ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

‘আমাদের গ্রুপের গেরিলা টিপু ও আব্দুল জলিল শহিদ হন’

একেএম সালাউদ্দীন আহম্মদ, গেরিলাযোদ্ধা চট্টগ্রাম

প্রকাশিত : ০৬:৪২ পিএম, ১৪ মার্চ ২০২৩ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৫:০৯ পিএম, ১৫ মার্চ ২০২৩ বুধবার

আমি ও টিপু স্বাধীনতার স্বপক্ষে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করি। আমরা মিরসরাইয়ের করেরহাটের ব্রিজটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিই। তারপর রামগড় হাইস্কুলে অবস্থান নেই। রামগড় সরকারি গুদাম থেকে রশদ সংগ্রহ করে ইপিআরদের লঙ্গরখানায় পৌঁছে দেই। যুদ্ধের অবস্থা এতই ভয়াবহ ছিল যে, খাদ্যের অভাবে ক্যাম্পে প্রতিদিন ডাল ও মিষ্টি কুমড়া খেতে হয়েছে।

এদিকে ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল ক্যাপ্টেন মতিনের নেতৃত্বে ইপিআর জওয়ানদের একটি দল সীতাকুণ্ড হাইস্কুল মাঠে আগমন করে। ওইদিন পাকবাহিনীর একটি বোমারু বিমান সীতাকুণ্ড মোহন্তেরহাটে গোলাবর্ষণ করে। বোমা হামলার ঘটনায় অসংখ্য নিরীহ বাঙালি প্রাণ হারান।

তখন আমি সীতাকুণ্ড ডিগ্রি কলেজে এইচএসসিতে পড়তাম। আমরা কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী ইপিআর সৈনিকদের সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেই এবং ক্যাপ্টেন মতিনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমরা যারা ছাত্রলীগ কর্মী ছিলাম, সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য প্রদান করা এবং খাদ্য সরবরাহের কাজ করছিলাম। ক্যাপ্টেন মতিন স্বাধীনতাকামী ইপিআর জওয়ানদের নিয়ে টানা ১০-১২ দিন সীতাকুণ্ড হাইস্কুল মাঠে অবস্থান নেন। আমরা ক্যাপ্টেন মতিনের নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগের কয়েকজন কর্মীকে ধরে আনি এবং এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার চেষ্টা চালাই। স্বাধীনতাকামী ইপিআর গ্রুপটির সঙ্গে কুমিরায় পাকবাহিনীর মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। বাঙালি ইপিআর সৈনিকদের ভারী অস্ত্র ছিল না। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন স্বাধীনতাকামী ইপিআর আহত হন। কয়েকজন পাকসৈনিকও মারা যায়। পাকবাহিনী পাহাড়, সমতল ও নদীপথে আক্রমণ চালায়। ত্রিমুখী আক্রমণে ইপিআর জওয়ানরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

পরে রামগড় থেকে ক্যাপ্টেন মতিনসহ ইপিআর জওয়ানরা ভারতে চলে যান। আমি আর টিপু ১৭ দিন পর সাব্রুম হয়ে হরিণা ক্যাম্পে পৌঁছি। হরিণা ক্যাম্পে গিয়ে সর্ব প্রথমে তালিকাভুক্ত হই। তখনও সীতাকুণ্ড আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের কাউকে দেখতে পাইনি। হরিণা ক্যাম্প ছিল জঙ্গল ও পাহাড়ি এলাকা। সেখানে ১ সপ্তাহ থাকার পর উম্পিনগর ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়।

আমরাই সর্বপ্রথম ভারতে ট্রেনিং নিতে প্রবেশ করি এবং সশস্ত্র যুদ্ধের ট্রেনিং নেই। ভারতীয় সুবেদার মেজর মালহোত্রা অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেন। এ ক্যাম্পে দুই মাস ট্রেনিং নেওয়া হয়। এসএম খুরশীদ (মিরসরাই), আবদুল জলিল ও নুরুল আবছারসহ আমরা ৭ জন গেরিলা মাহফুজ উল্লাহর নেতৃত্বে শ্রীনগর থেকে সর্বপ্রথম সীতাকুণ্ডে প্রবেশ করি। আমরা মিরসরাই লটকানিয়া পুল হয়ে হেঁটে ও নৌকা করে মিরসরাই ভুঁইয়ারহাট দিয়ে সীতাকুণ্ড পৌঁছি। ভূঁইয়ারহাট এলাকায় স্বাধীনতার স্বপক্ষের এক লোকের বাড়িতে একরাত থাকতে হয়।

আমাদের সাথে ভারী অস্ত্র ছিল না। আমরা মূলত গেরিলাযোদ্ধা। এলাকার যুবকরা যেন রাজাকারে ভর্তি হতে না পারে, এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করতাম। কমান্ডার মাহফুজ উল্লাহর নেতৃত্বে সীতাকুণ্ড লালদীঘির দক্ষিণপাশে রেলওয়ের একটি ব্রিজে মাইন স্থাপন করে পূর্বপাশে পাহাড়ের অরণ্যে অবস্থান নেই। কিছু পথ যাওয়ার পর পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণে প্রচণ্ড শব্দ নিজ কানে শুনতে পাই।

ওই রেলব্রিজে মাইন বিস্ফোরণের কারণ হলো মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে পাকবাহিনীকে জানিয়ে দেওয়া। বিস্ফোরণে রেলের ৩-৪টি বগি লাইনচ্যুত হয়। আমাদের সাথে বলতে গুড়, রুটি ও পানি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ওইসময় আমাদের বয়স ছিল গড়ে ১৮-২০ বছর। আমরা স্বাধীনতাকামী ৭ জনের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন এসএম খুরশীদ, ওনার বয়স ৩৫-৩৬ বছর। কমান্ডার মাহফুজ উল্লার বয়স ৪৫-৪৬ বছর। এই অপারেশনের পর মাহফুজ উল্লাহ খুলনায় চাকরিতে চলে যান। পরবর্তীতে এসএম খুরশীদকে কমান্ডারের দায়িত্বে দেয়া হয়।

পরে আরো ৬ স্বাধীনতাকামী মুক্তিগেরিলা ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে আমাদের সাথে যোগ দেয়। আমাদের আরো শক্তি সঞ্চয় হয়, মনোবলও বাড়ে। এবার যৌথভাবে অপারেশন চালাতে থাকি। তখনো থানা কমান্ড গঠিত হয়নি। আমাদের সঙ্গে বহু ইপিআর সৈনিক পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। যেহেতু এদের অস্ত্র ও যুদ্ধের রণকৌশলের উন্নতমানের প্রশিক্ষণ আছে, আমরা তাদের নিয়ে একটা শক্ত গ্রুপ গঠন করি। তখন সম্ভবত জুলাই মাস। পুরোদমে বর্ষা চলছে। কৃষকরা জমিনে বোরোধান রোপণ করেছে।

আমরা ভাটের খিলের নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া চেয়ারম্যানের বাড়িতে অবস্থান নেই। সেখান থেকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের নিয়ে সীতাকুণ্ড থানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেই। থানা আক্রমণের নেতৃত্ব দেন নায়েক (অব.) সফিউল আলম, সুবেদার আবুল মুনছুরসহ আমাদের গ্রুপের যোদ্ধারা। আমাদের ভারী অস্ত্র বলতে এলএমজি, যা আমি নিজেই চালাতাম। আমরা একই সাথে পোস্ট অফিসও আক্রমণ করি। থানা থেকে বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র লুট করে নিয়ে যাই। এ হামলার পর আমরা মিরসরাইয়ে অবস্থান নেই। অবশ্য, কোথাও স্থায়ীভাবে অবস্থান করতাম না, ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় অপারেশন করেই যাচ্ছি।

পরে লোকালয় নিরাপদ মনে না করাই এমএম জুটমিলের পূর্বপাশের পাহাড়ে ক্যাম্প স্থাপন করি। এখানে স্থানীয় লোকজন খাবার-রশদ নিয়ে আসতো। এদের মধ্যে বাঁশবাড়িয়ার সাবেক চেয়ারম্যান দিদারুল আলমও ছিলেন। প্রায় ১ মাস পরে একদিন অতর্কিতভাবে পাক-হানাদার বাহিনী হামলা চালিয়ে আমাদের ক্যাম্পটি ধ্বংস করে দেয়। তবে, ওই আক্রমণের পূর্বেই আমরা নিরাপদে অবস্থান নেই। আমরা যকন পাহাড়ে ক্যাম্প স্থাপন করি, সেখান থেকে প্রতিরাতেই একটা না একটা অপারেশন করতাম। এরপর আমরা সমুদ্রের পাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতাম। এ দুর্যোগ মুহূর্তেও মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি। নিজেদের বিপদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদে আশ্রয় ও খাবার দিয়েছেন তারা।

জুলাই মাসের প্রথমদিকে এসএম খুরশীদের নেতৃত্বে সীতাকুণ্ডে বারৈয়ারঢালায় একটি অপারেশন করে কমর আলী বাজারের পাশে এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে রাতে অবস্থান নেই। ওই বাড়িতে সকাল ৮টায় একলোক এসে খবর দিলো, পাকবাহিনী ও  রাজাকাররা আপনাদের ঘিরে ফেলেছে। তখন আমরা ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু আমাদের কাছে প্রচুর অস্ত্র ছিল। পাঞ্জাবিরা আক্রমণে যাওয়ার আগেই কমরআলী বাজার থেকে একটা ফাঁকা আওয়াজ দেয়। তাদের লক্ষ্য ছিল আমরা পালিয়ে যেতে ছোটাছুটি করলে তারা ধরে ধরে গুলি করে হত্যা করবে। আমরা দ্রুত নিজেদের অস্ত্রগুলো সঙ্গে নেই। আমরা তাদের রেঞ্জের ভেতর, ওরাও আমাদের রেঞ্জের ভেতর। ওরা ছিল অ্যাম্বুশ নিয়ে আর আমরা ছিলাম অপ্রস্তুত।

পরিকল্পনা করি, আমরা ৪ জন দুই ভাগে ভাগ হয়ে ফায়ার করলে হানাদাররা হামলা ক রার সুযোগ পাবে না। আমি এবং আফছার চাইনিজ স্টেনগান দিয়ে ফায়ার করতে করতে বাড়ির দক্ষিণদিকে বের হয়ে যাই। অপর দুই মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিল ও নাছির উত্তরদিক থেকে ফায়ার করতে করতে বের হন। আমরা একে অপরের পিঠেপিঠ লাগিয়ে ফায়ার করছিলাম। আমাদের রাশিয়ান স্টেনগান ও ভারী গোলারমুখে রাজাকাররা অ্যাম্বুশ ছেড়ে কিছুটা পিছু হটে।

একপর্যায়ে আমরাও ফায়ার করতে করতে ধানক্ষেতের আল ধরে দৌড়ে দক্ষিণপাশের এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিতে চেষ্টা করি। আত্মরক্ষার্থে আমি খড়ের মধ্যে এবং আবছার একটি খন্দকের কচুরিপানায় ডুবদিয়ে আশ্রয় নেই। আমি যখন খাড়ের মধ্যে ছিলাম, তখন গ্রামটির চতুর্দিকে পাঞ্জাবিরা ঘিরে আগুন ধরিয়ে দেয়। চতুর পাকসৈনিকরা নিরাপদ স্থানে থেকেই রাজাকারদের লেলিয়ে দেয়। মানুষের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ পর বাড়ির লোকজনের মাধ্যমে জানতে পারলাম রাজাকাররা স্থান ত্যাগ করে পিছু হটে।

এরপর আমি সেখান থেকে বের হই। তখন সকাল ১১টা। রাজাকারদের সাথে প্রায় ৩ ঘণ্টা মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। এলাকার লোকজন জানালো, আমাদের একজন মারা গেছে। ভূঁইয়াবাড়ির পাশে টিপু গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। তার বুকের বামপাশে গুলি বিঁধে। তাকে হাতনাতে ধরে ফেলে তারা। সে রাজাকারদের ধাক্কা দিয়ে নিরাপদস্থানে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়। টিপুর বয়স ছিল খুবই কম ক্লাস টেনে পড়ত। সেদিন টিপুর গায়ে ছিল লালশার্ট। টিপু অনেকটা দিশেহারা হয়ে যায়। মুহাম্মদ ভূঁইয়া বাড়িতে আরো দুই স্বাধীনতাকামী প্রাণ হারান।

আমার দুই পায়ে অসংখ্য খেজুরকাঁটা বিঁধে। কৃষকেরা আলে কাঁটাগুলো গেঁথে রেখেছিল যেন ওই কাঁচা আল দিয়ে হাঁটা-চলা কেউ না করে। আমি ওই কাঁচা আল দিয়ে যেতেই পায়ে কাটা বিঁধে। ডা. এখলাছ উদ্দিনের এক কম্পাউন্ডারের সহযোগিতায় পায়ের যতসব কাঁটা বের করি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ওই অবস্থায় পায়ে ব্যথা অনুভব হয়নি। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে জড়ো হন এবং পুরো এলাকা ঘিরে অ্যাম্বুশ নেন। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় টিপুর লাশ উদ্ধার করে ওই গ্রামে কবর দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা শহিদ টিপু চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন গ্রামটিতে। আব্দুল জলিল ছোট কুমিরায় একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় শহিদ হন। সীতাকুণ্ডে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি বিরল ঘটনা। মুক্তিদের কোন গ্রুপে ২ জন গেরিলা শহিদ হননি। শহিদ টিপু ও শহিদ আবদুল জলিল আমাদের চেতনা ও দেশপ্রেমের পথিকৃৎ।

এএইচ