তোতা পাখি ও দোকানি
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৫:৫২ পিএম, ৪ মে ২০২৩ বৃহস্পতিবার
অনেক আগে এক দেশে ছিল এক মুদিদোকানি। তার ছিল সবুজরঙা খুব সুন্দর এক তোতা পাখি। পাখিটি তার দোকানের এক কোণে বসে থাকত।
তোতাপাখিটা চমৎকার গাইতে পারত, কথাও বলত অনর্গল। সেদিক থেকে পাখিটি ছিল দোকানির আদর্শ সঙ্গী। কারণ, তার মিষ্টি গান আর কথা শুনতে সেখানে ভিড় জমাত লোকজন। সেই সঙ্গে প্রহরী হিসেবেও দোকানটি সারা দিন দেখেশুনে রাখত পাখিটি। দোকানে আসা ক্রেতা বা অন্যদের সঙ্গেও আন্তরিক ব্যবহার করত সে। মজার মজার কথা বলে, খেলা দেখিয়ে ক্রেতাদের আনন্দও দিত। পাখিটির কারণেই বিক্রি বেড়ে যেত দোকানের।
একদিন পাখিটিকে দোকানে বসিয়ে দুপুরের খাবার খেতে বাড়ি গেল দোকানি। এমন সময় কোথা থেকে যেন একটা বিড়াল দৌড়ে দোকানের ভেতর হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। আসলে একটা ইঁদুরকে তাড়াতে তাড়াতে দোকানে এসেছিল বিড়ালটা। আচমকা বিড়ালকে ঢুকে পড়তে দেখে বেশ ভয় পেল তোতাপাখি। সে পড়িমড়ি করে উড়ে নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে চাইল। ডানা ঝাপটিয়ে কোনোমতে সরে গিয়ে নিজেকে বাঁচাতে পারল সে। কিন্তু তার পাখার ধাক্কায় তাক থেকে কিছু তেলের শিশি-বোতল নিচে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সেই তেলে ভেসে গেল দোকানের মেঝে।
কিছুক্ষণ পরেই মুদি দোকানে ফিরে এল দোকানি। সেখানে ঢুকেই সবকিছু এলোমেলো দেখতে পেল। মেঝেতে তেল পড়ে পিচ্ছিল হয়ে ছিল। ওদিকে তোতাপাখিটি অপরাধীর ভঙ্গিতে দোকানের এক কোণে বসে থাকতে দেখল সে। মুহূর্তেই রাগে ফেটে পড়ল দোকানি। হাতের কাছে একটা লাঠি পেয়ে তা–ই দিয়ে পাখিটির মাথায় জোরে আঘাত করে বসল সে। বেচারা পাখিটি এতে খুব কষ্ট পেল। কিন্তু মুখে কোনো প্রতিবাদ করতে পারল না সে। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে রাগে-দুঃখে সে মাথার সব পালক পায়ের নখ দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল।
এই ঘটনার পর কথা বলা ও গান গাওয়া একেবারেই বাদ দিল পাখিটি। অনেক চেষ্টা করেও তাকে কথা বলাতে বা গান গাওয়ানো গেল না। দোকানি ধীরে ধীরে তার ভুল বুঝতে পারল। পাখিটিকে মারা যে খুব অন্যায় হয়েছে, তা হাড়ে হাড়ে টের পেল দোকানি। কারণ সে শুধু আমুদে এক সঙ্গীকেই হারায়নি, সেই সঙ্গে তার ব্যবসাতেও ধস নামতে লাগল।
একদিন দোকানি কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, ‘যদি নিজের হাতটা ভেঙে ফেলতে পারতাম! এই হাত দিয়ে আমি কিনা আমরা পাখিটিকে মেরেছি। এমন দানবের মতো আচরণ কীভাবে করতে পারলাম আমি?’
এরপর থেকে ওই দোকানের পাশ দিয়ে কোনো গরিব দরবেশ গেলেই তাকে ভিক্ষা দিতে লাগল দোকানি। তার আশা, ভালো কাজের মাধ্যমে যদি ক্ষমা পাওয়া যায়। তাতে হয়তো তার পাখিটি আবার আগের মতো গান গাইতে আর কথা বলতে শুরু করবে।
টানা তিন দিন, তিন রাত অনুতাপ আর তোতাপাখির নীরবতার শাস্তি ভোগ করল দোকানি। এরপর দোকানির ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করল। এক টাক মাথাওয়ালা দরবেশ সেদিন ওই দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। দরবেশকে দেখে হঠাৎ তোতাপাখিটি বলে উঠল, ‘তুমিও কি তেলের বোতল ভেঙে ফেলেছিলে নাকি?’
পাখির মুখে এ কথা শুনে দোকানের ক্রেতারা অবাক হয়ে গেল। তারা পাখিটির দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল। কারণ তোতাপাখিটি মনে করেছিল, টাকমাথাওলা দরবেশও বোধ হয় তার মতো শাস্তি ভোগ করছে।
তখন এক ক্রেতা পাখিকে উদ্দেশ করে বলল, ‘শোনো ছোট্ট পাখি, নিজের কাজের সঙ্গে অন্যের কাজ একই রকম মনে কোরো না। একজনের সঙ্গে আরেকজনের তুলনা চলে না। ওপরে ওপরে দেখতে একই মনে হলেও কোনো কিছুই আসলে এক রকম হয় না।’
জালাল উদ্দিন রুমির গল্পের ভাষান্তর করেছেন আবুল বাসার