ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৭ ১৪৩১

স্মরণে সাতাশি’র বই মেলা

মোহাম্মদ মাসুদ খান

প্রকাশিত : ০৯:৫৮ পিএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সোমবার | আপডেট: ১০:১৭ পিএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সোমবার

সামাজিক মাধ্যম স্ক্রল করতে করতে দৃষ্টি আটকে গেলো একটি ছবিতে। ছবিটি ৩৬ বছর আগের ১৯৮৭ সালের বাংলা একাডেমী আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থ মেলার ছবি।

কেমন ছিলো সেই সময়কার বই মেলা?

মেলার পরিধিই বা কতটুকু?

পরিবেশ কেমন ছিলো?

এই প্রজন্ম তিন যুগ আগের বই মেলা নিয়ে ভাবে কি না তা আমার জানা নেই। ১৯৮৭ সালে আমি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থী। টগ বগে সমাজ সচেতন একজন তরুণ। সে বছর বই মেলায় তাই আমি গিয়েছিলাম একাধিকবার।

নবীন-প্রবীণ, নতুন-পুরাতন, অখ্যাত বিখ্যাত প্রতিষ্ঠিত অনেকেই সে মেলায় আসতেন। কবি, লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের পদভারে মেলা ছিলো মুখর। কেবল এরশাদ বলয়ের কোন ব্যাক্তি মেলায় আসার সাহস পেতেন না।

এম আর আখতার মুকুল, আলী ইমাম, ফয়েজ আহমেদ, উমর খৈয়াম, কবি নির্মলন্দুগুন, মহাদেব সাহা প্রমুখদের আগমনে মেলা হয়ে উঠতো প্রাণবন্ত।

মেলায় আগত দর্শনার্থী ও পাঠকদের অটোগ্রাফ দিতেন হাসি মুখে। তখন কেবল বাংলা একাডেমী ও পুকুর পাড় জুড়েই ছিলো বই মেলার বিস্তৃতি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বট তলার মঞ্চে অনুষ্ঠিত হতো মুক্ত আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ।

একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই প্রাণের মেলা জমে উঠতো। সকাল বেলা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘুরে জনতার স্রোত বই মেলায় গিয়ে মিশতো। 

সেদিন আমিও শাপলা শালুকের আসরের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পণ করে বই মেলার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। মেলায় যখন পৌঁছাই তখন সকাল নয়টা পার হয়ে গেছে। বাংলা একাডেমী ভবনের দক্ষিণ দিকে বটতলা’র অদূরে স্থাপিত মঞ্চে চলছে স্বরচিত কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানস্থল দর্শকে পরিপূর্ণ। ঢাকা ও ঢাকার বাহিরের বহু কবি এসেছেন মঞ্চে তাদের স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে। তাদের সাথে আমিও শামিল হলাম।

এতো কবির ভীড়ে আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষ ঐ মঞ্চে কবিতা পাঠ করার সুযোগ না পাবারই কথা। তবুও সবার সাথে মঞ্চে বসে আছি যদি ডাক পাই এই আশায়। কবি খালেদা এদিব চৌধুরীসহ অনেকেই বসে আছেন। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ক্রমিক অনুযায়ী উপস্থিত কবিদের মঞ্চে আহ্বান করছেন। আর কবিরা কানায় কানায় পূর্ণ দর্শকদের সামনে স্বরচিত কবিতা বা ছড়া পাঠ করে অপার আনন্দে মঞ্চ ত্যাগ করছেন। আর একা আমি অপেক্ষা করছি কখন আমার পালা আসবে।

কিছুক্ষণ পর বেলা দশটার দিকে দেখলাম ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন ও সাংবাদিক কবি আবু সালেহ’র নেতৃত্বে একটি দল মঞ্চে। দলে তাদের মধ্যে পাড়া ও স্কুলের বড় ভাই ওয়াসিফ-এ-খোদা কে দেখে আনন্দিত হলাম। আরো এসেছেন কবি আসলাম সানী, আমিরুল ইসলাম, মোহন রায়হান, আনজীর লিটন প্রমুখ।

এই গ্রুপটি অনুষ্ঠান স্থলে আসার পর পুরো পরিবেশ পাল্টে গেলো। লুৎফর রহমান রিটন ও আসলাম সানী’র পক্ষ থেকে সঞ্চালকের হাতে একটি তালিকা দেওয়া হলো। সেই তালিকায় ওয়সিফ-এ-খোদা ভাই আমার নামটিও জুড়ে দিলেন। মঞ্চে পাঠ করার জন্য আমি দুটি ছড়া জমা দিয়েছিলাম তবে উপস্থাপক আমাকে একটি ছড়া পাঠ করতে বললেন। আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না।

দশ মিনিটের মধ্যেই সঞ্চালক ঘোষণা করলেন, ‘এবার স্বরচিত ছড়া পাঠ করবেন তরুণ ছড়াকার মোহাম্মদ মাসুদ খান। ঘোষণা শুনে কিছুটা দুরু দুরু বুকে আর উত্তেজনার মধ্যে মঞ্চের ডান দিকে ডায়াসের দিকে এগিয়ে গেলাম। সামনে সহস্র দর্শক শোতা। এতো দর্শকের মাঝে চোখ বন্ধ করে নিজের লেখা ছড়া পাঠ শুরু করলাম।

‘এদেশের রাজা ভাই
লিখেন ছড়া কবিতা,
হোক বা না হোক
ছাপা হবে সবি’তা।

এদেশের রাজা ভাই
করেন নিজের বড়াই,
আরো তিনি বলেন
কাউকে আমি ডারাই?’

ছড়াটি পড়ার পর দর্শক সারি থেকে মুহুর্মুহু করতালি আর ওয়ান মোর ওয়ান মোর ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম। দর্শকদের এমন রেসপন্স দেখে আমি হতবাক। সময় স্বল্পতার কারণে তাদের অনুরোধের ২য় ছড়াটি পাঠ করা সম্ভব হয়নি। অগত্যা চুপ করে কবি ছড়াকারদের মাঝে আবার বসে পড়লাম।

এক পর্যায়ে ডাক এলো বিখ্যাত সাংবাদিক, কবি ও ছড়াকার আবু সালেহ’র। 

তিনি সেদিন পাঠ করলেন

“কেউ বলে খালেদা কেউ বলে হাসিনা
দুই ভাগে ভাগ হওয়া মোটেও ভালো বাসিনা।
কেউ বলে সাত দল কেউ বলে পনের
তার সাথে ভাগ হয় জনতার মনের।

এক হতে দোষ কি
দু’জনের রোষ কি
এ কথা ভালো না
এক দ্বীপ জ্বালো না।

আবু সালেহ’র স্বরচিত ছড়াটিও উপস্থিত দর্শকগন তুমুল করতালি দিয়ে তাদের অনুভুতি প্রকাশ করেন। বিখ্যাত ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন ও চমৎকার একটি ছড়া পাঠ করে শোনান, যা দর্শকরা দারুণ উপভোগ করেন।

তার ছড়াটি পুরোপুরি মনে নেই, যতটুকু স্মরণে আছে তা ছিলো এমন

শালী খায় বালী খায়
রওশন মেরী খায়……।

তার পরের বছর ১৯৮৮ সালেও বই মেলায় স্বরচিত কবিতা পাঠের আসরে যোগ দিয়েছিলাম। সামরিক শাসক জেনারেল এরাশাদ বিরোধী মতের মহা মিলন মেলা ছিলো আশি দশকের একুশে বই মেলা।

২০১৪ সাল থেকে বই মেলার পরিধি বাংলা একাডেমী চত্বর ছাড়িয়ে সড়কের পূর্ব পাশের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিস্তৃত হয়েছে। স্টল সংখ্যা হয়তো দুইশ থেকে দুই হাজার হয়েছে। মেলার পরিধি বেড়েছে অনেক। পরিবেশে এসেছে ভিন্নতা। তাবে আশির দশকের শেষ ভাগের মেলার পরিবেশ ও আবেগ এখন মিস করি।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, শেরেবাংলা নগর গভঃ বয়েজ স্কুল অ্যালামনাই এসোসিয়েশন।

এসি/কেআই