দুঃখ বিলাস কেন?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০২:৩৭ পিএম, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ শনিবার | আপডেট: ০৩:৪৭ পিএম, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ শনিবার
‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি, তাই তোমার কাছে ছুটে আসি’- এটি একটি জনপ্রিয় গানের কথা। আমরা সবসময় এরকম কমবেশি কষ্ট নিয়েই দিনাতিপাত করছি। কেউ অসুস্থতার কষ্ট, কারো অপ্রাপ্তির কষ্ট, কারো একটা ফ্ল্যাট কেনার কষ্ট আবার কারো বাড়ি কেনার কষ্ট। এই কষ্ট বিলাস আমাদের সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এই অপ্রাপ্তি বা কষ্টের কারণে আমরা মহান স্রষ্টার যে অবারিত দান, অবারিত সম্পদ, সুস্থ শরীর-জীবন দিয়েছেন, তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানানোর সময়ও পাচ্ছি না। আমরা যদি দেখি যেসকল মহামানবেরা অমর হয়ে আছেন,সম্পদ দিয়ে নয়, সেবা দিয়ে; ধর্মীয় গুরু থেকে দার্শনিক বা বিজ্ঞানী সবাই।
দুঃখকে দূর করতে হলে আগে নিজের লক্ষ্যে বা কাজে একাত্ম থাকতে হবে। বর্তমানের কাজ বা লেখাপড়া যদি ভালো না হয়, ভবিষ্যৎও কষ্টের হবে। এ জন্য সফলজন বা দার্শনিকরা বলেন, আগে লক্ষ্য ঠিক করতে হবে এবং সেটা বাস্তবায়নের ইতিবাচক দৃষ্টি নিয়ে আগানোর পাশাপাশি ভালো কাজ, দান করা, প্রার্থনা করা, ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
বুদ্ধ বাণীতে আছে, একবার একজন লোক গৌতম বুদ্ধের কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমি গরীব কেন?’
বুদ্ধ বললেন, ‘তুমি দান কর না।’
ওই লোক বললেন, ‘আমার তো শুধু অভাব, আমি কী দান করব?’
বুদ্ধ বললেন, ‘তোমার হাসি সুন্দর, সেটা দান কর।’
তিরমিযী শরীফে আবু যর গিফারী (রা.) এর বর্ণনায় এক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘নবী করীম (সা:) বলেন, প্রতিটি সৎকর্মই সাদাকা বা দান। হাসিমুখে কথা বলা সাদাকা।ভালো কাজে উৎসাহিত করা সাদাকা। খারাপ কাজ থেকে কাউকে বিরত রাখতে সচেষ্ট হওয়া সাদাকা। পথহারা মানুষকে পথ দেখানো সাদাকা। অসুস্থকে দেখতে যাওয়া সাদাকা। কাউকে পানি ঢেলে খাওয়ানোও সাদাকা।’’
হযরত মোহাম্মদ (সা:) মক্কা বিজয়ের পরও কোনও সিংহাসনে আরোহন করেননি। মসজিদে বসেই সবকিছু করেছেন।
গৌতম বুদ্ধতো রাজসিংহাসন ছেড়ে মানুষের সেবা করার জন্য রাস্তায় নেমে এসেছিলেন।
বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংসের শরীর চলে না কিন্তু মন চলে, তিনি যদি তার কি নেই তা নিয়েই বসে থাকতেন তাহলে তার আর এত আবিষ্কার করা সম্ভব হতো না। সুতরাং কি নেই সেই দিকে ফোকাস না করে কি আছে এদিকে ফোকাস করতে হবে। মা যেমন সন্তানকে চিন্তা করে সংসারের সব হজম করে নেয়, তেমনি লক্ষ্যের পানে চাইতে হবে। দুঃখ কষ্টকে আধ্যাত্মিক শক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। আপনাকে কেউ দুঃখ দিলে, আপনি কিছু মনে না করলে আপনার আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটবে । সুতরাং এভাবে ভাবতে হবে যে কেউ আমার সাথে খারাপ আচরণ করলে আমি কেন দুঃখ পাবো? তাহলে তো তার হাতে আমার নিয়ন্ত্রণ চলে গেল।
দুঃখ দুর্দশার আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে অলস সময় কাটানো। এজন্যে অলস সময় না কাটিয়ে কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। ধনীর দুলালেরা আজকাল মোবাইল না পেলে সুইসাইড করে। অলস সময় কাটানোর দরুন তাদের ইমিউন সিস্টেম এত দুর্বল হয়ে পড়ে, তাদের মেন্টাল ফিটনেস এত দুর্বল হয়ে পড়ে যে তারা আত্মহত্যা করতে পর্যন্ত দ্বিধাবোধ করে না।
তাই মনে করতে হবে জীবনে আঘাত, কষ্ট, দুর্ভোগের চেয়েও নিজে অনেক শক্তিশালী। প্রতিটি বাঁধাকে অতিক্রম করতে হবে।
আপনার যা আছে, তাতে ফোকাস না করে অন্যের চিন্তায় প্রভাবিত হয়ে কী নেই সেই চিন্তায় মগ্ন থাকাকেই হীনমন্যতা বলে। স্রষ্টা আপনাকে যেভাবে বানিয়েছেন, তাতে আপনি অসন্তুষ্ট হলেই আপনার মাঝে হীনমন্যতা জন্মে। অন্যের তুলনা করে নিজের স্বাভাবিক অবস্থাকে মেনে নিতে না পারার ফলেই হীনমন্যতা সৃষ্টি হয়। হীনমন্যতা মানুষের বিবেক ধ্বংস করে, ঝগড়া বিবাদ কলহ সৃষ্টিকারী, পাশের ফ্ল্যাটের সনি টিভি কিন্তু আমার ঘরে স্যামসাং টিভি এইরকম মনোভাবের ফলে হীনমন্যতার সৃষ্টি হয়। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি এবং অসুস্থ প্রতিযোগিতাও বটে।
কাজেই আপনার চেয়েও খারাপ অবস্থায় যারা আছে তাদের দিকে তাকাতে হবে, তাদের থেকে আপনি ভালো আছেন, এভাবে ভাবতে হবে। কারো অনেক ধন আছে কিন্তু সুস্থতা নেই, সুখ নেই। আবার কারো অল্প ধন আছে, কিন্তু সে পরম সুখী।
নাসিরুদ্দিন হোজ্জার কাছে এক লোক পেট ব্যথার অসুস্থতা নিয়ে গেল। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কি খেয়েছিলে? সে জবাব দিলো, আমি দশটা পিঠা খেয়েছিলাম। নাসির উদ্দিন হোজ্জা তার চোখে ঔষধ লাগিয়ে দিল। রোগী বলল তার সমস্যা তো পেটে, তাকে চোখে ঔষধ লাগানো হলো কেন? জবাবে হোজ্জা বলল, চোখের খিদে বলেই দশটা পিঠা খেয়েছো, আর ব্যথা হয়েছে।
কাজেই চোখের ক্ষুধা নয়, পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য খেতে হবে।
শুধু নামাজ পড়াই ইবাদত নয়, পেটুক মানসিকতা পরিহার করাও একটি ইবাদত। ভুল খাদ্যাভ্যাসের কারণে সাধারণত রোগ হয়। পবিত্র কোরআনের সূরা আল রুমের ৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
‘হে মানুষ তোমাদের কর্মের প্রতিক্রিয়াতেই জলে স্থলে বিপর্যয় ও বালা মুসিবত ছড়িয়ে পড়ে। তিনি তখন তোমাদের কৃতকর্মের ফল কিছুটা আস্বাদনের সুযোগ দেন, যাতে করে তোমরা শিক্ষা পেয়ে সত্য পথে ফিরে আসতে পারো।’
যা নেই সেদিকে না দেখে যা আছে তা প্রকাশ করাই শুকরিয়া। নিজের যে অভাব তার আক্ষেপ প্রকাশ না করে বিপরীতটা করাই শুকরিয়া। সাফল্যের পথে প্রথম পদক্ষেপে শুকরিয়া। আগে নিজের ভেতর শুকরিয়া আনতে হবে, আক্ষেপ মুক্ত অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে, তারপর স্রষ্টার কাছে চাইতে হবে। নিজের আমিত্ব থেকে বের হয়ে স্রষ্টার মহাশক্তির বলয়ে চলে আসাতেই শুকরিয়া। যার ভিতরে শুকরিয়া নেই, তার ভিতরেই অস্থিরতা বিরাজ করে। জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাওয়াগুলোকে স্বীকার করা, সম্মান করার মধ্যেই শুকরিয়া লুকিয়ে থাকে। আমরা সাধারণ চোখে এক ব্যাগ রক্ত দান করতে দেখি। কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে এটি অনেক মহান কাজ।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘একজন মানুষের জীবন রক্ষা করা,সমগ্র মানবজাতির জীবন রক্ষা করার সমান।’
আপনার দৃষ্টিতে এক ব্যাগ রক্ত দান অতি স্বাভাবিক ও ক্ষুদ্র মনে হতে পারে কিন্তু এক ব্যাগ রক্ত ও তার উপাদানকে লোহিত রক্ত কণিকা, ফ্রজেন প্লাজমা, প্লেটিলেট ও হোমোগ্লোবিন আলাদা করলে এটি প্রকৃত পক্ষে চার জনের জীবন বাঁচাতে সক্ষম। কাজেই ক্ষুদ্র বিষয়গুলোর অন্তর্নিহিত বিষয়ে লুকিয়ে থাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই প্রতিটি বিষয় যা আপনি তুচ্ছজ্ঞান করছেন শুকরিয়ার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে মূল্যায়ন করতে শিখতে হবে।
শুকরিয়া না থাকলে স্রষ্টা কিভাবে আপনাকে দিবেন? যার ভেতর শুকরিয়া নেই, তার অনেক ইবাদতও অর্থহীন। স্রষ্টা আমাদের কাছে কিছুই চান না; চান শুধুই কৃতজ্ঞতা। শয়তানের সাথে স্রষ্টার চ্যালেঞ্জ হয়েছে যে, শয়তান মানুষকে না শুকরিয়া করে দিবে। শয়তান মানুষকে এমনভাবে ঘিরে ধরবে যে তুমি (স্রষ্টা) তাকে শুকরিয়া করতে পাবা না। না শুকরিয়া শয়তানের প্রকাশ্য রূপ আপনি হৃদয় থেকে তৃপ্ত কিনা এটা জরুরী।
দুই কোটি টাকা দিলেই আপনি আপনার পা কাটতে দিবেন না। আমাদেরকে কৃতজ্ঞ হতে হবে যে স্রষ্টা আমাদেরকে এত মূল্যবান অঙ্গ দিয়েছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে আমরা আক্ষেপ করি। আপনাকে অনেক সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে যদি শুধু শ্বাস প্রশ্বাস দুই মিনিট বন্ধ করতে বলা হয়, আপনি তাতে রাজি হবেন না। তাই রাগ ক্ষোভ অভিমান ঈর্ষা ভুলে যেতে হবে।
কাজকে ভালোবেসে কাজ করলে টাকা আসতে দেরি হলেও সেই টাকা দীর্ঘস্থায়ী হয়। টাকা পাওয়ার জন্য কাজ করলে বিপরীত হয়, টাকা সাথে সাথেই আসে।
ভালো কাজে অনুপ্রাণিত হতে সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে। সন্ত্রাসী, কারসাজি, মজুদদারি, দুর্নীতি, পোর্টে মাল আটকে রাখা, এসবই সংঘের দ্বারা হয়। এরা যদি সঙ্ঘবদ্ধ হতে পারে, আমরা কেন ভালো কাজের জন্য সংঘবদ্ধ হতে পারব না?
এমএম/এএইচএস