ডেঙ্গু নিয়ে ভুল ধারণা কোনগুলি?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:৪৮ এএম, ২৫ জুলাই ২০২৩ মঙ্গলবার
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তার মূলত ২০০০ সাল থেকেই। গেলো দুই যুগে অনেকটাই বদলেছে এই জ্বরের প্রকৃতি ও লক্ষণ। তবে সেইসাথে বেড়েছে চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা ও মানুষের সচেতনতাও। তারপরেও এখনো কিছু ক্ষেত্রে সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে, রয়েছে বিভ্রান্তি ও ভুল ধারণা। যার কারণে বাড়ছে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার। চলুন জেনে নিই ডেঙ্গু বিষয়ে কী কী ভুল ধারণা কথা জানিয়েছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ।
ডেঙ্গু জ্বর মানেই খুব মারাত্মক রোগ এবং ডেঙ্গু জ্বর হলে বেশিরবাগ রোগী মারা যায়, এই ধারণা একেবারেই ভুল। সময়মতো চিকিৎসা করা হলে সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত প্রায় ১০০ ভাগ রোগীই ভালো হয়ে যায়। বলছেন িএবিএম আবদুল্লাহ।
তিনি বলেন, “মৃত্যুঝুঁকি তাদের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে, যারা অবহেলা করে সময়মতো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় না।”
অনেকে মনে করেন জ্বর কমে গেলেই বিপদ কেটে গেল। এটিও ভুল ধারণা।
এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, “মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু জ্বরে মারাত্মক সমস্যা হওয়ার সময় আসলে এটাই। এ সময় প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যায় এবং রক্তক্ষরণসহ নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। জ্বর কমে যাওয়ার পরবর্তী কিছু দিনকে তাই বলা হয় ‘ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড’। এ সময়টাতেই সবারই সচেতন থাকা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। অন্তত রক্তের সিবিসি ও প্লাটিলেট পরীক্ষা করা উচিত। কারণ, এখন ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ অনেক বেশি।”
ডেঙ্গু আক্রান্ত মা সন্তানকে বুকের দুধ পান করাতে পারবেন না- এটিও ভুল ধারণা। মায়ের বুকের দুধে এই ভাইরাস থাকে না। কাজেই আক্রান্ত অবস্থায় মা বাচ্চাকে তার বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই বলে জানান এ বি এম আবদুল্লাহ।
ডেঙ্গু ছোঁয়াচে রোগ নয়। কাজেই ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে এক বিছানায় শোয়া, একসঙ্গে থাকা, খাওয়া বা রোগীর ব্যবহার্য সব জিনিস পরিবারের অন্য সদস্যরা ব্যবহার করতে পারবেন। এতে তাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই।
তবে মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু আক্রান্ত কোনো রোগীকে অন্য কোনো মশা কামড়ালে তার মুখে ভাইরাসটি কিছুক্ষণ থাকে, যদি ঐ মশা সঙ্গে সঙ্গে অন্য কোনো ব্যক্তিকে কামড়ায়, তাহলে ডেঙ্গু হতে পারে।
ডেঙ্গুেআক্রান্ত অবস্থায় অন্য অপারেশন করানো যাবে কিনা এমন প্রশ্নে এ বি এম আবদুল্লা বলেন “একেবারে অপরিহার্য না হলে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় অপারেশন না করানোই ভালো। এতে অনিয়ন্ত্রণযোগ্য রক্তপাত, এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিও রয়েছে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত সব রোগীর ক্ষেত্রেই ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা উচিত, ডেঙ্গুতে সাময়িকভাবে ব্লাড সুগার বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া নিয়মিত ব্লাড প্রেশার পরীক্ষা করাতে হবে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর বা ব্যথা কমানোর জন্য শুধু প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধই যথেষ্ট, এসপিরিন বা অন্য কোনো ব্যথানাশক ওষুধ কোনোভাবেই খাওয়া যাবে না, এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়বে। এছাড়া যেহেতু ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগ, এতে এন্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই। তবে মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্য ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগও থাকতে পারে, যেমন টাইফয়েড ফিভার বা অন্য কোনো ইনফেকশন, যার জন্য এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করলে এন্টিবায়োটিক দিতে পারেন। অনেকে মনে করেন, ডেঙ্গুতে এন্টিবায়োটিক ক্ষতি করতে পারে এবং তা পরিহার করতে হবে, যা একটি ভুল ধারণা। ডেঙ্গুতে এন্টিবায়োটিক কোনো ক্ষতি করবে না। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হলে মাংসে ইনজেকশন দেওয়া যাবে না। এতে হিমাটোমা হতে পারে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির যদি রক্তক্ষরণ না হয় এবং রোগীর রক্তের হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক থাকে, তবে রক্ত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে রক্ত দিলে লাভ তো হবেই না, বরং অন্য কমপ্লিকেশন এমনকি হার্ট ফেইলিউরও হতে পারে বলে জানান এ বি এম আবদুল্লাহ।
প্লাটিলেটের বিষয়ে তিনি বলেন, “বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্লাটিলেট দেওয়ার কোনো প্রয়োজন হয় না। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় ও তাড়াহুড়ো করে প্লাটিলেট দেওয়ায় হেপাটাইটিস বি অথবা সি, এমনকি এইচআইভি দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বারবার প্লাটিলেট দিলে রক্তে এর বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি হতে পারে। তাই অপ্রয়োজনে প্লাটিলেট দিলে লাভ না হয়ে বরং ক্ষতি হতে পারে। কাজেই প্লাটিলেট দেওয়ার জন্য রোগী ও চিকিৎসকের অযথা ব্যতিব্যস্ত হওয়ার বা চিন্তার কোনো কারণ নেই।”
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ভিন্ন সেরোটাইপ আছে, তাই চার বার ডেঙ্গু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ডেঙ্গু ভাইরাসের যে কোনো একটি সেরোটাইপ দ্বারা এক বার আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার পর ভবিষ্যতে সেই সেরোটাইপ দ্বারা আর আক্রান্ত হয় না। কারণ শুধু সেই সেরোটাইপে রোগীর আজীবন প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠে। কিন্তু বাকি তিনটি প্রজাতি দ্বারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ঠিকই রয়ে যায়। তবে কেউ যদি পৃথকভাবে ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ দ্বারা জীবনে চার বার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে বাকি জীবনে আর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কথা নয় বলে জানান এ বি এম আবদুল্লাহ।
গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে বলেও জানান তিনি।
এসবি/