যাকাত কেন দিবেন, কিভাবে দিবেন
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১২:০৫ পিএম, ২০ মার্চ ২০২৩ সোমবার
কেবল একা ভালো থাকা নয়, সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার জন্যেই যাকাত। আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা এবং সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার ধারণাকে নস্যাৎ করে দেয় ইসলামের যাকাতের বিধান। সুস্থ-সবল, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন এবং সচ্ছল প্রতিটি মুসলিমের জন্যে যাকাত আদায় করা ফরজ। অন্যান্য দানের মতো এটি ঐচ্ছিক কোনো বিষয় নয়; বরং অবশ্য পালনীয়। যাকাত আদায় না করলে ঈমান পরিপূর্ণ হয় না।
আরবি শব্দ যাকাত-এর অর্থ পবিত্র করা, পরিশুদ্ধ করা, প্রবৃদ্ধি দান করা। যাকাত আদায়ের মধ্য দিয়ে যাকাতদাতার অন্তর মুক্তি পায় লোভ ও কৃপণতা থেকে। দরিদ্র-অবহেলিতের জীবন বদলে অবদান রাখায় পরিশুদ্ধ হয় তার সম্পদ। তিনি অর্জন করেন স্রষ্টার সন্তুষ্টি।
আপনি কি যাকাতদাতা?
নিজের প্রয়োজন মেটানোর পর অতিরিক্ত সাড়ে সাত তোলা সোনা (৮৫ গ্রাম) বা সাড়ে ৫২ তোলা রুপা (৫৯৫ গ্রাম) বা সমমানের অর্থ এক চান্দ্রবছর জমা থাকলে প্রাপ্তবয়স্ক বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মুসলমানের ওপর যাকাত ফরজ। রুপার বর্তমান বাজারমূল্য হিসাবে ৫৫ হাজার টাকা থাকলে যাকাত ফরজ হয়। অর্থাৎ সব ধরনের প্রয়োজন মেটানোর পর আপনার কাছে যদি একবছরে কমপক্ষে ৫৫ হাজার টাকা সঞ্চিত থাকে, তাহলে আপনি একজন যাকাতদাতা।
যাকাতগ্রহীতা কে?
যাকাত তো শুধু ১. দরিদ্র, ২. অক্ষম, ৩. যাকাত ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মচারী, ৪. যাদের মন জয় করা প্রয়োজন, ৫. মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্যে, ৬. ঋণ জর্জরিত অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্যে, ৭. আল্লাহর পথে (জনকল্যাণমূলক কাজ, ধর্মপ্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে) এবং ৮. মুসাফিরদের জন্যে ব্যয় করা যাবে। (যাকাতের অর্থ ব্যয়ে) এটাই আল্লাহর বিধান। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
সম্পদের কতটা যাকাত দিতে হবে?
যাকাত ফরজ হয়েছে, এমন সব সম্পদের মূল্য হিসাব করে সর্বমোট মূল্যের ২.৫% বা শতকরা আড়াই ভাগ অর্থ যাকাত দিতে হবে। যাকাতের নিয়ত না করে নিজের সকল সম্পদ দান করলেও যাকাত আদায় হবে না।
ফসলের যাকাত
২৮ মণ পাঁচ সের ফসল হাতে এলে ফসলের যাকাত বা ওশর দিতে হবে। যে-সব জমি প্রাকৃতিক উপায়েই (বৃষ্টি, নদী-নালা বা খাল, ঝর্না ইত্যাদির পানিতে বা প্রাকৃতিকভাবে) সিক্ত ও চাষোপযোগী, কেবল সে-সব জমির ফসলের এক-দশমাংশ ওশর দিতে হবে। আর যে জমিতে কৃত্রিম উপায়ে (পশু বা যন্ত্র ব্যবহারকরে; শ্রম বা মজুরির বিনিময়ে) পানি সেচ করতে হয়, সে জমির ফসলের ২০ ভাগের একভাগ ওশর আদায় করতে হবে।
আদায় করবেন কীভাবে?
আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে বা আগের বছরের সমপরিমাণ নয়, হিসাব করে যাকাত দিতে হবে। ইচ্ছামতো যাকে-তাকে দিলেও যাকাত আদায় হবে না। আল্লাহ নির্ধারিত আটটি খাতে এ অর্থ ব্যয় করতে হবে। যাকাত আদায় যেমন ফরজ, তেমনি সঙ্ঘবদ্ধভাবেআদায় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যাকাতের শুদ্ধাচার
যাকাত করুণার দান নয়, দয়াদাক্ষিণ্যও নয়; ধনীর সম্পদে বঞ্চিতের অধিকার। জনকল্যাণমূলক কাজ হিসেবে মসজিদ, হাসপাতাল, মাদ্রাসা, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানার ভবন নির্মাণে যাকাতের অর্থ ব্যয় করারসুযোগ নেই। কারণ যাকাতের আটটি খাতের মধ্যে ভবন বা স্থাপনা নির্মাণের কথা উল্লেখ নেই। যাকাত প্রদান করতে গিয়ে আত্মপ্রচারণা ঠিক নয়। ব্যানার ঝুলিয়ে, সাইনবোর্ড লাগিয়ে, মাইকিং করে যাকাত দানের বিষয়টি প্রচার করা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।
যাকে যাকাত দিয়ে সাহায্য করা হবে, তাকে জানানোর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে, এটা যাকাতের অর্থ। প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত—যাকাত গ্রহণকারী ব্যক্তি বা পরিবারকে এমনভাবে স্বাবলম্বী করা, যেন একসময় তারাই যাকাতদাতা হতে পারেন। কোনোভাবেই গ্রহীতাকে হেয় বা লজ্জিত করা যাবে না। উপার্জন অথবা নগদ অর্থ না থাকলে নির্ধারিত পরিমাণ যাকাতযোগ্য সম্পদ/ অলংকার বিক্রি করে হলেও যাকাত আদায় করুন।
কোরআনে যাকাতের প্রসঙ্গ
বিশ্বাসীরা নামাজ কায়েম করে, যাকাত আদায় করে এবং আখেরাতে (জবাবদিহিতায়) নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করে। —সূরা নমল : ৩
(হে নবী!) তুমি তাদের ধনসম্পত্তি থেকে যাকাত গ্রহণ করে তাদেরকে পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধির পথে এগিয়ে দাও। তুমি তাদের জন্যে দোয়া করো এবং তোমার দোয়া তাদের অন্তরকে প্রশান্ত করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব শোনেন, সব জানেন। ওরা কি জানে না যে, একমাত্র আল্লাহই তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করতে পারেন? নিশ্চয়ই তিনি যাকাতের (সত্যিকার) গ্রহীতা এবং বান্দার তওবা কবুলকারী ও তার ওপর করুণা বর্ষণকারী। —সূরা তওবা : ১০৩-১০৪।
হাদীসে যাকাতের প্রসঙ্গ
তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে যাকাত আদায় করো। —জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বর্ণিত; মুসলিম, নাসাঈ; যে ব্যক্তি তার সম্পদের যাকাত প্রদান করে, তার সম্পদের দোষ দূর হয়। —ইবনে খুজায়মা, তাবারানী। যার যাকাত ফরজ হবে সে যদি যাকাত আদায় না করে, তবে মহাবিচার দিবসে চূড়ান্ত বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগেই কঠিন শাস্তি চলতে থাকবে। তারপর তার গন্তব্য জাহান্নাম বা জান্নাত তার দৃষ্টিগোচর হবে। —আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত; মুসলিম।
নবীজী (স) মুয়াজ ইবনে জাবলকে ইয়েমেনে পাঠানোর সময় সুস্পষ্টভাবে বলে দেন যে, তারা যদি ইসলাম গ্রহণ করে, তবে তাদের বলবে—আল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং যাকাত আদায় ফরজ করেছেন। তাদের মধ্যে যারা ধনী, তাদের কাছ থেকে যাকাত আদায় করে গরিবদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। —আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত, বোখারী, মুসলিম।
যাকাত কেন গুরুত্বপূর্ণ?
যাকাত ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের অন্যতম। সমাজের অভাবীদেরকে সচ্ছল ও অর্থনীতিকে গতিশীল করে যাকাত। পারস্পরিক সমমর্মিতা ও সম্প্রীতির চর্চা বাড়ায়। যাকাত আদায় করা বিশ্বাসীর পরিচয়। কোরআনে বিশ্বাসীর পরিচয় বর্ণনায় বার বার বলা হয়েছে- তারা নামাজ কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে। বিশ্বাসীরা লোভ, কার্পণ্য ও স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়।
আসুন সঙ্ঘবদ্ধভাবে যাকাত দেই
শিক্ষাবিদ, পরমাণুবিজ্ঞানী ড. এম শমশের আলী বলেন, যাকাত হিসাব করে দিতে হবে। কাউকে কিছু টাকা দিয়ে দিলাম, কোনো বিপদে একটু-আধটু সাহায্য করলাম—এভাবে নয়। সারাবছর নিজের ও পরিবারের সকল ভরণপোষণের ব্যয় বাদে যে উদ্বৃত্ত অর্থ-সম্পদ থাকে, তার ওপর ২.৫% হিসাব করে যাকাত দিতে হবে।
আর যেখানে যাকাত দিলে আপনার মনে কোনো সন্দেহ বা প্রশ্ন থাকবে না যে, উপযুক্ত খাতে ভালোভাবে ব্যয় হলো কিনা, সেখানেই যাকাত দিন।
আমরা সবাই যাকাতের টাকা যদি সঠিকভাবে দেই এবং সুষ্ঠুভাবে ব্যয় করি, তাহলে কোনো দারিদ্র্য থাকবে না। আমাদেরকে কোথাও হাত পাততে হবে না। দেশ দরিদ্র হবে না, দেশের মানুষও দরিদ্র হবে না। আসুন, আমরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে যাকাত দেই।
এএইচ