লঞ্চ ভ্রমণ: বক প্রহরায় মেঘনা পাড়ি
মোহাম্মদ মাসুদ খান
প্রকাশিত : ০৫:১৬ পিএম, ২৭ মে ২০২৩ শনিবার | আপডেট: ০৫:২১ পিএম, ২৭ মে ২০২৩ শনিবার
বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হবার পর দিনই আব্বা আমাদের গ্রামের বাড়ি নিয়ে যেতেন। মাস খানেক সেখানে বেড়াতাম। স্কুল জীবনে এমনই নিয়ম ছিলো আমাদের। ডিসেম্বর মাসে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। পরীক্ষা শুরুর প্রথম দিন থেকেই অপেক্ষার প্রহর গুনতাম কবে পরীক্ষা শেষ হবে? কবে গ্রামের বাড়ী যাবো? সে যেনো এক অধীর অপেক্ষা। সময়টা পচাত্তর থেকে পঁচাশি সময় কালের যখন আমি স্কুলের চার দেয়ালের গণ্ডিতে আবদ্ধ।
আর যেদিন ফাইনাল পরীক্ষাটা শেষ হতো সেদিন কি যে আনন্দ লাগতো,তা ভাষায় প্রকাশ করা দূরূহ। উত্তেজনা এতোটাই প্রবল ছিলো যে, অনেক সময় শেষ পরীক্ষাটা কোন মতে সম্পন্ন করে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে বাসার দিকে দে ছুট।
পরের দিনই আব্বা আমাদের নিয়ে গ্রামের বাড়ির পানে রওনা হতেন। ফজরের নামাজের পর আমাদের শেরেবাংলা নগরের বাসা থেকে যাত্রা শুরু হতো। সদরঘাট পর্যন্ত বেবিট্যাক্সি। তারপর লঞ্চ বা স্টিমার যোগে চাঁদপুর। আগের দিন রাতেই আব্বা বেবিট্যাক্সি বা স্কুটার ঠিক করে রাখতেন। পরদিন ভোরবেলা ড্রাইভার সাহেব স্কুটার নিয়ে বাসার সামনে যথাসময়ে হাজির হয়ে যেতেন। দোতালা'র বারান্দা থেকে আমরা তা লক্ষ্য করতাম। আম্মা, আপা, শিপু, আব্বা সহ আমাদের পাঁচ জনের পুরো পরিবার সেই স্কুটারে চেপে বসতাম। ড্রাইভার সাহেব বাম হাত দিয়ে স্কুটারের হ্যান্ডেল সজোরে নীচ থেকে উপরে উঠিয়ে বেবিট্যাক্সির ইঞ্জিন স্টার্ট দিতেন। ব্যপারটি আমি তখন দারুনভাবে উপভোগ করতাম। আমাদের নিয়ে বেবিট্যাক্সিটি খেজুর বাগান, ফার্মগেট, শাহবাগ, গুলিস্তান, জনসন রোড হয়ে কখন যে সদরঘাট টার্মিনালে পৌঁছে যেতো তা টেরই পেতাম না।
সদরঘাট টার্মিনালে পৌঁছা মাত্রই শুরু হয়ে যেতো কুলিদের হাঁক ডাক। সাথে থাকা মালমাল বহন নিয়ে শুরু হয়ে যেতো দামাদামি। টার্মিনালের মুল ফটক পেরিয়ে ঢালু কাঠের ব্রিজ দিয়ে নদীর উপর স্থাপিত পুন্টনে যখন পৌছতাম তখন দেখা যেতো সারি সারি লঞ্চ সেখানে ভীড়ে আছে।
লঞ্চের সামনে চলতো ডাকাডাকি। “শরীয়তপুর-শরীয়তপুর”,
“চাঁদপুর-চাঁদপুর” কিংবা “ডামুড্যা-ডামুড্যা”
“বান্দুরা-বান্দুরা” ইত্যাদি হরেক রকম আওয়াজ।
“বান্দুরা” নামটি আমার কাছে অদ্ভুদ ঠেকতো, তাই আব্বাকে জিঙ্গেস করতাম এটা আবার কোথায়?
ছোট ছোট লঞ্চগুলো ছিলো কাঠ দ্বারা নির্মিত। প্রতিটি লঞ্চের আবার বাহারী নাম ছিলো। যদ্দুর মনে পড়ে চাঁদপুর হয়ে ফরিদগঞ্জ গামী আমাদের রুটের লঞ্চগুলোর নাম ছিলো এমভি রিপন, এমভি পলাশ,এমভি ঝিলু, এমভি হেনা ইত্যাদি।
সে সময় স্টীল দ্বারা নির্মিত একমাত্র লঞ্চ ছিলো বেঙ্গল ওয়াটার যা কেবল চাঁদপুর ঢাকা রুটে প্রতিদিন নিয়মিত যাতায়াত করতো। সদরঘাট থেকে সামান্য দূরে পশ্চিমে ছিলো বাদামতলী ঘাট। সেখান থেকে ষ্টীমারগুলো ছাড়তো। ষ্টীমারকে আব্বা কখনো কখনো ‘রকেট’ও বলতেন। গাজী, বেলায়েত, লেপচা, মাসহুদ ইত্যাদি নাম ছিলো সেই বিশাল আকারের রকেট-ষ্টীমারগুলোর।
সেগুলো ঢাকা থেকে চাঁদপুর হয়ে বরিশাল-খুলনা, পটুয়াখালী রুটে চলাচল করতো। তাই আমরা ষ্টীমার, বেঙ্গল ওয়াটার কিংবা লঞ্চের যে কোনটাতেই যাতায়াত করতে পারতাম। তবে রকেট-স্টীমার বা বেঙ্গল ওয়াটারে ভ্রমণ করলে আমরা চাঁদপুরে নেমে যেতাম পরে অন্য আরেকটি ছোট লঞ্চে চাঁদপুর থেকে ডাকাতিয়া নদীর আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে একেবারে আমাদের মদনের গাঁও গ্রামের গাঙগুইল্যা বাড়ির গুদাড়া ঘাটে পৌঁছে যেতাম।
১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ছোট লঞ্চ গুলো ঢাকা থেকে চাঁদপুর হয়ে ফরিদগঞ্জ যাতায়ত করতো। সেবার সদরঘাট থেকে কাঠ নির্মিত একটি লঞ্চে আমরা সবাই উঠে পড়লাম। লঞ্চের দুপাশ লম্বা লম্বা গাছের গুড়ি ঝুলে থাকতো যা লঞ্চটিকে অন্য লঞ্চের আঘাত থেকে রক্ষা করতো।
সকাল সাড়ে সাতটার দিকে লঞ্চ ছেড়ে দিলো। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা দিয়ে আমাদের লঞ্চ এগিয়ে চলছে। নদীর দুতীরের সৌন্দর্য দেখে আমাদের চোখ জুড়াতো। বিভিন্ন কল-কারখানা, ইটের ভাটা, বাজার ইত্যাদি কর্মকাণ্ড লঞ্চ থেকে চোখে পড়তো। বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশ থেকে পানির ওপর ভেসে ওঠতো জলজ প্রাণী শুশুক যা দেখে রোমাঞ্চিত হতাম। কাঠপট্টি পেরিয়ে মুন্সীগঞ্জ ঘাটের কাছে আসলেই লঞ্চগুলোর গতি কমিয়ে দেওয়া হতো। দুপাশ থেকে ছোট ছোট নৌকা আমাদের লঞ্চকে ঘিরে ধরতো। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। মুন্সীগঞ্জের যাত্রীরা লঞ্চ থেকে সরাসরি সেই নৌকায় নেমে যেতেন কেউবা আবার নৌকা থেকে লঞ্চে উঠতেন চাঁদপুর যাবার জন্য। কিছু কিছূ নৌকায় ফেরীআলারা কলা আর বিশেষ ধরনের লম্বা পাউরুটি নিয়ে লঞ্চে ওঠে পড়তেন এবং যাত্রীদের কাছে তা বিক্রি করতেন। মুন্সীগঞ্জের রামপাল এলাকার কলা আর পাউরুটির বিশেষ কদর ছিলো যাত্রী সাধারনের কাছে। মাত্র পাঁচ-ছয় মিনিটের মধ্যে যাত্রী ওঠা-নামা এবং বেচা-কেনা শেষ করে আমাদের লঞ্চ আবার দ্রুত গতিতে ছুটে চলতো। কখনো কখনো সাদা বকের দল আমাদের লঞ্চের সাথে পাল্লা দিতো। মাঝে মধ্যে বকের দল উড়তে উড়তে আমাদের লঞ্চ কে ছাড়িয়ে বহুদুর এগিয়ে যেতো, পরে আবার ফিরে এসে লঞ্চের সাথে তাল মিলিয়ে উড়তো। মনে হতো বকগুলো যেন আমাদের লঞ্চটিকে পাহারা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নীল আকাশের নীচে আর নীল জলরাশির ওপর এই খেলা চলতো বেশ কয়েক মাইল জুড়ে। এক সময় বকের দল কোথায় যে হারিয়ে যেতো তা টেরই পেতামা না।
বকের সাথে খেলা করতে করতে আমাদের লঞ্চ কখন যে মেঘনার অথৈ জলের বুকে ভাসছে তা বুঝতে পারতাম না। বিশাল মেঘনায় নদীর দুকুল আর দেখা যেতো না। মেঘনার বুকে আমাদের লঞ্চ কে নিতান্তই ক্ষুদ্র মনে হতো। পাশ দিয়ে অন্য কোন লঞ্চ বা নৌযান অতিক্রম করলে আমাদের লঞ্চ ঢেউয়ের তালে দুলতো। নদীতে চোখে পড়তো অসংখ্য নৌকা। ছোট, মাঝারী বা বড় আকারের নৌকাগুলোর কোন কোনটি আবার বাহারী রঙের পাল উড়িয়ে চলতো। সে দৃশ্য দেখে আমাদের চোখ জুড়াতো।
বড়ো নৌকাগুলো চালাতে দশ-পনের জন মাঝিমাল্লার দরকার হতো। মাঝ নদীতে এক সাথে আট-দশ জন মাঝিকে একসাথে বৈঠা বাইতে হতো। আর নদীর পাড় দিয়ে চলার সময় চার-পাঁচ জন মাল্লা দাড় টেনে নৌকাকে সামনে এগিয়ে নিতেন। সে দৃশ্য দেখতে অপুর্ব লাগলেও মাঝিমাল্লাদের হাড় ভাঙ্গা খাটুনী পোহাতে হতো। নদী পথে এভাবে নৌকা চালিয়ে চাঁদপুর থেকে ঢাকা আসতে চার-পাঁচ দিন সময় লেগে যেতো। মেঘনা পাড়ি দিয়ে যাতায়ত করতে এই নৌকাগুলো কে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তো হতো। বিশেষকরে ঝড় ও বর্ষায় উত্তাল নদীতে নৌকা চালানো মোটেও সহজ সাধ্য ছিলো না। মাঝিরা দক্ষতা ও দৈহিক শক্তির মাধ্যমে দুর্যোগ মোকাবেলা করে নৌকার হাল ধরে রাখতেন। বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার সামান্য ঘাটতি হলেই ছিলো নৌকা ডুবি ও জীবন বিপন্নের আশঙ্কা। প্রচণ্ড ঢেউয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারী নৌকাকে খড়-কুটার মতো দুলতে দেখেছি। ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নৌকাগুলো পাঁচ-ছয় ফুট উপরে ওঠে যেতো আবার নীচের দিকে আছড়ে পড়তো। এসব দৃশ্য অবলোকন করে অনেক সময় আঁতকে ওঠেছি।
মুন্সীগঞ্জ,গজারিয়া,ষাটনল,মোহনপুর,এখলাছপুর পেরিয়ে চাঁদপুরের কাছাকাছি এলে মেঘনা আর পদ্মার মিলিত স্থানের সাক্ষাৎ পেতাম। সেখানে মেঘনা ও পদ্মার জল একটি অপরটির সাথে মিশতো না। মেঘনার জলকে দেখা যেতো অপক্ষাকৃত স্বচ্ছ আর পদ্মার জল খানিটা ঘোলা। এই মোহনায় আসলেই মনে হতো মহা সাগরের বুকে ছোট্ট ভেলায় ভাসছি আমরা। যেখানে নদীর কুল কিনারা নাই। দূর থেকে তিন নদীর মোহনায় লঞ্চঘাট দেখে যাত্রীরা নড়ে চড়ে ওঠতেন, এইতো চাঁদপুর বড় ষ্টেশন ঘাট বুঝি এসে গেলো। পদ্মা-মেঘনার মিলিত স্থান থেকে বাঁ দিকে ডাকাতিয়া নদীর মুখেই ছিলো চাঁদপুর লঞ্চ টার্মিনাল ও রেলওয়ে স্টেশন। চাঁদপরে ডাকাতিয়া নদীতে প্রবেশ মাত্রই উপলব্ধি হতো এইতো আমরা আমাদের গ্রামের বাড়ি চলে এসেছি।
নদীর দুতীর তখন খুবই কাছাকাছি। লঞ্চের যাত্রী হিসাবে মনে হতো ডাকাতিয়া নদীতে আমাদের লঞ্চটি বৃহৎ কোন জল দানব, যেটি বীরদর্পে এগিয়ে চলেছে। আর পেছনে ফেলে আসা ডাকাতিয়া নদীর দু পাশের তীর সংলগ্ন ক্ষেত গুলো লঞ্চের ঢেউয়ে তলিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সেই ঢেউয়ের জলে অনাবিল আনন্দে খেলা করছে। লক্ষ্য করতাম পাশ্ববর্তী দু কুলের মাটির মানুষগুলো যেন অবাক বিস্ময়ে দেখছে যান্ত্রিক জলযানে আমাদের সেই এগিয়ে চলা। ইচলী, নানুপুর, বাগড়া বাজার পার হলেই অদূরে দেখা যেতো আমাদের গ্রামের ঐতিহ্যবাহী চান্দ্রা ইমাম আলী হাই স্কুল। এই স্কুল থেকেই আমার আব্বা ১৯৫৫ সালে মেট্রিক পাশ করেছিলেন।
অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের লঞ্চ মদনের গাঁও গাংগুইল্যা বাড়ির গুদাড়া ঘাটে পৌছে যেতো। সময় তখন দুপুর আড়াইটা-তিনটা। ছোট মামা,কলের ঘরের খুশি মামা, ভুলু ভাই সহ আরো অনেকেই আমাদের জন্য গুদাড়া ঘাটে অপেক্ষা করতেন।
গুদাড়া ঘাট থেকে ক্ষেতের আইল দিয়ে পাঁচ-ছয় মিনিট হেঁটে মাঝি বাড়ি আর পাটোয়ারী বাড়ির মাঝ দিয়ে যখন নানা বাড়ি পৌঁছাতাম তখন দেখতাম আমাদের প্রান প্রিয় “নানু” আমাদের আগমনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। খাঁ বাড়ির দক্ষিন পশ্চিম কোণে পুকুর ধারে খাল পাড়ের তালগাছ তলায় তিনি আমাদেরকে বরণ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। অল্পদুর থেকে আমরাও লক্ষ্য করতাম ঐ যে শ্বেত শুভ্র সুতি শাড়ী পরিহিত আমাদের নানু। কাছে আসা মাত্রই তিনি আমাদেরকে জড়িয়ে ধরে পরম আদরে চুমু খেতেন। যেন সে এক মহা মিলন।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, শেরেবাংলা নগর গভঃ বয়েজ হাই স্কুল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন।