বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত: সরাইলের সূর্যসন্তান
ড. শেখ শাহবাজ রিয়াদ
প্রকাশিত : ০২:৪৪ পিএম, ১৫ এপ্রিল ২০২৩ শনিবার | আপডেট: ০৩:২৮ পিএম, ১৫ এপ্রিল ২০২৩ শনিবার
উল্লাসকর দত্ত ও তাঁর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি
আগামীকাল ১৬ এপ্রিল। উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের আপোসহীন বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত অভিরামের ১৩৯ তম জন্ম দিবস। তাঁর ডাক নাম পালু এবং ছদ্মনাম অভিরাম। তিনি ১৮৮৫ সালের ১৬ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার সুবিখ্যাত কালীকচ্ছ গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছ গ্রাামটি উপমহাদেশের অন্যতম বিখ্যাত গ্রাম। এ গ্রামে বিগত শত শত বছর ধরে অনেক মহান ব্যক্তিবর্গ জন্মগ্রহণ করেছেন। উল্লাসকর দত্ত ছিলেন কালীকচ্ছের দত্ত রায় বংশের সাধক পুরুষ, ব্রাহ্ম সমাজের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব, মানবতাবাদী অধ্যক্ষ দ্বিজদাস দত্তের (১৮৪৯-১৯৩৪) দ্বিতীয় সন্তান। তাঁর মাতার নাম মুক্তকেশী নন্দী।
মাতামহ ছিলেন বৃহত্তর ত্রিপুরার ব্রাহ্ম্য সাধক আনন্দ চন্দ্র নন্দী (১৮৩২-১৯০০), যিনি আনন্দস্বামী নামে ভারতবর্ষে খ্যাত ছিলেন। উল্লাসকর দত্ত এইভাবে মায়ের বংশের দিক থেকেও মানবতাবাদী দর্শনের প্রভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর মামা বাংলার টলস্টয় খ্যাত বিখ্যাত স্বদেশী, সাধক ডা. মহেন্দ্র চন্দ্র নন্দী (১৮৫৪-১৯৩২)। তাঁর জীবনে মামা’র যথেষ্ট প্রভাব ছিলো।
উল্লাসকর দত্তের জন্ম কালীকচ্ছে হলেও শিক্ষা জীবনসহ যৌবনের সেই সময়টুকু বাবার চাকরি’র কারণে কেটেছে কুমিল্লা ও কোলকাতায়। সে সময় তাঁর বাবা দ্বিজদাস দত্ত ছিলেন কোলকাতার শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কৃষি বিভাগের অধ্যাপক।
তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা প্রথম উম্মেষ ঘটে স্বদেশী নেতা বিপিন চন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২) ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) বক্তৃতা শুনে। মিনার্ভা থিয়েটার হলে রবিবাবুর 'স্বদেশী সমাজ' শুনতে প্রবেশাধিকার নিয়ে হাতাহাতি, মারামারি এবং থানা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। ইতোমধ্যেই উল্লাসকর দত্ত এফ এ পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র।
প্রেসিডেন্সী কলেজের প্রফেসর রাসেল বাঙ্গালী ছাত্রদের নিয়ে অপমানকর ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্যে উল্লাসকর দত্তসহ অনেক ছাত্র তাকে অপমান করায় কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। উল্লাসকর দত্তের সহযোদ্ধা বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় (১৮৭৯-১৯৫০) তাঁর ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’য় (১৯২১) উল্লাসকর দত্তের সেই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন এই ভাবে ‘‘বাগানে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলাম, ‘সাজ সাজ’ রব পড়িয়া গিয়াছে। যে সমস্ত নতুন ছেলে আসিয়া জুটিয়াছে, উল্লাসকর তাহাদের মধ্যে একজন। প্রেসিডেন্সী কলেজের রসেল সাহেব বাঙ্গালীর ছেলেদের গালি দিয়াছিল বলিয়া উল্লাসকর একপাটি ছেঁড়া চটিজুতা বগলে পুরিয়া কলেজে লইয়া যায়; এবং রসেল সাহেবের পিঠে তাহা সজোরে বকশিশ দিয়ে কলেজের মুখদর্শন বন্ধ করিয়া দেয়’’।
বহিষ্কৃত হওয়ার পর তিনি বোম্বেতে ভিক্টোরিয়া টেকনিকেল কলেজে টেক্সটাইল বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে তাঁর মন টিকেনাই। বোম্বে থেকে একবার বাড়িতে আসার পর আর ফিরে যাননি। প্রকৃতপক্ষে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনই উল্লাসকর দত্তকে স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয় করেছিল। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের (১৮৭২-১৯৫০) অনুপ্রেরণায় ও তাঁর ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষের (১৮৮০-১৯৫৯) নেতৃত্বে কলকাতার ৩২নং মুরারিপুকুরে গঠিত হয় সশস্ত্র বিপ্লবী 'অনুশীলন সমিতি'।
সেখানেই বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র দাশ, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, অবিনাশ ভট্টাচার্যর মতো বিপ্লবীরা দলের নীতি নির্ধারণ করতেন। ১৯০৭ সালে ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িটিই হয়ে উঠে সশস্ত্র বিপ্লবীদের আস্তানা। পরের ইতিহাস সবার জানা।
উল্লাসকর দত্ত ও উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৈরি বোমায় ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীকে মজফফরপুরে পাঠানো হয় অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার জন্য। দুর্ভাগ্যক্রমে কিংসফোর্ডের বদলে তাঁদের বোমায় কেনেডি নামক এক ইংরেজ আইনজীবীর পত্নী ও কন্যা নিহত হয়। উল্লাসকর, বারীন ঘোষসহ ৩৬ জন বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার হন।
এ ঘটনায় জেলা ও দায়রা জজ মি. চার্লস পোর্টেন বিচক্রফট এর আদালতে যে মামলা উঠে ইতিহাসে তা আলীপুর বোমা মামলা নামে খ্যাত হয়। ঐতিহাসিক আলীপুর বোমা মামলা শুরু হয় ১৯০৮ সালের ২১ মে, রায় বেরোয় ১৯০৯ এর ৬ই মে। ৩৬ জন আসামির মধ্যে উল্লাসকর দত্ত ও বারীন্দ্রকুমার ঘোষের ফাঁসির আদেশ হয়।
এই প্রসঙ্গে বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘নির্বাসিতের আত্মকথায়’ উল্লেখ করেন ‘‘মুকাদ্দামা আরম্ভ হইবার এক বছর পরে যখন যখন রায় বাহির হইল তখন দেখা গেল সত্যি সত্যি অরবিন্দ বাবু মুক্তি পাইয়াছেন উল্লাসকরের এবং বারীন্দ্রের ফাঁসির আর দশ জনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের হুকুম হইল। বাকি অনেকের পাঁচ সাত দশ বৎসর করিয়া জেল বা দীপান্তর বাসের আদেশ হইল। ফাঁসির হুকুম শুনিয়া উল্লাসকর হাসিতে হাসিতে জেলে ফিরিয়া আসিল বলিল ‘দায় থেকে বাঁচা গেল’। একজন ইউরোপীয় প্রহরী তাহা দেখিয়া তার এক বন্ধুকে ডাকিয়া বলিলেন “Look, look the man is going to be hanged and he laughs” (দেখ দেখ লোকটীর ফাঁসি হইবে, তবু সে হাসিতেছে)- তার বন্ধুটী আইরিশ, সে বলিল “Yes, I know they all laugh at death (হ্যাঁ আমি জানি মৃত্যু তাদের কাছে পরিহাসের বিষয়)”।
বারীন্দ্র ঘোষের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত উল্লাসকর আপিলে রাজি হয়েছিলেন। ফলে উচ্চ আদালতের রায়ে ফাঁসির আদেশ রদ করে উল্লাসকর ও বারীন্দ্রের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরাদেশ দেয়া হয় ১৯০৯ এর ২৩শে আগস্ট। কঠিন ও অমানবিক শাস্তি ভোগ করে প্রায় ১২ বছর কারাগারে কাটানোর পর মুক্তি মিলল ১৯২০ সালে।
এতো অত্যাচার, মানসিক নির্যাতনও দমাতে পারেনি এই বিপ্লবীকে। আন্দামান থেকে ফিরে কখনো কালীকচ্ছে, কখনো কুমিল্লায়, কখনো কোলকাতায় সময় কাটিয়েছেন। এই মহান সংগ্রামী ১৯৬৫ সালে আসামের শিলচরে পরলোক গমন করেন।
তবে তাঁর স্মরণে ১৯৮২ সালে সরাইলে ভাষা সংগ্রামী অধ্যক্ষ শেখ মো. আবু হামেদের নেতৃত্বে ‘‘উল্লাসকর দত্ত স্মৃতি সংসদ’’ ও ‘‘প্রাণউল্লাস খেলাঘর’’ নামে দুটো সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাঁর জন্মস্থান কালীকচ্ছের মানুষ এখনো তাঁকে স্মরণ করে।
বর্তমানে সরকারিভাবে তাঁর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে তার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিতে উল্লাসকর দত্ত স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হবে প্রত্যাশা করছে এলাকাবাসী।
(লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, কালীকচ্ছ জাদুঘর, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
এএইচ