মিষ্টিতে ৭৫ ভাগই ভেজাল
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৬:৪২ পিএম, ৬ জুন ২০২৩ মঙ্গলবার
বৃহস্পতিবার (১ জুন) অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পেশ করা বাজেটে মিষ্টির ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করেছেন। এর ফলে দেশে সব ধরনের মিষ্টির দাম কমার কথা।
কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, বাজারে এখন যত খাদ্যপণ্য রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভেজাল রয়েছে মিষ্টিতে। তাই বাজেটে দাম কমানো পণ্যটি খেলে নির্ঘাত নানা রকম জটিল রোগে আক্রান্ত হতে হবে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষক ও চিকিৎসকরা।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট প্রতি বছর দেশের বাজার থেকে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখে। ২০২২ সালেও সারা দেশ থেকে ১ হাজার ৫১১টি নমুনা সংগ্রহ করে। এর মধ্য থেকে ১ হাজার ১৩৩টি নমুনা পরীক্ষা করে দেখা হয়। সম্প্রতি সেসব পণ্যের পরীক্ষার তথ্য প্রস্তুত করে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটির নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ৭৫ শতাংশ ভেজাল মিলেছে সব ধরনের মিষ্টিতে। যেমন : চমচম, কালোজাম এবং রসগোল্লায় মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর নানা উপকরণ মিলেছে।
অসাধু ব্যবসায়ীরা মিষ্টিসহ মানুষের প্রতিদিনকার বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে ক্ষতিকর বিষাক্ত উপকরণ মিশিয়ে তৈরি করছে। এসব পণ্য কয়েক হাত ঘুরে আসছে ভোক্তার কাছে। এগুলো খেয়ে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে নানারকম জটিল ও কঠিন রোগে। ভেজাল খাদ্য খেয়ে রোগে ভোগে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু হচ্ছে অনেকের।
দেখা গেছে, বাজারের কোনো পণ্যে ৭৫ শতাংশ ভেজাল, কোনোটিতে ৬৬ শতাংশ, আবার কোনোটিতে ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ ভেজাল। দেশের মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্যপণ্য গম-আটা-ময়দাতেও ভেজাল মিলেছে ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তবে চালে ভেজাল বা ক্ষতিকর কোনো উপাদান এ বছর মেলেনি। সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ভেজালের ভিড়ে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে মিষ্টি জাতীয় পণ্য। যেমন : চমচম, রসগোল্লা, কালোজাম, দই, ঘি, গুড়, মধু। আবার তিন বেলা যেসব খাদ্য খাচ্ছে মানুষ তার অনেক উপকরণেও ভেজাল। যেমন : গম, আটা, ডাল, আটা, লবণ, সয়াবিন তেল, হলুদ, মরিচ। এমনকি শিশুখাদ্যও রেহাই পাচ্ছে না ভেজালকারীদের হাত থেকে। শিশুখাদ্য গুঁড়া দুধেও মেশানো হচ্ছে নানারকম বিষাক্ত কেমিক্যাল।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট প্রতি বছর সারা দেশের বাজার কিংবা দোকান থেকে খাদ্যপণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে। সম্প্রতি গত বছরের পণ্যের নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে মিষ্টিতে ভেজালের হার আরও বেড়েছে। আগের বছর মিষ্টিতে ভেজাল ৫০ শতাংশ, আর এবার হয়েছে ৭৫ শতাংশ।
ভেজালের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সব ধরনের ঘি। এই পণ্যে ভেজালের হার ৬৬ শতাংশ। আগের বছর ঘিতে ভেজালের হার ছিল ৫০ শতাংশ। ভেজালের দিক দিয়ে এর পরই আছে আরেক নিত্যপণ্য গুঁড়া হলুদ। এতে ভেজালের হার ৩৩.৭৩ শতাংশ। এরপরই রয়েছে গুড়। এতে ভেজালের হার ৩৩.৩৩ শতাংশ। এরপর বেসনে ভেজালের হার ২৫ শতাংশ।
গণস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারের পণ্যের নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন তথ্য অনুযায়ী গুঁড়া মরিচে ভেজালের হার ১৬.৯৮ শতাংশ। এ ছাড়া নারিকেল তেল/অলিভ অয়েল ১১.৬০ শতাংশ, লবণে ১০.৫০ শতাংশ, আটা/গম/ভুট্টায় ৫.৫৬ শতাংশ, ধনিয়াতে ৫.৪১ শতাংশ, সয়াবিন তেলে ৩.৮৫ শতাংশ, সরিষার তেলে ২.৯৯ শতাংশ এবং সব ধরনের ডাল ও ছোলাতে ভেজালে হার ২.৩৮ শতাংশ।
এসব খাদ্যপণ্যে অনেক রকম বিষাক্ত উপাদান মেশানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে টেক্সটাইল কেমিক্যাল ও টেক্সটাইল রং। এ ছাড়া ইউরিয়া, হাইড্রোজ, কার্বাইড, ফরমালিন, প্যারাথিয়ন মেশানো হয় বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে। বেকারি কারখানায় উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্য সতেজ রাখতে ফ্যাটি অ্যাসিড, ইমিউসাইল্টিং টেক্সটাইল রং। এ ছাড়া এসব পণ্যে নিম্নমানের আটা, পচা ডালডা, তেল এবং ডিমের ব্যবহার করা হয়।
মসলায় মেশানো হয়, কাপড়ের বিষাক্ত রং, দুর্গন্ধযুক্ত পটকা মরিচের গুঁড়া, ধানের তুষ, ইট ও কাঠের গুঁড়া, মোটর ডাল ও নিম্নমানের সুজি। দীর্ঘ সময় সতেজ রাখার জন্য দুধে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন। এ ছাড়া পানি গরম করে তাতে অ্যারারুট মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নকল দুধ। শুধু তাই নয়, নকল দুধ তৈরিতে ছানার ফেলনা পানি, ময়লাযুক্ত পানি, থাইসোডা, পার-অক্সাইড, ময়দা ভাতের মাড় ও চিনি মেশানো হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেক্সটাইল রং ও কেমিক্যাল খাদ্য বা পানীয়ের সঙ্গে মিশে মানব শরীরে প্রবেশের পর এমন কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই যার ক্ষতি করে না।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন প্রফেসর আ ব ম ফারুক গণমাধ্যমে বলেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে লিভার, কিডনি, হৃৎপিণ্ড ও অস্থিমজ্জার। এসব অঙ্গ শিশু ও বৃদ্ধদের নষ্ট হয় দ্রুত। তরুণদের নষ্ট হয় কিছুটা দেরিতে। খাদ্যে ভেজালের কারণে শরীরে বিভিন্ন রকমের ক্যানসার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেলিউর, হাঁপানি বেড়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, কেমিক্যাল মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণের কারণে শরীরে বেশ কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। এর মধ্যে আছে পেটেব্যথা, বমি হওয়া, মাথাঘোরা, পাতলা পায়খানা হওয়া, বদ হজম হওয়া, শরীরে ঘাম বেশি হওয়া, শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং হঠাৎ করে পালস রেট কম-বেশি হওয়া।
জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মোরশেদ আলম বলেন, বিভিন্ন মেটাল বেইজড ভেজাল খাদ্যে কিডনি স্বল্পমাত্রা থেকে সম্পূর্ণ বিকল হতে পারে। আমাদের দেশে কিডনি রোগী বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ এই ভেজাল খাদ্য। বিশেষ করে শিশু কিডনি রোগী বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ভেজাল খাদ্য। এ ছাড়া ভেজাল খাদ্য গ্রহণের জন্য মানুষ আরও যেসব জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তার মধ্যে আছে-অ্যালার্জি, অ্যাজমা, চর্মরোগ, বমি, মাথা ব্যথা, অরুচি, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, লিভার সিরোসিসসহ অনেক জটিল রোগে।
এমএম//