ক্যান্সার প্রতিরোধে তামাক নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৪:১৭ পিএম, ২ আগস্ট ২০২৩ বুধবার
‘ক্যান্সার’ নামক প্রাণঘাতি অসংক্রামক রোগটির সাথে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য সেবনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মূলত, ‘তামাক’ একটি নিরব মহামারী। তামাক বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবন ও পরিবেশ-প্রকৃতির অপূরণীয় ক্ষতি করেই চলেছে। তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে বছরে ৮ মিলিয়ন (৮০ লক্ষাধিক) মানুষ প্রাণ হারায়। বিশেষত: উন্নয়নশীল ও দারিদ্র পীড়িত দেশগুলোতে তামাকজনিত রোগ-বালাই, মুত্যুহার ও অন্যান্য ক্ষতি উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বেশি।
তামাক সেবন প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু এবং ক্যান্সারসহ অনেক দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যয়বহুল রোগের প্রধান কারণ। যা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ এবং অর্থনীতির জন্য বোঝাস্বরুপ। তামাকজাত দ্রব্য সেবনের ফলে অসংক্রামক রোগের (ক্যান্সার ও হৃদরোগ, ষ্ট্রোক, ডায়াবেটিস ইত্যাদি) প্রকোপ দিনদিন বেড়েই চলেছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, তামাকের ব্যবহারের ফলে ফুসফুস, মুখ, খাদ্যনালী, গলা, মূত্রাশয়, কিডনি, লিভার, অগ্ন্যাশয়, কোলন, মলদ্বার এবং মহিলাদের জরায়ুর ক্যান্সার সহ তীব্র মাইলয়েড লিউকেমিয়া এবং বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার হতে পারে। সব মিলিয়ে ২৭ শতাংশ ক্যান্সারের ক্ষেত্রে তামাক সেবনকে দায়ী করা হয় এবং ৯০ শতাংশ ফুসফুস ক্যান্সারের ক্ষেত্রেই প্রধান অনুঘটক ‘তামাক’। অর্থাৎ-তামাক সেবন/ধূমপান বর্জন করলে ৯০ শতাংশ ফুসফুস ক্যান্সার এড়ানো সম্ভব।
১৯৫০-২০০০ সময়কালে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে ৯০ শতাংশ পুরুষ এবং ৭০ শতাংশ নারী ধূমপায়ী! তাছাড়া ধূমপায়ী মহিলাদের স্তন ক্যান্সার ও সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের হারও অনেক বেশি। এর পেছনে পরোক্ষ ধূমপানও দায়ী। আমাদের দেশের বিরাট একটি জনগোষ্ঠি পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। গ্যাটস্-২০১৭ এর তথ্যমতে, বাড়িতে ৪ কোটি ১০ লক্ষ এবং গণপরিবহন ও জনসমাগম স্থলে ৩ কোটি ৮৪ লক্ষ মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার ও স্বাস্থ্যগতভাবে মারাত্নক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্যান্সারের উর্ধ্বগতির পেছনে পরোক্ষ ধূমপান বড় ভূমিকা রাখছে। সুতরাং, পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি থেকে অধূমপায়ী জনগণকে সুরক্ষা প্রদান করতে হবে। সেক্ষেত্রে তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিত ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইন ও নীতির বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরী। পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের তামাকজাত দ্রব্য সেবন থেকে বিরত রাখতে হবে। শিশু-কিশোররা যাতে তামাক সেবনে আসক্ত না হয় এবং পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতির শিকার না হয় সেজন্য অভিভাবক ও বয়োজেষ্ঠ্যদের সজাগ থাকতে হবে।
চলমান করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর চাইতে তামাকের কারণে মৃত্যুহার অনেক গুণ বেশি! করোনা সংক্রমণের বিগত ২৬ মাসে বাংলাদেশে প্রাণহানী ঘটেছে ২৮,৩৩৯ জনের (০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)। অথচ, তামাকের কারণে বছরে প্রাণহানি ঘটে প্রায় ১ লক্ষ ৬২ হাজার (টোব্যাকো এ্যাটলাস-২০১৮)। সুতরাং, করোনার চাইতে বড় মহামারি এখন ‘তামাক’। ‘ক্যান্সার’ এ মহামারী বৃদ্ধির বড় উপাদান।
পৃথিবী ব্যাপী চলমান ‘করোনা মহামারী’র চাইতে ‘তামাক মহামারী’ বহুগুণ শক্তিশালী হলেও ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ’ পৃথিবীর অনেক দেশে এখনও ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না, এর ভয়াবহতা অনুসারে ঠিক যতটা গুরুত্ব পাওয়ার দাবী রাখে। বাংলাদেশেও একই অবস্থা। এজন্যই মূলত, তামাকজনিত ক্ষয়-ক্ষতি ও অকালমৃত্যু রোধ কাঙ্খিত মাত্রায় সম্ভব হচ্ছে না। পক্ষান্তরে, তামাক কোম্পানিগুলো দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঘাঁটি গেঁড়ে বসছে। এর উদাহরণ বা উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশের নাম বলা যায়। ২০১৮ সালে ‘জাপান টোব্যাকো কোম্পানি-জেটিআই’ বাংলাদেশে ‘ফরেইন ইনভেস্টমেন্ট’ এর নামে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা তামাক ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছে। যা সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যমাত্রা’র সাথে সাংঘর্ষিক।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় বিদেশী বিনিয়োগ দরকার আছে। তাই বলে, জনস্বাস্থ্য উপেক্ষা তামাকের ব্যবসায় বিনিয়োগ যে লাভ বয়ে আনবে তার চেয়ে ক্ষতির পাল্লা ঢ়ের ভারী করবে, একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। ২০১৮ সালে আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি সংস্থা পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ঐ বছরে ১ লক্ষ ২৬ হাজার মানুষ তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হয় ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০টির মধ্যে ১টি অধিক তামাক ব্যবহারকারী জনগণের দেশ। মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৩৫.৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লক্ষ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে (গ্লোবাল এ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে -গ্যাটস্-২০১৭)। সুতরাং উন্নয়নের নামে জনস্বাস্থ্য হানীকর ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর দ্রব্যের ব্যবসায় বিনিয়োগে আদতে হিতে বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি করবে যার অজস্র উদাহরণ রয়েছে।
আরেকটা উদ্বেগের কারণ, বাংলাদেশে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার অতিমাত্রায় বেশি- ৪৮ শতাংশ, যা উচ্চবিত্তের মধ্যে ২৪ শতাংশ। শহরে ২৯.৯ শতাংশ এবং গ্রামে ৩৭.১ শতাংশ (গ্যাটস্ ২০১৭)। করোনা মহামারীর এ দু:সময়ে বিরাট এ জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়েই গেছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে তামাক ব্যবহার বেশি হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ- তামাকজাত দ্রব্যের সস্তামূল্য, সহজপ্রাপ্যতা, তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ইত্যাদি। অন্যদিকে, আমাদের দেশে নারীদের মধ্যে ধোঁয়াবিহীন তামাক (জর্দা, গুল, সাদাপাতা, খৈনী ইত্যাদি) সেবনের প্রবণতা বেশি। গ্যাটস্-২০১৭ এর তথ্যমতে, ২০.৬ শতাংশ মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য সেবন করেন। ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্য (বিশেষত: চিবিয়ে খাওয়া তামাক) মুখের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ক্ষতিকর। ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত পণ্যে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন রাসায়নিক থাকে। বিশেষ করে N-nitrosamines (TSNAs) যেটাকে মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় এবং মুখের বিভিন্ন ধরনের ক্ষত বাড়িয়ে তুলে তার মধ্যে ‘মলিগন্যান্ট’ অন্যতম।
বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছরে অসংক্রামক রোগে ৪ কোটি মানুষ মুত্যুবরণ করে, যা বৈশ্বিক মোট মৃত্যুর ৭১ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘এনসিডি কান্ট্রি প্রোফাইল-২০১৮’ অনুসারে, বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে বছরে মারা যায় ৫ লাখের বেশি মানুষ। অপর এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ২০ লাখ মানুষ ক্যান্সারে, ২০ শতাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ও ১০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন। বছরে অন্যান্য বিভিন্ন রোগে নতুন করে আরও ৫০ হাজার যোগ হচ্ছে। এমন ধারা অব্যাহত থাকলে আমাদের সামগ্রীক উন্নয়নে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, অসুস্থ জনগণ পরিবার ও রাষ্ট্রের বোঝা স্বরুপ।
জনস্বাস্থ্য বিষয়ক আইন ও নীতির যথাযথ প্রয়োগের অভাব, জনগণের মধ্যে অসচেতনতা, পরিবেশ দূষণ, খাদ্যে ভেজালসহ নানান কারণে আমাদের সিংহভাগ জনগণ ক্যান্সারসহ বিভিন্ন প্রাণঘাতি ও ব্যয়বহুল রোগের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। অন্যদিকে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চিকিৎসা নির্ভরতার কারণে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা খুব কমই গুরুত্ব পায়। যা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য খাতের বিপদ ডেকে আনতে পারে। শুধুমাত্র অবকাঠামোগত উন্নয়ন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে যথার্থ নয়, একথা সরকারের নীতি নির্ধারকদের আমলে নিতে হবে। সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে জনগণের নেতিবাচক আচরণগত অভ্যাস পরিবর্তন (যার মধ্যে তামাক/মাদক সেবন অন্যতম), ভেজালমুক্ত নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের যোগান নিশ্চিত, পরিবেশ সুরক্ষা ও উন্নয়ন, পরিবেশ ও জনবান্ধব অবকাঠামোগত উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ- যত দ্রুত সম্ভব রোগের চিকিৎসার চাইতে প্রতিরোধে অধিক গুরুত্ব দিয়ে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে।
আগামী দিনে একটি সুস্থ-সবল জাতি পেতে হলে রোগ নিয়ন্ত্রণ তথা- রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে যে রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো রয়েছে- অস্বাস্থ্যকর জীবন-যাপন অর্থাৎ- তামাক/নেশাজাত দ্রব্য সেবন অন্যতম। সুতরাং, ক্যান্সারসহ অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত আইন/নীতির কার্যকর বাস্তবায়নের দিকে নজর দিতে হবে।
জনসচেতনতায় অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ‘তামাক নিয়ন্ত্রণকে’ এ মূহুর্তে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। তাই দ্রুত দেশব্যাপী ‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি’র আওতায় তামাক নিয়ন্ত্রন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। যা মাননাীয় প্রধানমন্ত্রী’র ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ প্রত্যয় বাস্তবায়ন ও ক্যান্সারসহ অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে জোরালো ভূমিকা পালন করবে। নেশাজাত দ্রব্য পরিহার ও স্বাস্থ্যকর জীবন-যাপনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে বর্তমান প্রজন্ম ভবিষ্যতে পরিবার ও রাষ্ট্রের বোঝা না হয়ে সুস্থ মানব সম্পদে পরিণত হবে।
এমএম//