ঢাকা, শনিবার   ০২ নভেম্বর ২০২৪,   কার্তিক ১৮ ১৪৩১

বিভিন্ন দেশ ইউক্রেনকে নতুন আর কীধরনের অস্ত্র দিচ্ছে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৪:২৮ পিএম, ১৩ জুলাই ২০২৩ বৃহস্পতিবার

রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য নেটোর সদস্য দেশগুলো দেশটিকে আরও অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ পাঠানোর কথা বিবেচনা করছে।

ইউক্রেনকে সবচেয়ে বেশি সামরিক সহায়তা দেয় আমেরিকা – তালিকায় এর পরেই আছে ক্রমান্বয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ), জার্মানি আর যুক্তরাজ্য।

ইউক্রেনকে কী পরিমাণ সামরিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে তার হিসাব রাখে কিয়েল ইন্সটিটিউট, তবে এই সংস্থায় তথ্যউপাত্তের যে হিসাব রয়েছে তা মে মাসের শেষ পর্যন্ত দেওয়া দানের হিসাব। এরপর আমেরিকা ইউক্রেনের জন্য নতুন এক থোক সামরিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে, যার পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলার।

আমেরিকা আরও নিশ্চিত করেছে যে তারা ইউক্রেনকে ক্লাস্টার বোমা দেবে, যা একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ এবং যা নিয়ে নেটো জোটের কিছু কিছু সদস্য দেশের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে।

ইউক্রেন ফ্রান্সের কাছ থেকেও ক্ষেপণাস্ত্র পাবে – যা যুক্তরাজ্য থেকে সম্প্রতি পাঠানো স্টর্ম শ্যাডোস ক্ষেপণাস্ত্রের সমতুল্য।

ট্যাংক

ইউক্রেনকে ইতোমধ্যেই কয়েক ডজন ট্যাংক দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। ইউক্রেন বলছে তাদের এলাকাগুলো সুরক্ষার এবং রুশ সৈন্যদের পেছু হঠানোর জন্য এগুলো জরুরিভাবে প্রয়োজন।

আমেরিকা পাঠাচ্ছে তাদের ৩১টি অ্যাব্রামস্ ট্যাংক
যুক্তরাজ্য দিচ্ছে ১৪টি চ্যালেঞ্জার-টু ট্যাংক
জার্মানি পাঠাচ্ছে ১৪টি লেপার্ড-টু ট্যাংক
স্পেন তাদের লেপার্ড-টু ট্যাংক থেকে ছয়টি ইউক্রেনকে দিচ্ছে

ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ লেপার্ড-টু ট্যাংক ব্যবহার করে থাকে। এই ট্যাংকের ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ তুলনামূলকভাবে সহজ বলে মনে করা হয়। এছাড়াও এই ট্যাংক অন্য পশ্চিমা ট্যাংকগুলোর তুলনায় জ্বালানি ব্যবহার করে কম।

রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর প্রথম কয়েক মাস সামরিক জোট নেটোর সদস্য দেশগুলো ইউক্রেনকে পুরনো ট্যাংক সরবরাহ করাই সঠিক মনে করেছে। এসব ট্যাংক সাবেক ওয়ারস চুক্তির অধীনে ব্যবহার করা হয়েছিল।

ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী জানে কীভাবে এগুলো চালাতে হয়, কীভাবে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। এছাড়াও এইসব ট্যাংকের যথেষ্ট যন্ত্রাংশ ইউক্রেনের কাছে ছিল।

আধুনিক পশ্চিমা ট্যাংকগুলো ব্যবহারের দিক দিয়ে অনেক বেশি জটিল এবং সেগুলোর দেখভাল করাও কঠিন।

রাশিয়ার অবস্থানের ওপর ইউক্রেনের সাম্প্রতিক হামলার একটি ফুটেজ থেকে দেখা যাচ্ছে অন্তত একটি লেপার্ড ট্যাংক এবং বেশ কয়েকটি ব্র্যাডলি ট্যাংক ইউক্রেন বাহিনী ইতোমধ্যেই যুদ্ধে ব্যবহার করেছে।

নেটো জোটের মধ্যে যুক্তরাজ্য এ ব্যাপারে প্রথম পথ দেখিয়ে তাদের প্রধান যুদ্ধ ট্যাংক চ্যালেঞ্জার-টু ইউক্রেনকে দেবার প্রস্তাব করেছে।

চ্যালেঞ্জার-টু ট্যাংক তৈরি করা হয় ১৯৯০এর দশকে। কিন্তু ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর হাতে অন্য যেসব ট্যাংক আছে সেগুলোর তুলনায় চ্যালেঞ্জার-টু অনেক বেশি উন্নত ও আধুনিক।

রুশ আক্রমণের আগে ইউক্রেন ওয়ারস প্যাক্টের অধীনে ডিজাইন করা টি-সেভেন্টিটু ট্যাংক ব্যবহার করত। ২০২২এর ফেব্রুয়ারির পর পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র এবং ছোট ছোট আরও কয়েকটি দেশ থেকে ইউক্রেন ২০০-র বেশি টি-৭২ ট্যাংক পেয়েছে।

আমেরিকা ইউক্রেনে ৩১টি অ্যাব্রামস ট্যাংক পাঠানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই ট্যাংককে "পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ট্যাংক" বলে বর্ণনা করেন।

তিনি বলেন ইউক্রেনিয় সৈন্যরা যাতে অবিলম্বে এই ট্যাংক ব্যবহার করতে পারে তার জন্য আমেরিকা তাদের এখনই প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করবে, কিন্তু কবে নাগাদ আমেরিকা আদতে সেই ট্যাংক সরবরাহ করবে তা এখনও অস্পষ্টই রয়ে গেছে।

ইউক্রেনের সৈন্যরা গ্রীষ্ম মরশুম শেষ হবার আগেই অ্যাব্রামস ট্যাংক ব্যবহার করার প্রশিক্ষণ শেষ করবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং আমেরিকান সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ওই সময় নাগাদ ট্যাংকগুলো ইউক্রেনে পৌঁছবে এমন মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।

সাঁজোয়া যুদ্ধ যান

সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন ধরনের ব্যাপক সামরিক সরঞ্জাম, সেগুলো সম্বন্বিতভাবে মোতায়েন করা এবং সেগুলো কার্যকর রাখার জন্য প্রয়েজনীয় সবরকম রসদ ও ব্যবস্থা তৈরি রাখা।

বহু ধরনের যেসব সাঁজোয়া যান ইউক্রেনকে দেয়া হয়েছে তার মধ্যে একটি হল স্ট্রাইকার যান। আমেরিকা নিশ্চিত করেছে যে তারা ইউক্রেনে ৯০টি স্ট্রাইকার সাঁজোয়া যান পাঠাচ্ছে।

আমেরিকা ইউক্রেনকে অন্যান্য আরও যেসব লড়াইয়ের যানবাহন দান করেছে তার মধ্যে রয়েছে ব্র্যাডলি পদাতিক যুদ্ধ যান। আমেরিকান বাহিনী ইরাক যুদ্ধে এই সাঁজেয়া যান ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিল।

বিমান প্রতিরক্ষা

ডিসেম্বর মাসে আমেরিকা আরও ঘোষণা করে যে তারা ইউক্রেনে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা পাঠাচ্ছে এবং তারপর জার্মানি আর নেদারল্যান্ডসও একই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠানোর কথা ঘোষণা করে।

অত্যন্ত অত্যাধুনিক এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাল্লা ৬০ মাইল বা ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত, তবে সেটা নির্ভর করে কী ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য ইউক্রেনিয় সৈন্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন এবং সেটা সম্ভবত দেওয়া হবে জার্মানিতে আমেরিকার একটি সেনা ঘাঁটি ব্যবহার করে।

তবে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ – একটি প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা চালু রাখতে খরচ পড়ে প্রায় ৩ মিলিয়ন ডলার।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেন রুশ আক্রমণ প্রতিহত করতে সোভিয়েত যুগের ভূমি থেকে আকাশে ব্যবহারযোগ্য এস-৩০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থ ব্যবহার করছে।

লড়াই শুরু হবাার আগে ইউক্রেনের কাছে প্রায় ২৫০টি এস-৩০০ ছিল এবং অন্যান্য সাবেক সোভিয়েত দেশগুলো থেকে একই ধরনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম এনে মজুদ রাখার উদ্যোগ নিয়েছিল ইউক্রেন। এরকম বেশ কিছু সরঞ্জাম ইউক্রেন নিয়ে এসেছিল স্লোভাকিয়া থেকে।

আমেরিকা ইউক্রেনকে নাসাম (ন্যাশানাল অ্যাডভান্সড সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেম) ক্ষেপণাস্ত্রও দিয়েছে। উন্নত প্রযুক্তির ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য এই নাসামগুলো ইউক্রেনে পৌঁছেছে নভেম্বর মাসে।

পাশাপাশি, ব্রিটেনও ইউক্রেনকে বেশ কয়েক ধরনের বিমান প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে স্টারস্ট্রিক। এই ব্যবস্থা ব্যবহার করে কাছাকাছি পাল্লার মধ্যে নিচু দিয়ে ওড়া বিমান গুলি করে ভূপাতিত করা যায়।

স্টারস্ট্রিক ক্ষেপণাস্ত্র 

জার্মানিও ইউক্রেনকে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে আইরিস-টি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যার সাহায্যে ২০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত ধেয়ে আসা ক্ষেপণাস্ত্রে আঘাত হানা যায়।

দূর পাল্লার কামান

আমেরিকা ইউক্রেনে দূর-পাল্লার যেসব রকেট লঞ্চার পাঠিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে দ্রুত গতিতে কামান দাগার উপযোগী রকেট ব্যবস্থা বা হিমার্স। একই ধরনের রকেট লঞ্চার পাঠিয়েছে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ।

ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে রুশ সৈন্যকে পেছু হঠতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে ইউক্রেন বাহিনীর সাফল্যের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে হিমার্স- বিশেষ করে নভেম্বর মাসে খেরসনের লড়াইয়ে।

হিমার্স ব্যবস্থা অনেক বেশি নির্ভুলভাবে কাজ করে এবং রুশরা যে স্মের্চ ব্যবস্থা ব্যবহার করছে তার থেকে আরও দীর্ঘ পাল্লায় কাজ করতে সক্ষম হিমার্স।

হাউয়িৎজার

রুশ হামলা শুরুর এবং এরপর কিয়েভ থেকে রাশিয়ার পশ্চাদপসরণের পরের কয়েক মাস, যুদ্ধ মুলত কেন্দ্রীভূত ছিল দেশটির পূর্বাঞ্চলে। সেসময় ইউক্রেনের জন্য কামানের চাহিদা ছিল খুবই বেশি।

যেসব দেশ তখন ইউক্রেনে এম৭৭৭ হাউয়িৎজার কামান এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করেছে তাদের মধ্যে ছিল অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা এবং আমেরিকা।

রাশিয়া যে গিয়াটসিন্ট-বি হাউয়িৎজার ব্যবহার করে, এম৭৭৭-এর পাল্লা ঠিক একইরকম, তবে রাশিয়ার ডি-৩০ বন্দুকের নল থেকে এম৭৭৭এর বন্দুক অনেক বেশি লম্বা।

নেটো দেশগুলো বলছে তারা কামানের গোলার সরবরাহ আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে, কারণ ইউক্রেন গোলা ব্যবহার করছে অনেক দ্রুতগতিতে এবং নতুন সরবরাহ পৌঁছনর অনেক আগেই তাদের গোলা ফুরিয়ে যাচ্ছে।

তারা তাদের দেশের ভেতর স্থানীয় গোলা প্রস্তুতকারকদের উৎপাদন আরও বাড়াতে বলছে।

ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র

হাজার হাজার এন-ল অস্ত্র ইউক্রেনকে সরবরাহ করা হয়েছে, যেগুলো থেকে একটা মাত্র গুলি ছুঁড়ে ট্যাংক ধ্বংস করা যায়।

রাশিয়ান হামলা শুরুর পরবর্তী দিন ও ঘণ্টাগুলোয় কিয়েভে রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রা ঠেকাতে এই অস্ত্র বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিল।

ড্রোন

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে এ পর্যন্ত ড্রোন ব্যবহার হয়েছে খুবই বেশি। বহু ক্ষেত্রে ড্রোন ব্যবহার হয়েছে নজরদারির কাজে, লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করতে এবং ভারি সরঞ্জাম তোলার কাজে।

তুরস্ক ইউক্রেনের কাছে বায়রাকটার টিবিটু সশস্ত্র ড্রোন বিক্রি করেছে। ইউক্রেনকে সাহায্য করতে জনগণের দেওয়া অর্থে তুরস্কের ড্রোন প্রস্তুতকারকরা ড্রোন তৈরি করে সেগুলো ইউক্রেনকে দিয়েছে।

বায়রাকটার ড্রোন

বিশ্লেষকরা বলছেন বায়রাকটার টিবিটু ড্রোন অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। এই ড্রোন প্রায় ২৫,০০০ ফুট উঁচু পর্যন্ত উড়ে নিচে নেমে এসে রুশ লক্ষ্যবস্তুর ওপর লেজার নিয়ন্ত্রিত বোমা দিয়ে আঘাত হেনেছে।

জঙ্গী বিমান কি দেয়া হয়েছে?

ইউক্রেনের জঙ্গী বিমান পাঠানোর অনুরোধ আমেরিকা বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে, বরং এ যাবত তারা অন্যান্য সামরিক সাহায্য পাঠানোর বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছে।

তবে, মে মাসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেন যে আমেরিকা ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক জঙ্গী জেট বিমান দেবে, যার মধ্যে থাকবে আমেরিকায় তৈরি এফ-১৬ জঙ্গী বিমান। আমেরিকা ইউক্রেনের পাইলটদের এই বিমান চালানোর প্রশিক্ষণও দেবে।

আমেরিকার এই ঘোষণা অন্যান্য দেশকেও তাদের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ইউক্রেনে পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করবে। কারণ আমেরিকার মিত্র দেশগুলো আমেরিকার কাছ থেকে যে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান কিনেছিল সেগুলো অন্য দেশে পুনর্রপ্তানি করতে হলে আমেরিকার অনুমোদনের প্রয়োজন।

ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ফ্রান্স এবং ডেনমার্ক এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে এবং বলেছে তারাও সমর্থন জোগাবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এসবি/