ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

নামে কোমল হলেও কোমল পানীয় প্রকৃতপক্ষে তরল বিষ!

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৩:৩০ পিএম, ১২ জুন ২০২৩ সোমবার

কোমল পানীয় একটি তরল বিষ, যা পৃথিবীজুড়ে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নামে কোমল হলেও হিংস্রতায় কঠিন এই পানীয়টি হতে পারে কিডনি রোগ, স্থূলতা, ফ্যাটি লিভার ডিজিজ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারের কারণ। কীভাবে?

ফ্রিজে চার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা তার কম তাপমাত্রায় কোনো তরল দীর্ঘক্ষণ রাখলে তা জমে বরফ হয়ে যায়। কিন্তু কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংকসের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে না। কারণ এগুলোতে এন্টি-ফ্রিজার হিসেবে মেশানো হয় একটি রাসায়নিক উপাদান – ইথিলিন গ্লাইকল।

এটি মানবদেহের জন্যে স্বল্পমাত্রার আর্সেনিকের মতোই বিষ। মূলত শিল্পকারখানায় ব্যবহারযোগ্য হলেও বর্ণ ও গন্ধহীন স্বচ্ছ এ উপাদানটি বিভিন্ন পানীয়ে এন্টি-ফ্রিজার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে হরদম। গবেষকদের মতে, ইথিলিন গ্লাইকল মানবদেহে নীরব বিষক্রিয়া ঘটায়। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, হৃৎপিণ্ড, লিভার, কিডনির জটিলতা এমনকি দীর্ঘমেয়াদে কিডনি বৈকল্য পর্যন্ত ঘটাতে পারে এ উপাদান।

ইথিলিন গ্লাইকলের পাশাপাশি কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংকসে মেশানো হয় কিছু কৃত্রিম রঙ, যেমন : টারট্রাজিন, কারমোসিন, ব্রিলিয়ান্ট ব্লু, সালফেট ইয়েলো ইত্যাদি। নরওয়ে সুইডেন ফিনল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে এগুলো বিক্রয় নিষিদ্ধ । কারণ এ উপাদানগুলো ক্যান্সার সৃষ্টির জন্যে দায়ী।

কোমল পানীয় এসিডিক বা অম্লীয় (pH ২.৪ থেকে ২.৮ এর মধ্যে)। ফলে দীর্ঘদিন পান করলে তা দাঁত ও হাড়সহ শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতিসাধন করে। ঝাঁঝালো স্বাদের জন্যে এতে মেশানো হয় ফসফরিক এসিড, যা দাঁতের এনামেল আর শরীরের হাড়ের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত। পরীক্ষায় দেখা গেছে, কোমল পানীয় ভর্তি বোতলে একটি দাঁত ফেলে রেখে দিলে তা ১০ দিনের মধ্যে পুরোপুরি গলে যায়। ব্রিটিশ ডেন্টাল এসোসিয়েশনের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, প্রতিবার কোমল পানীয় গ্রহণের প্রায় একঘণ্টা পর্যন্ত দাঁতের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব বজায় থাকে।

নিয়মিত কোমল পানীয় পানের ফলে শরীর থেকে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান মূত্রের সাথে বেরিয়ে যায়। ফলে বাড়তে থাকে হাড়ক্ষয়ের সম্ভাবনা এবং হাইপোথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড গ্লান্ডের কার্যকারিতা কমে যাওয়া)।

কোমল পানীয় এক ধরনের আসক্তি সৃষ্টি করে। এর প্রধান কারণ উচ্চ মাত্রার ক্যাফেইন। এই ক্যাফেইন মাদকের মতোই আসক্তিকর। এজন্যে এগুলো একবার পান করলে বার বার পান করতে ইচ্ছে হয়। অতিরিক্ত ক্যাফেইন শরীরের স্বাভাবিক হৃদস্পন্দনকেও বাধাগ্রস্ত করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন গর্ভপাত, নির্দিষ্ট সময়ের আগে প্রসব, কম ওজনের সন্তান প্রসব ও গর্ভস্থ শিশুর জন্মগত ত্রুটি ঘটানোর মতো জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়াও মূত্রাশয় ও পাকস্থলীর ক্যান্সারসহ কমপক্ষে ছয় ধরনের ক্যান্সার ও উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম কারণ এই অতিরিক্ত ক্যাফেইন।

গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, কোমল পানীয়কে সুস্বাদু করার জন্যে প্রতি বোতল কোমল পানীয়তে মেশানো হয় গ্লুকোজ, সুক্রোজ, ফ্রুকটোজ ইত্যাদি সুগার, যার পরিমাণ প্রায় ৩৭ গ্রাম বা প্রায় ১০ চা চামচ চিনির সমান। আর রক্তে যে পরিমাণ সুগার থাকে তার পরিমাণ মাত্র এক চা চামচ চিনির সমান।

ফলে দেখা যাচ্ছে, এক বোতল বা এক ক্যান কোমল পানীয় পানের ফলে রক্তে সুগারের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় প্রায় ১০ গুণ। এই অতিরিক্ত চিনি বা সুগার স্থূলতা, ফ্যাটি লিভার ডিজিজ, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, গলব্লাডারে পাথর, উচ্চ রক্তচাপ এবং অকালমৃত্যুর কারণ হতে পারে।

সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, এসব চিনিযুক্ত পানীয় বা সুগারি ড্রিংক কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। বলা হচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের কোলা, সোডা বা চিনিযুক্ত পানীয় যারা নিয়মিত পান করেন, তাদের কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে ৩৩% বেশি।

একালের প্রখ্যাত মার্কিন গবেষক, বক্তা ও টিভি ব্যক্তিত্ব মার্ক পেন্ডারগ্রাস্ট। ২০০০ সালে প্রকাশিত তার একটি বই ফর গড় কান্ট্রি এন্ড কোকাকোলা। দীর্ঘ অনুসন্ধান ও গবেষণার ভিত্তিতে রচিত এ বইটিতে কোকাকোলাসহ অন্যান্য কোমল পানীয়ের অনেক অজানা দিক উন্মোচন করেন পেন্ডারগ্রাস্ট। তিনিই প্রথমবারের মতো বলেন, কোকাকোলার ফর্মুলায় এলকোহলের উপস্থিতি রয়েছে। তার ভাষায়, 'শিশুরাও মদ খাচ্ছে! কারণ মা-বাবারা তাদের হাতে কোকের গ্লাস তুলে দিচ্ছেন'।

মার্ক পেন্ডারষ্ট্রাস্টের মতে, কোকাকোলার আরেকটি উপাদান গ্লিসারিন। কোকাকোলা কোম্পানিও তাদের পানীয়ে গ্লিসারিন থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন নি। গ্লিসারিন হচ্ছে তেল ও চর্বির উপজাত, যা ব্যবহৃত হয় সাবান তৈরিতে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারে প্রচলিত কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংকস-সহ সব ধরনের প্রক্রিয়াজাত পানীয় এবং প্যাকেটজাত ও বোতলজাত জুস—সবই আসলে কমবেশি একই উপাদান দিয়ে তৈরি। আর এসব পানীয়তে বর্ণ, গন্ধ ও প্রিজারভেটিভ হিসেবে যা ব্যবহৃত হয়, তার অধিকাংশই মানবদেহের জন্যে ক্ষতিকর ও নীরব ঘাতক। তাই ফাস্ট ফুড বা জাংক ফুড, কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংকস, প্যাকেটজাত বা বোতলজাত জুস পুরোপুরি পরিহার করুন। আপনি সুস্থ থাকবেন ও দীর্ঘজীবী হবেন।

এসবি/