ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

‘একমাত্র ভাইকে ফিরে পাবো তা কোনোদিন ভাবিনি’

কালকিনি (মাদারীপুর) প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১০:২২ এএম, ২ জুন ২০২৩ শুক্রবার

সাখাওয়াত হোসেন মামুন। বাবা মোঃ ফরিদ হোসেন। বাবা ছিলেন আনসারের অফিসার। দুই বোন এক ভাই। পরিবারে কোনো অভাব ছিল না। ছেলে মামুনকে পড়াশোনার জন্য ভারতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে বেশিদিন পড়াশুনা না করে চলে আসেন দেশে। ইচ্ছা হয় বিদেশে যাওয়ার। বাবা-মা কিছুতেই বিদেশ পাঠাবেন না। কিন্তু একমাত্র ছেলের আবদারের কাছে হেরে গিয়ে তার ইচ্ছামতো ২০০৭ সালে টুরিস্ট ভিসায় পাঠান ইয়েমেনে।

সেখানে কিছুদিন থাকার পর অন্য দেশে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে প্রথমে একটি কোম্পানিতে ভালো কাজ পাওয়ায় থেকে যান ইয়েমেন।

কয়েক বছর যেতেই ইয়েমেনে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। যুদ্ধে তিনি দেশে আসতে চাইলেও নানা কারণে আসতে পারেননি। থেকে যেতে হয় তাকে।

এরপর ওই কোম্পানির মালিক মারা যাওয়ার পর তাকে বিক্রি করা হয় অন্য একটি কোম্পানিতে। সেখানে তার পাসপোর্টসহ সব কাগজপত্র জমা দিয়ে কাজ নিতে হয়। একদিকে যুদ্ধ অন্যদিকে মালিকের অমানবিক অত্যাচারে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন মামুন। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

এভাবে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকেন মামুন। দেশে তার বাবা-মা, বোনসহ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ভেবে নেন যুদ্ধে হয়তো মারা গেছেন তিনি। সেই শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন তার বাবা। ২০১৬ সালে মারা যান ফরিদ হোসেন।

দীর্ঘ বছরপর হঠাৎ একদিন মামুন তার মা শাহনুর বেগমের মোবাইলে ফোন দেন। হঠাৎ ফোনে ছেলের কণ্ঠ শুনতে পেয়ে আনন্দে কাঁদতে শুরু করেন তিনি। তার ছেলে বেঁচে আছে, এর থেকে আনন্দ আর কী হতে পারে। আবারও হয়ে যায় যোগাযোগ বিছিন্ন। এরপর কয়েক মাস পর মায়ের কাছে ফোন আসে ছেলের। 

এভাবেই ১৬ বছর পর দেশে ফেরেন মামুন, মা ফিরে পান তারা ছেলেকে।

মামুন বলেন, "আমি ইয়েমেনের সানা এয়ারলাইন্সে ক্লিনারের কাজ করেছি কিছুদিন। একদিন গৃহযুদ্ধে এয়ারপোর্টটি ধ্বংস হয়ে হয়। তখন সেখান থেকে চলে যাই দমত নামের একটি গ্রামে। সেখানে একটি গ্যাস কোম্পানিতে কাজ শুরু করি। সেখানে একটি দুর্গের মতো ঘরে থাকতাম। সেই ঘরটি যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর একটি বিল্ডিংয়ের ছাদে থাকতাম। একদিন সন্ধ্যায় কাজ শেষ করে ঘরের বাইরে গোসল করতে যাই, ফিরে আসার সময় জানতে পারি ওই বিল্ডিং বোমা মেরে ধ্বংস করা হয়েছে। 

সেসময় আমাকে বিদ্রোহীরা ধরে নিয়ে যায়। তখন আমি যেখানে কাজ করতাম সেই কোম্পানির মালিক মো. মাহদী আল আইদী আমাকে তিনদিন পর ছাড়িয়ে আনেন।

কথা বলতে বলতে আবেগপ্রবণ হয়ে মামুন বলেন, এরপর ইয়েমেনের এশমা শহরে চলে আসি। সেখানে কিছুদিন কাজ করি। হঠাৎ জানতে পারি এখানে হামলা হতে পারে। তাই আমরা কয়েকজন মিলে হুসনা পাহাড়ে আশ্রয় নেই। সেখানে থাকা অবস্থায় সাপে কামড় দেয়। তখন আমি পাহাড় থেকে ছুটে মালিকের বাসায় এসে তাকে ঘটনাটি বলি। পরে মালিক আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করান। পর পর তিনটি হাসপাতালে আমার চিকিৎসা চলে এবং আমি তিনদিন অজ্ঞান হয়ে থাকি। পরে আল্লাহর রহমতে সুস্থ হই। 

আবার শুরু হয় আমার জীবন সংগ্রাম। একটি মোবাইলও ছিল না আমার। শুধুমাত্র মায়ের নম্বরটা মুখস্ত ছিল। তবে মাঝে মধ্যে মায়ের নম্বরও ভুলে যেতাম। আজ যে দেশে ফিরতে পেরেছি, এটাই আমার জন্য পরম আনন্দ। মনে হচ্ছে যেন আমি নতুন জীবন পেলাম।”

মামুনের ছোট বোন ফারজানা আক্তার মুন্নি বলেন, “একমাত্র ভাইকে ফিরে পাবো তা কোনোদিন ভাবিনি। এটা যে কত আনন্দের তা কাউকে বোঝানো যাবে না। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে চাকরি করেন তার শ্যালক সায়িদ প্রায় ১৫ বছর তুরস্কে আটকা পড়েছিলেন। সায়িদ তুরস্ক থেকে ইয়েমেনে আসেন। সেখান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মামুন নামে একজনের কাছে আশ্রয় নেন সায়িদ। ওই মামুনের সঙ্গে আমার ভাই মামুনের যোগাযোগ ছিল। ওই মামুন যখন ইয়েমেন যান তখন আমার ভাই তাকে সহযোগিতা করেছেন। মামুনের সহযোগিতায় সায়িদ তার কাগজপত্র ঢাকায় তার দুলাভাইয়ের কাছে পাঠান। তখন সেই কাগজপত্রের মধ্যে আমার ভাইয়ের ছবি ভুল করে চলে আসে। তখন সায়িদের দুলাভাই এই ছবি কার জানতে চান। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মামুন তখন তাকে আমার ভাই মামুনের সব ঘটনা খুলে বলেন। সব শুনে তিনি আমার ভাইয়ের কাছ থেকে আমার নম্বর নেন। তারপর তার কথা মতো আমার ভাইয়ের জন্মসনদ, নাগরিক সনদ ও পাসপোর্টের ফটোকপি (দেশে ছিল) পাঠাই। তিনিই সব ব্যবস্থা করেন। আমার ভাইয়ের মানসিক সমস্যা থাকায় দেশে আসার আগে পাঁচ মাস মানসিক হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করান। সেখানে চিকিৎসা শেষে মানসিকভাবে একটু সুস্থ হলেই ১৭ মে সকালে বাংলাদেশে এসে পৌঁছান। ইউএনডিপির সহযোগিতায় চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরতে পেরেছেন আমার ভাই।”

মামুনের মা শাহানুর বেগম বলেন, “বিদেশে আমার ছেলে এত কষ্ট করেছে, তা আর মনে করতে চাই না। মনে করলেই বুক ফেটে কান্না আসে। আমার ছেলে আমার কাছে ফিরে এসেছে, এটাই বড় কথা। তবে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই ইউএনডিপিসহ সকলকে। যারা আমার ছেলের আসার ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন।”

এএইচ