সিলিং ফ্যান ও মানবতার গল্প
শাখাওয়াত উল্লাহ
প্রকাশিত : ০৪:৪৭ পিএম, ২০ এপ্রিল ২০২৩ বৃহস্পতিবার
আজ রাতে আমি থাকছি সাউথ বারিধারায়। এবাদত আলীর বাসায়। আট তলার চিলেকোঠায় দুই রুমের বাসা। একটা ছোট বাথরুম, আরেকটা ছোট কিচেন রুম। এবাদত আলী এখানে একা থাকেন। বেশ অগোছালো। তবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এবাদত আলী মনে করেন গুছিয়ে বসে থাকলে ক্রিয়েটিভ হওয়া যায় না। এখানে রাত এগারোটা তিরিশ মিনিটে লিফট বন্ধ। আট তলায় হেঁটে উঠতে না চাইলে আগে আগে চলে আসতে হবে।
এবাদত আলীর পরিচয়টা দিয়ে নিই। তিনি আমার বাবার একজন ছাত্র। বাবা তার খুবই প্রিয় একজন মানুষ। বাবা নেই আজ ছয় বছর। এখনো মাঝে মধ্যে নাকি এবাদত আলী একা থাকলে আমার বাবার জন্য কাঁদেন। আমাকে পছন্দ করা এবং তার কাছে কিনারে রাখার একমাত্র কারণ আমি তার স্যারের ছেলে।
যাইহোক এবাদত আলীর বাসার লিফট বেশ সুন্দর। ফাইভ স্টার হোটেলের মতো সৌন্দর্য্য। আট তলায় ওঠার পর তিনি আমাকে সরাসরি ছাদে নিয়ে গেলেন। ছাদে এসে আমি বাক-বাকুম! খুশিতে বাক-বাকুম। সুন্দর চারটি ঘুঘু, তিনটি গাছে তিন রকমের কাঠ গোলাপ, ইন্ডিয়ান হাইব্রিড গোলাপ, দেশি গোলাপ, সফেদা, বেলাম্বু, তিন পদের আম, হরেক রকম লেবু গাছ, নানান রঙের নয়নতারা, এডেনিয়াম, ক্রিসমাস ট্রি, করমচা ইত্যাদি নানান ধরনের গাছ। ছাদে বসার, এমনকি শোয়ারও এন্তেজাম আছে। আমি বললাম ভাইজান এখানে বসে তো চা খাওয়া যায়। আমি যেহেতু চা খাই না এক কাপ দুধের এন্তেজাম করেন প্লিজ।
এবাদত আলী বললেন, ‘ঘরে দুধ নাই, এমনকি দুধ গরম করার চুলাও নাই! তবে পাতিল আছে।’
আমি মনে মনে তারে দু’চারটা গালি দিতে গিয়ে দিইনি। যেই লোক আমার বাবাকে এতো ভালোবাসেন তাকে গালি দিই কেমনে?
কিছুক্ষণ ছাদের রাইবেলী, কাঠ গোলাপের ঘ্রাণ নিয়ে বললাম এবার একটু ফ্রেশ হয়ে আসি। বাইরে বেশ গরম। ছাদ থেকে ভাপ বেরুচ্ছে। তিনি আমাকে রুমে আনলেন। বললাম, ফ্যানের সুইচটা.. বলতে বলতে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে দেখি ফ্যান নাই! দুই রুমের কোন রুমেই ফ্যান নাই! তাহলে কি পোর্টেবল এসি আছে ঘরে? এবাদত আলী জানালেন, ফ্যান যেখানে অপ্রোয়জনীয় সেখানে আবার এসির বিলাসিতা! সেদিন পাবনার ঈশ্বরদীতে তাপমাত্রা বেড়ে ৪৩, আর আমার মেজাজ উঠলো ৪শ তেতাল্লিশে।
রাগ করে বের হয়ে চলে যাবো সেই ব্যবস্থা নাই। আমি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে যে কষ্ট পাই তারচেয়ে বেশি কষ্ট পাই নামতে। ডান পা পুরোপুরি ভাঁজ হয় না বলে নামতে কষ্ট হয়।
আমার কষ্ট দেখে এবাদত আলী বললেন, ‘তুই আসবি বলে একটা টেবিল ফ্যান কিনেছিলাম। ফার্মগেট থেকে আসার সময় একজন রিকশাচালক চাচার সাথে পরিচয় হলো। চাচার বয়স হয়েছে। বয়সের ভারে গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে। নিচের চোয়ালের দুইটা দাঁত পড়ে গেছে। বয়স্ক মানুষ দেখে আমি প্রথমে রিকশায় উঠবো না ভেবেছিলাম। পরে ভাবলাম না উঠলে তো উনি ভাড়া পাবেন না। ওনার সাথে অনেক কথা হয়। নাম মঈনুদ্দিন। গ্রামের বাড়ি লক্ষীপুরের কমলনগরের দিকে ছিলো। কৃষি জমি ছিলো। বড় একটা পুকুর ছিলো। নারকেল সুপারির দুটো বাগান ছিলো। দুই ছেলের বড় ছেলে কাতার ছিলেন। মনে বড় আশা ছিলো দেশে এসে বিয়ে করবেন। নাম ছিলো ফারুক। মোহাম্মদ ওমর ফারুক।
মঈনুদ্দিন চাচা বলেন, ‘আমার ফারুক আমার আর তার মায়ের খোঁজ খবর নিতো। আল্লার তিরিশ দিন মোবাইলে কথা বলতো। দেশে আসার তিনদিন আগে কাতার থেকে লোকজন আমাদের জানালো আমার ফারুক নাই। ফারুককে নাকি ফাঁসি দিছে। আত্মহত্যা করেছে। বিশ্বাস করেন কাকা আমার ছেলে ফাঁসি দেয়ার ছেলে না। আপনি বলেন যেই ছেলে রাতে তার মায়ের সাথে কথা বলেছে, গপশপ করেছে, সকালে সে কি জন্য ফাঁস নিবে? তারা বলেছিলো, ছেলের লাশ সেই দেশে কবর দিলে আমাদেরকে মেলা টাকা দিবে। আমরা বলছি আমার মানিকরে আমার দেশে কবর দিমু।
এবাদত ভাই বললেন, ‘যেইলোক এমন দুঃখের ভার বইতে পারেন তার কাছে রিকশা টানা কোন ব্যাপার? আমি বললাম, না।
আমি বললাম আপনার ফ্যান কই গেলো সেটা বলেন।
এবাদত ভাই বললেন, ‘আগে কথা শোন। মঈনুদ্দিন চাচার কথা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল। তারপরও বললাম চাচা থাকেন কই? আপনার ছোট ছেলে কই? আপনার বাড়িঘর কই?’
মঈনুদ্দিন চাচা বললেন, থাকি নাখালপাড়া বস্তিতে। আমার ফারুকরে আমাদের মসজিদের পাশে কবর দিছিলাম। ফারুক চলে যাওয়ার পরে আমার ছোট ছেলে জসিম উদ্দিন আমাদের বড় ঘর থেকে বের হয়ে কাচারি ঘরে গিয়ে থাকতো। আলেম ক্লাসে পড়তো। আমরা তো জানতাম না কেন জসিম কাচারিতে গেছে। সারারাত আমার জসিম কাশতো। এই জন্য অনেক ওষুধ পত্র করছিলাম। কিছুই হয়নি। পরে ঢাকা এসে পরীক্ষা করার পর ডাক্তার বলেছেন আমার জসিমউদ্দিনের ক্যান্সার। ফুসফুসে ক্যান্সার। ছেলের জন্য সুপারি বাগান বিক্রি করে দিছিলাম। আমনের চাচী সারারাত আল্লার কাছে কান্নাকাটি করতো। দুইটা ক্যামোথেরাপি দেয়ার পর আমার জসিম আল্লার কাছে চলে গেছে। শোকে আপনারর চাচী স্ট্রোক করে একপাশ অবশ হয়ে গেছে। তিন বছর আগে কমলনগরের ভয়াবহ ভাঙনের কারণে আমার বাড়ি ঘর, সহায় সম্পত্তি সব নদী নিয়ে গেছে। আমার অর্থ সম্পদ ছিলো, এলাকায় আমার সম্মান ছিলো। মাবুদে পাকের ইচ্ছা হইছে সব নিয়ে গেছেন। আমার দুই ছেলের কবর, বাপ-মায়ের কবর সবই এখন দরিয়ার পেটে। আমি এখন পথের ফকির। ঢাকায় আসার পর অনেকেই রিকশা দেয়নি। অনেক কষ্ট করে একজনকে রাজি করাইছি। আমার বয়স বেশি বলে অনেকেই আমার রিকশায় উঠতে চায় না। এমনি টাকা দিতে চায়। এমনি টাকা নিলে তো ভিক্ষা। আমি ভিক্ষা নিতে চাই না। নবীজি (সাঃ) ভিক্ষার বদলে কুঠার কিনে দিছেন। তাও সেই লোকের টাকায়। যতদিন নিঃশ্বাস আছে ততদিন যেন এই হাত মানুষের কাছে পাতা না লাগে।
এবাদত ভাই বললেন, শোন আমি সেদিন ঐ রিকশাওয়ালা চাচার বস্তির ঘরে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি চাচী অসুস্থ। তপ্ত দুপুরে টিনের ঘরের চারদিকে মনে হচ্ছিল আগুন জ্বলছে। ঘরে ঢুকতে মনে হলো জ্বলন্ত চুলার মধ্যে ঢুকছি। বস্তির অন্যান্য ঘরে টিভি ফ্রিজ পর্যন্ত আছে কিন্তু ওনাদের ঘরে ফ্যান পর্যন্ত নাই। ছয়শ টাকা দিয়ে মঈনুদ্দিন চাচা ফ্যান কিনেছিলেন। চাচা একদিন চাচীকে ধরে বাথরুমে নিয়ে গেলেন। এসে দেখেন ঘরে মোবাইল আর ফ্যানটা নাই। আটশো টাকা দিয়ে মোবাইলটা কিনেছিলেন।
এবাদত ভাই বললেন, ‘চাচাকে জোর করে ফ্যানটা দিয়ে এসেছিলাম। আর আমার হাতে সেদিন ঈদ বোনাসের ২৩ হাজার ৫০০ টাকা ছিলো সেগুলো দিয়ে চলে আসছি।’
ফ্যান থাকলে তুই বাতাস খাইতি, এখন চাচা বাতাস খাচ্ছেন। কোনটা ভালো?
আমি বললাম, ‘আপনি যা করেছেন তাই ভালো।’
skullah87@gmail.com