জাবির নতুন হলে ছাত্রলীগের রুম দখল, জানেন না প্রভোস্ট
জাবি প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ১০:০০ এএম, ৯ মার্চ ২০২৩ বৃহস্পতিবার
সিট সংকট নিরসনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণাধীন ৬টি দশতলা হলের মধ্যে সম্প্রতি চালু হয়েছে দুটি। হল চালু করার সময় ক্ষমতাসীন সরকারের ছাত্র সংগঠনের বিশেষায়িত কোন ব্লক থাকবে না বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে ঘটেছে তার উল্টোটা। হলের ৪র্থ ও ৫ম তলায় তৈরি হয়েছে বিশেষায়িত ছাত্রলীগ ব্লক।
১৮নং ছাত্রী হলের সবগুলো রুম বরাদ্দ দেওয়া হলেও ২১নং ছাত্র হলের দুইশ’ সিট বরাদ্দ দেয়নি প্রশাসন। এই হলের ৪র্থ তলার পুরোটা ও ৫ম তলার দশটি রুম বাদে কোন রুমে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এই দুই তলাতেই তৈরি করা হয়েছে ছাত্রলীগের ব্লক।
জানা যায়, ৪র্থ তলায় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির অনুসারীরা এবং ৫ম তলায় সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা অবস্থান করছেন। মাঝের ব্লকে (৪১১-৪২০, ৫১১-৫২০) থাকছেন মাস্টার্স ও অনার্স ফাইনাল ইয়ারের (৪৬ ও ৪৭ ব্যাচ) সিনিয়র নেতারা।
বাকি রুমগুলোতে থাকছেন জুনিয়ররা (৪৮, ৪৯, ৫০ ব্যাচ)।
সরেজমিনে ৬ মার্চ মঙ্গলবার নতুন হলের পরিস্থিতি ঘুরে দেখতে গেলে লিফট থেকে ৪র্থ তলার একাধিক রুমের দরজায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিভিন্ন পোস্টার সাটানো দেখতে পাওয়া যায়। অধিকাংশ সিনিয়রদের রুমে দুটি খাট একত্র করে একটি খাট বানিয়ে থাকতে দেখা যায়। ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ৪ জনের রুমে দুজন থাকছেন এবং ৪৬ ব্যাচের কয়েকজন একাই থাকছেন ৪ জনের রুমে, জানান কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী।
৪র্থ ও ৫ম তলায় রুম বরাদ্দ দেওয়া না হলেও তারা কিভাবে থাকছেন জানতে চাইলে অনেকেই প্রশ্ন এড়িয়ে যান। কেউ বলেন রুম বরাদ্দ আছে ভিন্ন তলায় তিনি শাফল করে থাকছেন। আবার কেউ বলেন রুম বরাদ্দ নেই তবে তাদের নাম লিস্ট করে পাঠানো হয়েছে হল প্রশাসনের কাছে এবং শীঘ্রই নতুন লিস্টে নাম আসবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নতুন হলের ছাত্রলীগের ব্লকে যারা উঠেছেন এদের মধ্যে অধিকাংশেরই রুম বরাদ্দ নেই। ৪৬ ব্যাচ থেকে শুরু করে ৫০ ব্যাচ পর্যন্ত যে সকল ছাত্র নতুন হলে ছাত্রলীগ করতে ইচ্ছুক কিন্তু সিট বরাদ্দ পাননি তাদের নাম লিস্ট করে পাঠানো হয়েছে প্রশাসনের নিকট এবং এই সকল নামে সিট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে অবশিষ্ট ২০০ সিট থেকে।
২২নং হলে ছাত্রলীগের সভাপতির অংশ থেকে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে আছেন জোবায়েদ আশিক (পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ, ৪৬ ব্যাচ), জোবায়ের মাহমুদ আদিত্য (নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ৪৬ ব্যাচ), মোহাইমেনুল ইসলাম (ইতিহাস বিভাগ, ৪৬ ব্যাচ) ও মোহাম্মদ কাশেম রেজা (ইতিহাস বিভাগ, ৪৬ ব্যাচ) প্রমুখ।
সাধারণ সম্পাদকের অংশ থেকে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে আছেন শেখ নাহিয়ান রাজু (প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, ৪৬ ব্যাচ)। এছাড়াও রফিক জব্বার হল থেকে সাময়িক বহিষ্কৃত মোস্তফা ফয়সাল রাফি (অর্থনীতি বিভাগ, ৪৭ ব্যাচ) ও অলোক পালও (বাংলা বিভাগ, ৪৭ ব্যাচ) আছেন সাধারণ সম্পাদকের অংশে।
এর মধ্যে আশিক ও রাজু যথাক্রমে ৪১৬ ও ৫১৬নং রুমে থাকছেন। তবে তাদের কারোরই রুম বরাদ্দ নেই নতুন হলে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উভয়েই বলেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর আবেদন করেছেন এবং যদি রুম বরাদ্দ না পান তবে তাদের পূর্বের হলে চলে যাবেন।
৪র্থ ও ৫ম তলায় কোন ছাত্রকে সিট বরাদ্দ না দেয়ার পরেও ছাত্রলীগ কর্মীদের অবস্থানের কারণ জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, ‘এরকম তো হওয়ার কথা না! আমি জানি না এরকম কিছু। নতুন করে যাচাই বাছাই করে প্রশাসন কিছু অ্যালট দিবে শুনেছি। যদি অ্যালট ছাড়া কেউ থেকে থাকে, তবে সেটা অন্যায়। আমি প্রভোস্টের সঙ্গে কথা বলে দেখবো।’
তবে জোবায়েদ আশিক বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার জন্য নেতৃবৃন্দ কাজ করে যাচ্ছে। নতুন যে হলগুলো হচ্ছে সেখানে সামনের নির্বাচনকে ঘিরে ভিন্ন মতাদর্শী লোকজনের উঠার সম্ভাবনা বেশি। আমাদের এই ক্যাম্পাস মৌলবাদের প্রশ্রয় দেয় না, জামাত-শিবিরকে প্রশ্রয় দেয় না। সেই ক্ষেত্রে একটা চক্র হয়তো নতুন হলে উঠে সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তারা যেন নতুন হলে এ ধরনের কিছু না করতে পারে, সংঘবদ্ধ না হতে পারে তাদের প্রতিহত করার জন্য ছাত্রলীগ সংঘবদ্ধ হয়ে থাকবে। তাদের প্রতিহত করার জন্যেই মূলত আমরা একসঙ্গে থাকছি।’
শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন বলেন, ‘অ্যালট হয়ে গেছে অলরেডি। আমার জানা মতে অ্যালটের জন্য আবেদন করে ফেলেছে তারা। যারা ছাত্রলীগের ওখানে আছে তারা অ্যালট নিয়েই উঠছে। ছাত্রলীগ কর্মীরা একসঙ্গে থাকছে এই বিষয়টা তো ঠিক না, এই তথ্যটা ভুল।’
তবে সহ-সম্পাদক শেখ নাহিয়ান রাজু বলেন,‘যেহেতু ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের একটা রানিং কমিটি আছে, দায়িত্বরত নেতৃবৃন্দ আছেন। সেখানে আমাদেরও একটা দায়িত্ব আছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে কোনো বিশেষ গোষ্ঠী যাতে ক্যাম্পাসে বা নতুন হলে অরাজকতা সৃষ্টি না করতে পারে সেজন্যেই নতুন হলে আমাদের একসঙ্গে থাকা।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রলীগ কর্মী বলেন,‘প্রেসিডেন্ট পোর্শনের বেশিরভাগ এসেছে আল বেরুনী হল থেকে। অনেকে নতুন হলে পদ নেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে পোস্ট পর্যন্ত নেয়নি। নতুন হলগুলোতে কোন কোন হল থেকে কারা কারা যাবে এটা অলরেডি ঠিক করা হয়েছে।’
শিক্ষার্থীদের ৪র্থ ও ৫ম তলায় থাকার বিষয়ে ‘অবগত নন’ বলে জানান পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও হল প্রভোস্ট ড. তাজউদ্দিন শিকদার। তিনি বলেন, ‘ওখানে তো ওদের থাকার থাকার কথা না, আমি তো কাউকে অ্যালটমেন্ট দেইনি ৪-৫ তলায়। ফাঁকা সিটগুলোতে অ্যালট দেওয়া হচ্ছে, তবে বিষয়টা প্রক্রিয়াধীন।’
হল প্রভোস্ট তাজউদ্দিন শিকদার ‘অবগত নন’ বলে জানালেও হল চালু হওয়ার দ্বিতীয় দিনেই পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের ৪৮, ৪৯ ও ৫০ তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ৪র্থ তলায় রুম দখল করে থাকা শুরু করেন। এ বিষয়ে তৎকালীন সময়ে প্রভোস্টকে জানানো হলেও সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় তারা বর্তমানেও সেখানেই থাকছেন।
এ বিষয়ে তাজউদ্দিন শিকদার বলেন, ‘সাংবাদিকদের তথ্যের ভিত্তিতে আমি আমার হাউজ টিউটরদের নিয়ে গিয়েছিলাম ৪-৫ তলায় এবং তখন কাউকে পাইনি।’
এই সিটগুলো প্রশাসন ছাত্রলীগকে পরোক্ষভাবে দিয়ে দিচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এভাবে সিট বরাদ্দ দেয়ার কোন সুযোগ নেই। প্রশাসন থেকে দুইশ’ জনের লিস্ট দেয়া হয়েছে আমি সেটা রেজিস্ট্রারে ফরোয়ার্ড করেছি।’
কোন ক্রাইটেরিয়ায় এই সিটগুলো বরাদ্দ দেয়া হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এটা বলতে পারবো না, সংশ্লিষ্ট হল কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে। তবে তারা যেভাবেই উঠে থাকুক, এটা অন্যায়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নূরুল আলম বলেন, ‘কোন ছাত্রসংগঠন নতুন হলে আলাদা করে ব্লক করুক আমরা এটা চাইনা, এ বিষয়ে আমি হল প্রভোস্টের সঙ্গে কথা বলবো।’
প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার বলেন, ‘এরকমটা তো ঠিক না, এরকম হওয়ার কথা নয়। মাত্র কিছুদিন হলো আমি দায়িত্ব নিয়েছি, তবে আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো।’
এএইচ