৎ। সকল গৃহিণী বাজারে কিনতে পাওয়া পাউডার মসলা বিশেষ করে মরিচ, জিরা, হলুদ, ধনে গুড়ো রান্নার কাজে ব্যবহার করেন। আদা, রসুন, পেয়াজ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্লেন্ডারে বেটে নেন। যে কারণে শীল-পাটার ব্যবহার শহরে এখন অধিকাংশ গৃহিণী করেন না বললেই চলে। তবে ব্লেন্ডারের তুলনায় পাটায় বাটা মসলা রান্নাকে বেশি সুস্বাদু করে।

তাই এখনও অনেক গৃহিণীর তাদের পাটায় ধার করানোর প্রয়োজন পড়ে। বিশেষ করে ঈদ মৌসুমে। এ সময় পুরনো বটি, ছুরি, দা-য়ে ধার দেন সবাই। তাই শাণওয়ালাদের কদর বেড়ে যায় তখন। পুরো বছর এই পেশার মানুষগুলোও এই সময়ের অপেক্ষায় থাকেন।

এসএ/