ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

বাজেট ২০২৩-২৪

‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ সামাজিক প্রবৃদ্ধি আনবে আসন্ন বাজেট: অধ্যাপক সেলিম

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:২০ পিএম, ২৮ মে ২০২৩ রবিবার | আপডেট: ০৪:৫০ পিএম, ২৯ মে ২০২৩ সোমবার

আসন্ন বাজেটে কৃষি শিক্ষা ও ব্যবসায় সহায়ক নীতির পাশাপাশি নির্বাচনমূখী ‘অন্তর্ভূক্তিমুলক’ সামাজিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে জোর দেয়া হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সেলিম উদ্দিন।  

নিম্ম মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের বাংলাদেশের আসন্ন উত্তোরনে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে দীর্ঘমেয়াদে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে ডেল্টাপ্লান –২১০০ এর আলোকে ব্লু ইকোনমির খাতগুলোকে কাজে লাগিয়ে সুনীল অর্থনীতি ‘ব্লু গ্রোথ’ অর্জনে রূপরেখা এখনই সামনে আসতে পারে বলে ধারনা দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ।  

বর্তমানে অধ্যাপক সেলিম দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের নির্বাহী পর্ষদের প্রধান হিসেবে।  

তিনি এক সাক্ষাৎকারে ডক্টর সেলিম বলেন, কৃষি শিক্ষা ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্পবান্ধব বাজেট আমাদের উন্নয়নগুলোকে টেকসই করে তুলবে। তাই আমাদের গ্রীন প্রবৃদ্ধির দিকে নজর রাখতে হবে।  

বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর দীর্ঘসুত্রিতার কমাতে ‘পরিবীক্ষন ও নীরিক্ষা’ বিভাগের সক্ষমতা বাড়ানো সহ পেশাজীবিদের অন্তর্ভূক্তির পরামর্শ অধ্যাপক সেলিমের, যিনি একজন এফসিএ(ফেলো চ্যাটার্ড একাউন্টেন্ট)।  
করোনা মহামারী থেকে উত্তরণের সময় শেষ না হতেই রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের অস্থির বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ দশমিক ৫৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষিত হতে যাচ্ছে। যেখানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির প্রাক্কলনের সম্ভাবনা যথাক্রমে ৭ দশমিক ৫ এবং ৬ শতাংশ।  

সামষ্টিক অর্থনীতির নির্দেশকগুলো যখন চাপে, তখন বাংলাদেশের উন্নয়নশীল অর্থনীতির যাত্রায় এবারের বাজেট কেমন হবে, ধারনা পাওয়া যাবে অধ্যাপক সেলিম উদ্দিনের সাক্ষাৎকারে। এখানে চুম্বক অংশ উল্লেখ করা হলো।  

# সামগ্রিকভাবে নির্বাচনের বছরে বাজেট কি রকম হবে বলে আপনি মনে করেন?  
অধ্যাপক সেলিমঃ আপনি জানেন যে কোভিড থেকে উত্তরণের সাথে সাথে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে পুরো বিশ্বে প্রায় সকল পণ্যদ্রব্যের মূল্য উস্ফলন আকাশচুম্বী হয়েছিলো এবং বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা অনেকটাই সুখকর ছিলো না বা অনেক ক্ষেত্রে ভেঙে পড়েছিলো। তারই প্রেক্ষিতে সারা বিশ্বের প্রায় দেশেই মুদ্রাস্ফীতি চরম আকার ধারন করে এবং বৈশ্বিক জীবনযাত্রা ব্যায় সংকটের (cost of living crisis) মধ্যে পড়ে।  

বাংলাদেশের আমদানি যেহেতু রপ্তানির তুলনায় বেশির কারণে উচ্চমূল্যে পণ্য আমদানীর সাথে সাথে মুদ্রাস্ফীতিও আমদানি হয়। যার কারণে মুদ্রাস্ফীতি অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে যায় এবং অস্বাভাবিক মূল্যে আমদানি করা পণ্যের মূল্য রপ্তানি ও রেমিটেন্স থেকে সঙ্কুলান না হওয়ায় এবং সারা বিশ্বে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ডলার অপ্রতুলতা দেখা দেয়।  

সারা বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় মুদ্রাস্ফীতি তুলনামূলক কম বৃদ্ধি পেলেও বাংলাদেশের নিম্নআয়ের জনগণ জীবনযাত্রায় ব্যায় নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছে। তাই আমি মনে করি, এই বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যতধরনের কলাকৌশল আছে তার বাস্তবায়নে দিক নির্দেশনা থাকবে।  

নিম্নআয়ের মানুষকে এই অস্থির সময়ে স্বস্তি দেয়ার জন্য টিসিবির মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে বিক্রি অব্যাহত রাখা এবং ডিলারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধির প্রত্যাশা করি। সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দে উপকারপ্রাপ্তির সংখ্যা ও ভাতা বৃদ্ধিসহ উপকারভোগী যাতে সরাসরি ভাতা পেতে পারেন তার জন্য আরো বেশি ডিজিটালাইজেশনের নির্দেশনা থাকবে।  

তাই বাজেটে গ্রামীন অর্থনীতিতে আরো বেশি চাঙ্গা করার লক্ষ্যে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি আকারের ব্যবসায়ে পুনঃ অর্থায়ন, সল্পসুদে ঋণসহ নানাবিধ প্রণোদনা কর্মসূচী চলমান থাকা এবং আরো বেশি সহায়তা করলে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।  

গ্রামীন অর্থনীতির মস্তবড় স্তম্ভ আমাদের কৃষিখাত–যেটাকে অব্যহত সাবসিডি দিয়ে সরকার খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র দূরীকরণের মত অসংখ্য প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সুবিধা আমাদের অর্থনীতিতে অনবরত ধনাত্বক প্রভাব ফেলছে।  
কৃষিখাতে সাবসিডিসহ কৃষিখাত সম্প্রসারনে প্রচার প্রচারনা, প্রণোদনা, প্রোটেকশন, সল্পসুদে কৃষিঋণ, কৃষিপন্য পরিবহন, কৃষি বাজারজাতকরনে সব ধরনের অন্যায় প্রতিবন্ধকতা দুর করতে সুষ্ঠ নীতিকৌশল এই বাজেটে বলিষ্টভাবে গুরুত্বপাবে।

কৃষি উপকরন ও কৃষি যন্ত্রীকরনের সকল যন্ত্রপাতি সহজলভ্য করে কৃষি সম্পর্কিত পন্যের উৎপাদনে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সুস্পষ্ট প্রস্তাবও এই বাজেটে সবিশেষ গুরুত্ব পাবে। আগামী বাজেটে অগ্রাধিকারমূলক উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অর্থায়নের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব পাবে। আমি মনে করি অগ্রাধিকারমূলক উন্নয়ন প্রকল্পগুলো এমনভাবে বাছাই করা উচিত যেগুলোর বাস্তবায়ন প্রায় শতভাগের কাছাকাছি।, যে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে জনগণ তথা অর্থনীতিতে সাথে সাথে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। এবং যে প্রকল্পগুলো অধিক কর্মসংস্থানে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।  

এই বাজেটে আরেকটি উল্লেখযোগ্য খাত হলো রাজস্ব আহরন প্রচেষ্টা এবং একথা এখন সবার মুখে মুখে যে – ঘাটতি হ্রাস তথা অভ্যান্তরীন সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা। আমাদের কর-জিডিপির অনুপাত দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অনেক কম। সুতরাং রাজস্ব আয় বাড়ানো ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। এই প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে কৌশলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ডেলে সাজাতে হবে। যেমন করনীতি, কর ধার্যকরন, কর আদায়, কর জরিপ ইত্যাদি বিভাগগুলোকে স্বাধীন সত্তার মধ্যে আনতে হবে।  

এনবিআরের অটোমোশন অনেকদিনের এজেন্ডা। কিন্তু ডিজিটালাইজেশনে এনবিআর উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে আছে। এমন কি ইএফডি (ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস) সহ নানা যন্ত্রপাতি ক্রয়ে এনবিআরের অনীহা এবং দীর্ঘসূত্রিতা অনুসন্ধানপূর্বক তড়িৎ ব্যবস্থা জরুরী। কর-জিডিপি হার বাড়াতে নতুন নতুন করদাতা খুজে বের করে করজালে আনার পরামর্শ ও বাজেট বক্তৃতায় এর সরব পরিফূস্টন প্রায় অনেক বছর যাবত শুনে আসছি, কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে এর বাস্তবায়ন ও সুফল আমরা পাচ্ছি না।  

বাজেট বাস্তবায়ন ও বাজেটের আকারের বৃদ্ধির সাথে সাথে কর-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী এবং জাতীর রাজস্ব বোর্ডকে যথাযথ সহায়তার মাধ্যমে কর্ম ক্ষমতা ও কর্ম পরিধির ব্যপারে বাস্তবায়নযোগ্য নীতি কৌশল বাজেটে প্রত্যাশা করি। নির্বাচনের বছরে বাজেট হিসেবে এই সরকার অবশ্যই নতুন কোন ধরনের সস্তা জনপ্রিয়তা, অনুতপাদনশীলখাত এবং অপচয় মানের কোন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করবে না, এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।  

সর্বশেষ, এই বাজেটের প্রতিটি বরাদ্দে সরকার অনেক সতর্কতা অবলম্বন করবেন যাতে কোণ বরাদ্দকৃত অর্থ অপচয় না হয়ে উৎপাদনশীলখাতে হয়। দারিদ্র দুরীকরনে সহায়তা, পরিবেশ রক্ষায় সচেষ্ট হয় এবং জন কল্যান ও জনমূখী ব্যাবসায় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির তাগিদ থাকবে। তবে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং – বাজেট বাস্তবায়ন নচেৎ বাজেটের উদ্দেশ্য ব্যত্যয় হবে।  

## অর্থনীতির নির্দেশকগুলো চাপে আছে, এমনটা বলা হচ্ছে। উত্তরণের পথ কেমন হওয়া উচিত  
অধ্যাপক সেলিমঃ আমি আগেই বলেছি – কোভিড, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক বাণিজ্য অবরোধ (স্যাংশন) ইত্যাদি কারনে আমাদের বহিঃখাত – আমদানি, রপ্তানি ও রেমিটেন্স সম্পর্কিত সূচকগুলো সরাসরি চাপে বা অস্বস্তিতে পড়েছে। বহিঃখাতকে কেন্দ্র করে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব, ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদিতে প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ না হওয়ায় সামষ্টিক অর্থনীতির প্রায় সূচক করোনা মহামারী পুর্ববর্তী অবস্থার মত স্থিতিবস্থায় নেই। অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহ, কর কাঠামোর গতিশীল পরিবর্তন যাতে জীবনযাত্রার ব্যায় হ্রাস হয়, ব্যবসা বাণিজ্য তথা শিল্পের উৎপাদন উৎসাহিত হয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি সহায়ক উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সঠিক সময়ে বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা, গতিশীল সরবরাহ ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, যেমন শিল্পের কাঁচামাল আমদানি, ঋণ প্রবৃদ্ধি ( মানি সাপ্লাই) ইত্যাদিতে বেশি কঠোরতা না করে সহনশীল ও মধ্যবর্তী কৌশল নেয়া, অহেতুক চাহিদাকে নিয়ন্ত্রন করা, অনুৎপাদনশীলখাতকে নিরুৎসাহিত করা, শিল্পে উৎপাদন অবিচল রাখার স্বার্থে  জ্বালানি সরবরাহ, রপ্তানি ও কৃষিখাতগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া, জনকল্যান সামাজিক নিরাপত্তা ও সল্পমূল্যে পন্য বিতরনসহ ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি ব্যাবসয় বাণিজ্যগুলোকে অগ্রাধিকার গ্রামীন অর্থনীতি চাঙ্গা হবে।  

গ্রামীন অর্থনীতি চাঙ্গা হলে চাহিদা বৃদ্ধি পাবে যার ফলে সরবরাহ বৃদ্ধিতে ব্যবসা বাণিজ্য শিল্পের গতি বৃদ্ধি পাবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর্মসংস্থান অটূট থাকবে এবং বৃদ্ধি পাবে। একই ভাবে সামষ্টিক অর্থনীতির যে সূচকগুলো চাপে আছে , সেগুলোতে আস্তে আস্তে স্থিতিশীলতা আসবে। অর্থাৎ অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ – দুই ধরনের নীতি কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে সক্ষম হবে দেশ। উল্লেখ্য যে, সরকার ইতোমধ্যে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে বৈশ্বিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকিমুক্ত করতে অনেক কলা কৌশল ও নীতি বাস্তবায়ন করছে এবং পদক্ষেপ চলমান আছে।  

# আসন্ন বাজেটে মূল্যস্ফীতি, ডলারের মূল্য ধরে রাখতে কি ধরনের নীতি প্রয়োজন  
অধ্যাপক সেলিম:
পূর্ববর্তী প্রশ্নগুলোতে মূল্যস্ফীতির উৎস সম্পর্কে মোটামুটি পর্যালোচনা করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি হ্রাস এবং নিয়ন্ত্রনের জন্য যে সকল কারনের জন্য মূল্যস্ফীতি ঘটে থাকে সে উৎসগুলো চিহ্নিত করে গতিশীল কৌশিল নীতি এবং হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতিকে হ্রাস এবং নিয়ন্ত্রন করতে হবে। উল্লেখ্য যে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি তথা মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রা ব্যয় হ্রাসকরণ আগামী বাজেটের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।  

মূল্যস্ফীতি হ্রাস ও নিয়ন্ত্রণের অনেকগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যবস্থা, নীতি ও কৌশল প্রয়োগ করা যায়। তার একটি সংক্ষিপ্ত সুপারিশ বিবেচনাযোগ্য হতে পারে। যেমন খাদ্য, নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপন্য এবং এসব উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট কাঁচামালে শুল্ক হ্রাস এবং অহেতুক অশুল্ক বাধা দূরীকরণ, নিরবিচ্ছিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় পন্য সরবরাহে জড়িত ব্যবসা শিল্পগুলোকে উৎপাদনে সহায়তা, অকরযোগ্য আয়সীমা বৃদ্ধি, কৃষিপন্যের নিরবিচ্ছিন্ন উৎপাদনে সাবসিডি, কৃষি উপকরন, কৃষি যন্ত্রপাতি, কৃষিপন্য বাজারজাতকরণের অন্যায় প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ, মার্কেটিং ইন্টেলিজেন্সকে শক্তিশালী করে পন্য মূল্য মনিটরিং, মূল্য অনিয়মে কঠোর ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদের ব্যবস্থা, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপন্যের সরবরাহ তথা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে ব্যবস্থাদির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দিক নির্দেশনা সহ যথাসময়ে গুরুত্বারোপ ও তথ্যাদি প্রকাশ করা, ডলারের বিনিময় মূল্য স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহন, প্রবাসী আয় প্রেরণে দলিলপত্র সহজীকরণ, প্রণোদনা বৃদ্ধির ব্যবস্থা, স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহনে প্রবাসী আয় বাড়বে, জ্বালানী মূল্য বৃদ্ধি না করে কিভাবে নিম্ন আয়ের জণগোষ্ঠীকে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি দেয়া যায় সে ব্যবস্থা করা, অর্থ সরবরাহে মনিটরিং বাড়ানো যেনো দীর্ঘদিন অর্থ আটকে থাকবে এমন সরকারি ব্যয় পরিহার করা।  

রপ্তানি পন্য উৎপাদন ও সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখাসহ অনেকগুলো সরাসরি এবং পরোক্ষ ব্যবস্থাদি গ্রহন করলে মূল্যস্ফীতি হ্রাসকল্পে সহায়ক হবে। ডলারের মূল্য ধরে রাখার জন্য বহিঃখাত – আমদানী-রপ্তানী ও প্রবাসী আয়েখাতগুলোকে বিচক্ষণতা এবং দূরদৃষ্টির আলোকে নীতি কৌশলের বাস্তবায়ন করতে হবে। বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসকল্পে রপ্তানী বহুমুখীকরণ, এবং অপ্রয়োজনীয় আমদানী পরিহারে সচেষ্ট হবে। প্রবাসী আয় সংক্রান্ত পুরো প্রক্রিয়া পুনঃরায় পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে।  

আমাদের আমদানি রপ্তানি ও প্রবাসী আয়, সেবাখাতে প্রাথমিক আয়, মূলধন হিসাব ও আর্থিক হিসাবগুলোর বিগত মাসগুলোতে প্রবৃদ্ধি পর্যালোচনায় সহজে অনুমেয় যে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে উল্লেখিত দফাগুলোতে স্থিতিশীলতা আসবে এবং ডলারের বিনিময় মূল্যেও স্থিতিশীলতা বিরাজ করবে। সরকার ইতোমধধ্যে মুদ্রা ও আর্থিক অর্থনীতিতে অনেকগুলোন নীতিকৌশল বাস্তবায়ন করেছে যেগুলোর সুফল ডলারের রিজার্ভ ও মূল্যে ক্রমান্বয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। ডলার সাশ্রয়ে নীতিকৌশলগুলো, যেমন – বিদেশ ভ্রমনে কড়াকড়ি, বাণিজ্যিক ব্যাংকে ডলার ধারণ হ্রাস, ডলার বিনিময় ব্যবসায় অনৈতিকতার জন্য সতর্কবার্তা বিষয়গুলো প্রনিধানযোগ্য।  

# এডিপির বাস্তবায়ন ও নিরীক্ষা যেভাবে হচ্ছে, একজন এফসিএ হিসেবে আপনার বিশ্লেষণ কি?  

অধ্যাপক সেলিম: চলতি বছরে এডিপি নানা অস্থির কারনে বিশেষ করে পণ্য সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কারনে এবং বৈশ্বিক টালমাটাল পরিস্থিতির জন্য সরবরাহ বিঘ্ন ঘটায় হয়তো সন্তোষজনক হচ্ছে না। কিন্তু আমরা যদি দীর্ঘ ধারাবাহিক এডিপি বাস্তবায়নের হার দেখি, সেটা সন্তোষজনক নয়। আবার বাস্তবায়ন হার মাসিক বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে দেখলে বাস্তবায়নে হারে অসমানুপাতিক হার লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত প্রথম ছয়মাসে দেখা যায় ২০-২৫ শতাংশ ও পরের তিন মাসে এবং অর্থবছরের শেষ মাসে প্রচুর প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। এতে করে কাজের গুনগত মান, অর্থের অপচয়, প্রকল্পের উদ্দেশ্য সব ক্ষেত্রে ঋণাত্বক প্রভাব পড়ে।  

একজন প্রফেশনাল একাউন্টেন্ট হিসেবে আমি মনে করি যে, প্রকল্প বাস্তবায়ন, মনিটরিং এবং নীরিক্ষায় যথেষ্ট সক্ষমতার এবং  জড়িত লোকজনের আন্তরিকতার অভাব সুস্পষ্ট। কেননা প্রকল্প পরিকল্পনা, ডিজাইন, বাস্তবায়ন এক কথায় কাগজে কলমে সুন্দরভাবে সাজানো থাকলেও নানাবিধ অন্যায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে প্রায় প্রতিটি প্রকল্প ব্যয়ধিক্য ও বাস্তবায়নে সময়োত্তীর্ণ  হওয়াটা স্বাভাবিক নিয়মে পরিনত হয়েছে। অথচ জাইকার প্রকল্পে উল্টো চিত্র দেখা যায়। সেখানে প্রাক্কলিত ব্যয় থেকে অনেক ক্ষেত্রে কম ব্যয় এবং বাস্তবায়ন সময়ের আগেই সম্পন্ন হয়।  

আমার মতে, মনিটরিং এবং নিরীক্ষা – এই দুটো বিভাগ যাতে স্বাধীনভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে পরীক্ষা, নীরিক্ষা এবং অনুসন্ধান করে বিঘ্নিত ব্যবস্থার সুপারিশ করার ক্ষমতাসহ প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নানাবিধ কর্মকৌশল নিতে হবে। উল্লেখিত বিষয়ে (মনিটরিং এবং নিরীক্ষা) প্রফেশনাল ব্যাক্তিদের অন্তর্ভূক্তি করতে হবে যাতে প্রকল্পের ব্যয়াধিক্য ও সময়সীমার ঝুঁকি নির্নয়, প্রকল্প বাস্তবায়নের ধারাবাহিক তথ্য ব্যবস্থাপনা (রিয়েল টাইম ভিত্তিতে), ভিডিও মনিটরিং, অনলাইন মনিটরিং, মাসিক ভিত্তিতে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কঠোরভাবে পালন করে তার ভিত্তিতে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ, একদল কর্মকর্তা বা বিশেষ শ্রেণীর কর্মকর্তার উপর অত্যাধিক নির্ভরশীলতা হ্রাস বাস দূরীকরণ, প্রতিটি ক্ষেত্রে ঝুঁকি হ্রাসে পোর্টফোলিও এবং ডাইভারসিফিকেশন (বহুমাত্রীকরন) পদ্ধতিগুলোর সহায়তাসহ একই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সবাই যাতে কার্যক্রমে সমসুযোগ পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।  

আমাদের জানা উচিত, দেশী বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট, ব্যবসায় ব্যয় হ্রাস, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান, অন্তর্ভূক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে প্রতি বছরই বাজেটে সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ দেয়া হয়। আমি মনে করি ব্যয়ের গুনগতমান, বাস্তবায়ন সময়, মোট প্রকল্প ব্যয় –ইত্যাদির উপর সঠিক গুরুত্বারোপ করে সঠিক ব্যয়ে, সঠিক সময়ে এবং সঠিক গুনে ও মানে প্রকল্প কার্য সমাপ্তের জন্য সঠিক মানদন্ড নিশ্চিত করতে হবে।  

এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এক দেশ বা অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত না করে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের প্রতিষ্ঠানসমূহকে সমসুযোগ প্রদান করলে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক ঝুঁকি হ্রাস করা যায়। চলমান বৃহৎ প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের হার সময় সময় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জনসমক্ষে প্রচারের ব্যবস্থা থাকা উচিত। যেমন –বাংলাদেশে দৈনিক কতটুকু বা কত কিলোমিটার রাস্তা সম এককে তৈরী হচ্ছে, দৈনিক কত কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে (সম এককে) এরকম তথ্যগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা থাকলে বাস্তবায়নে জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে। 

কেআই//