আমানত শূন্য হচ্ছে যশোর ডাকঘর
মোঃ জামাল হোসেন, বেনাপোল থেকে
প্রকাশিত : ০৯:১১ এএম, ২৬ মার্চ ২০২৩ রবিবার
আমানতের টাকা শূন্য হচ্ছে যশোর প্রধান ডাকঘর। দুর্নীতিসহ নানা কারণে ডাকঘরের ওপর আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। গত তিনমাসে এখান থেকে গ্রাহকরা তাদের দুই প্রকারের হিসাব থেকে প্রায় সোয়া একশ’ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। এছাড়া হিসাব ম্যানুয়াল থেকে ডিজিটাল করা নিয়েও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে সব ধরণের গ্রাহকের মাঝে।
যশোরের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী ও বয়োবৃদ্ধ নিরীহ মানুষের আস্থার জায়গা ছিল প্রধান ডাকঘর। তারা চাকরি জীবনের শেষ সম্বল পেনশনের ও জমানো টাকা ডাকঘরে সঞ্চয় ও মেয়াদী হিসেবে জমা রেখে তার লভ্যাংশ তুলেই সংসার চালিয়ে থাকেন। এ কারণে মাসের শুরুতেই ডাকঘরে মানুষের ব্যাপক ভিড় দেখা যায়। কিন্ত বর্তমানে সে অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। গ্রাহকরা এখন ডাকঘরের ওপর আস্থা কিছুটা হারিয়ে ফেলেছেন।
করোনা পরিস্থিতি ও প্রধান ডাকঘরের আলোচিত পৌনে দু’কোটি টাকা তছরূপকারী সহকারী জেনারেল ম্যানেজার আব্দুল বাকি কাণ্ডসহ ব্যাংকিং খাতের নানা ঘটনায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে গ্রাহকরা প্রতিদিনই কোটি কোটি টাকা ডাকঘর থেকে তুলে নিচ্ছেন। আর বিপুল পরিমাণ এ টাকা গ্রাহককে প্রদান করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
যশোর প্রধান ডাকঘর সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্রধান ডাকঘরে প্রায় ৩০ হাজার সাধারণ সঞ্চয়ী ও মেয়াদি অ্যাকাউন্ট ছিল। এরমধ্যে ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত সাধারণ সঞ্চয়ী হিসাব ছিল সাত হাজার ৪৪০টি ও মেয়াদি হিসাব ছিল ১৭ হাজার ৯৬টি। এরপর করোনাসহ ব্যাংকিং খাতের নানা কারণে গ্রাহকরা তাদের জমানো টাকা উত্তোলন শুরু করেন। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত গ্রাহকরা চার হাজার ৩৪৩টি অ্যাকাউন্ট থেকে তাদের টাকা তুলে নিয়েছেন।
এরমধ্যে সাধারণ সঞ্চয়ী হিসাব রয়েছে ৯৬৭টি ও মেয়াদী হিসেব রয়েছে তিন হাজার ৩৭৬টি। এ হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রধান ডাকঘরে একাউন্টের সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৫৩৬টি। বিপুল পরিমাণ টাকা উত্তোলনের এ ধারা মার্চ মাসেও অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্রটি।
এদিকে, গত তিনমাসে ডাকঘরের চার হাজার ৩৪৩টি হিসাব থেকে গ্রাহকরা একশ’ ২২ কোটি ২০ লাখ ৩৪ হাজার ৫১৩ টাকা উঠিয়ে নিয়েছেন। যা ডাকঘরের ইতিহাসে রেকর্ড বলে কর্মকর্তারা মন্তব্য করেছেন। এরমধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে গ্রাহকরা সর্বোচ্চ ১৮শ’ ৬০টি হিসাব থেকে ৪৩ কোটি ৯৩ লাখ ৩৭ হাজার ৩৭৩ টাকা উত্তোলন করেছেন। এ টাকার মধ্যে মেয়াদি ১৫শ’ ৩৮টি হিসাবের ৪০ কোটি ৯৪ লাখ ৮৮ হাজার ৩৩৫ ও সাধারণ সঞ্চয়ী ৩২২টি হিসাবের ২ কোটি ৯৮ লাখ ৪৯ হাজার ৩৮ টাকা।
ফেব্রুয়ারি মাসে ১১শ’ ৫৭টি হিসাব থেকে এ উত্তোলনের পরিমাণ ৪০ কোটি ২০ লাখ ৬৩ হাজার ৭৩৩ টাকা। এরমধ্যে মেয়াদি ৮৮৮টি হিসাবের ৩৮ কোটি ৬৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯৬ ও সাধারণ ২৬৯টি হিসাবের ১ কোটি ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার ৬৩৭ টাকা।
এর আগে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ১৩শ’ ২৬টি হিসাব থেকে গ্রাহকরা তুলে নিয়েছেন ৩৮ কোটি ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৪০৭ টাকা। এরমধ্যে মেয়াদি ৯৫০টি হিসাবের ৩৫ কোটি ৯০ লাখ ২০ হাজার ৪৫৬ ও সাধারণ ৩৭৬টি হিসাবের ২ কোটি ১৬ লাখ ১২ হাজার ৯৫১ টাকা।
উত্তোলনকৃত টাকার মধ্যে গত তিনমাসে মেয়াদি ৩৩শ’ ৭৬টি হিসাব থেকে গ্রাহকরা তুলে নিয়েছেন ১১৫ কোটি ৪৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৮৭ টাকা ও সাধারণ ৯৬৭ টি হিসাব থেকে ৬ কোটি ৭১ লাখ ৪৮ হাজার ৬২৬ টাকা।
প্রতিদিনই এ টাকা গ্রাহককে প্রদান করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন প্রধান ডাকঘরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তাদেরকে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে হিসাবের লেজার মেলাতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। যদিও কর্মকর্তারা গ্রাহকের আবেদনের প্রেক্ষিতে হিসাবের টাকা উত্তোলনের নির্দিষ্ট তারিখ দিচ্ছেন। এ তারিখে তারা হিসাব চূড়ান্ত করে গ্রাহককে টাকা ফেরত দিচ্ছেন। বিপুল পরিমাণ এ টাকা গ্রাহককে ফেরত দেয়ার ফলে দিনকে দিন যশোর ডাকঘরের ব্যালেন্স শূন্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যা নিয়ে খোদ কর্মকর্তারা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
এদিকে, দেশের সকল ডাকঘরে লেজারের মাধ্যমে কাগজে কলমের ম্যানুয়াল হিসাব উঠিয়ে দিচ্ছেন সরকার। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে গ্রাহকরা তাদের হিসাবে ম্যানুয়াল লেজার বইয়ে কোন টাকা জমা দিতে পারবেন না, শুধুমাত্র টাকা উত্তোলন করতে পারবেন। তারা ওই টাকা উঠিয়ে ডিজিটাল হিসাব খুলে তাতে লেনদেন করতে পারবেন।
এ জাতীয় সমস্যার কারণেও গ্রাহকরা তাদের হিসাব থেকে টাকা উঠিয়ে নিচ্ছেন বলে কর্মকর্তারা মন্তব্য করেছেন।
শহরের পুরাতন কসবা এলাকার গ্রাহক গৃহবধূ করিমন আসাদ মুক্তি বলেন, তিনি চলতি মাসে প্রধান ডাকঘরে তার হিসাব থেকে টাকা উঠাতে গেলে কর্তৃপক্ষ জানান, তার সব টাকা তুলে নিতে হবে। ভেঙে ভেঙে টাকা তোলা যাবে না। প্রয়োজনে তিনি সব টাকা তুলে নতুন ডিজিটাল হিসাব খুলে জমা দিতে পারবেন। কিন্তু পুরনো ম্যানুয়াল হিসাবে তিনি লেনদেন করতে পারবেন না। এ কারণে প্রয়োজনীয় টাকা তুলতে না পেরে তিনি জমানো সব টাকা তুলে নেন বলে জানান।
যশোর প্রধান ডাকঘরের সহকারী পোস্ট মাস্টার জেনারেল গোলাম রহমান পাটোয়ারী বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ডাকঘরের সকল ম্যানুয়াল হিসাব প্রায় ফ্রিজ করে রাখা হয়েছে। ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে কাগজ কলমের লেজার বুকের মাধ্যমে পরিচালিত হিসাবগুলোতে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ডাকঘরে এখন থেকে কোন হিসাব ম্যানুয়ালি থাকবে না, সব ধরণের হিসাব ডিজিটাল করা হবে। এ কারণে গ্রাহকদের সাময়িক সমস্যা হলেও সব ধরণের হিসাব তারা নতুন করে ডিজিটাল করতে পারবেন।
এএইচ