সঠিক জীবনদৃষ্টি হৃদরোগ নিরাময় করে
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৪:৩৬ পিএম, ২২ আগস্ট ২০২৩ মঙ্গলবার
হৃদরোগের সাথে ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টি ও ভুল জীবন-অভ্যাসের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টির কারণে আমরা একদিকে যেমন জীবনের মূল লক্ষ্য থেকে সরে গেছি, তেমনি সংজ্ঞায়িত করতে পারছি না আমাদের চাওয়াকে। কী চাই, কতটুকু চাই- আমরা নিজেরাই জানি না। যত পাচ্ছি তত বাড়ছে আরো পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। চাওয়াপাওয়ার এই দুর্বিষহ চক্র অভিশপ্ত করে তুলছে আমাদের জীবনকে। ভেতরে সৃষ্টি হচ্ছে অশান্তি অস্থিরতা টেনশন। এ-ছাড়াও আছে একাকিত্ববোধ ও বিষণ্নতা, যা আমাদেরকে ক্রমশ ঠেলে দিচ্ছে আরো স্ট্রেসের দিকে।
আর এই টেনশন ও স্ট্রেস আমাদের মধ্যে ক্রমাগত জন্ম দিচ্ছে ‘ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স’। সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম সবসময় উদ্দীপ্ত থাকছে, স্ট্রেস হরমোনের অতিরিক্ত নিঃসরণ ঘটছে। ফলে হৃৎপিন্ডের করোনারি ধমনী সংকুচিত হচ্ছে এবং সেখানে প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।
আবার সঠিক জীবনদৃষ্টির অভাবে আমরা শারীরিক পরিশ্রমহীনতা ও আরাম-আয়েশকে প্রাধান্য দিচ্ছি। সেইসাথে ফাস্ট ফুডসহ অতিরিক্ত চিনি ও চর্বিযুক্ত তৈলাক্ত খাবারের কারণে শরীরে মেদ জমছে, বাড়ছে কোলেস্টেরলের মাত্রা। এই বাড়তি চর্বি একসময় করোনারি ধমনীতে ব্লকেজ তৈরি করছে। দেখা দিচ্ছে হৃদরোগ। শুরু থেকেই চিকিৎসকদের বিশ্বাস ছিল, ধমনী একবার ব্লক হতে শুরু করলে কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ, এনজিওপ্লাস্টি কিংবা বাইপাস সার্জারি ছাড়া আর কোনো সমাধান নেই।
চিকিৎসকদের এ রক্ষণশীল চিন্তার বাইরে এসে ১৯৪০-৫০ দশকে এ বিষয়ে প্রথম গবেষণা শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রের দুজন কার্ডিওলজিস্ট ডা. লেস্টার মরিসন এবং ডা. জন ডব্লিউ গফম্যান। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনে এবং ব্যায়াম ও ওজন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তারা অসাধারণ ফল পান। এরপর ১৯৬০-৭০ দশকে আরেকজন মার্কিন পুষ্টিবিদ ও দীর্ঘায়ু-গবেষক নাথান প্রিটিকিন হৃদরোগীদের নিয়ে একই ধরনের গবেষণা করেন। তিনি তার পরামর্শপ্রার্থীদের তেল ছাড়া নিরামিষ খাবার, পর্যাপ্ত ফল, সালাদ, শাকসবজি, ডাল, মটরশুঁটি, পূর্ণ শস্যদানা জাতীয় খাবার খেতে উদ্বুদ্ধ করেন। সেইসাথে গুরুত্ব দেন ব্যায়াম ও ওজন নিয়ন্ত্রণে। তিনিও অসাধারণ ফল পান।
গত শতাব্দীর ৮০ ও ৯০-এর দশকে হৃদরোগ চিকিৎসা-গবেষণায় এনজিওপ্লাস্টি বা বাইপাস সার্জারি ছাড়াই শুধু জীবনদৃষ্টি ও জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্লকেজ কমাতে এমনকি ধমনীকে পূর্বাবস্থায় (ব্লকেজমুক্ত) ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হন যুক্তরাষ্ট্রের দুজন প্রখ্যাত চিকিৎসক-ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ডিন অরনিশ এবং ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের সার্জন ডা. কাল্ডওয়েল বি এসেলস্টাইন। তবে ডা. ডিন অরনিশের গবেষণাটি ছিল বিশদ, বহুমুখী এবং পূর্ণাঙ্গ।
নিজের জীবন বদলের এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা আর প্রাচ্যের সাধকদের চিরায়ত জ্ঞানের আলোকে হৃদরোগীদের নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন ডা. ডিন অরনিশ। উদ্ভাবন করেন হৃদরোগ নিরাময়ের এক কার্যকর ও সমন্বিত চিকিৎসাপদ্ধতি। করোনারি হৃদরোগ নিরাময়ে নিজের সফল গবেষণার আদ্যোপান্ত নিয়ে ডা. অরনিশ পরবর্তীকালে লেখেন তার বেস্টসেলার বই প্রোগ্রাম ফর রিভার্সিং হার্ট ডিজিজ। বইটিতে তিনি এ যুগান্তকারী গবেষণার সূত্রপাত ও এর নানা দিক নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।
পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং প্রচলিত ধারার একজন চিকিৎসক ডা. ডিন অরনিশ, যিনি পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথমসারির একটি মেডিকেল কলেজে। কেন তিনি হঠাৎ উৎসাহী হলেন চেনা পথের বাইরে হাঁটতে? হৃদরোগ নিরাময়ের আধুনিক চিকিৎসার বদলে তার রোগীদের কেন তিনি উদ্বুদ্ধ করলেন প্রাকৃতিক ও সমন্বিত চিকিৎসাপদ্ধতি গ্রহণে? সে বিষয়টির পূর্বাপর এখানে আলোকপাত করা যেতে পারে।
ডিন অরনিশ তখন ছাত্র। প্রি-মেডিকেল কোর্সে পড়াশোনা করছিলেন। এ কোর্সটি ভালোভাবে শেষ করতে পারলে তবেই মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবেন। সব ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু বাধ সাধল অর্গানিক কেমিস্ট্রি। কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ভালো করাকেই মেডিকেল কলেজে ভর্তির একমাত্র যোগ্যতা বলে মনে করতেন। এদিকে অর্গানিক কেমিস্ট্রির প্রথম ক্লাসেই জাঁদরেল শিক্ষক এসে ঘোষণা দিলেন- ‘এটি হচ্ছে মেডিকেল সায়েন্সের আগাছা পরিষ্কার করার ক্লাস এবং তোমাদের আমি আগাছা হিসেবে দূর করে দেবো।’
সেই শিক্ষক পড়াতেন টেক্সটবুক ছাড়াই, অল্প কিছু শ্রুতিধর ছাত্রছাত্রী ছাড়া অধিকাংশই তার পড়া ধরতে পারত না। ফলে অরনিশ পিছিয়ে পড়তে শুরু করলেন এবং একসময় তার মধ্যে হতাশা দেখা দিল। অরনিশ ভাবলেন, তার পক্ষে অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে পাশ করা সম্ভব নয়। নিদারুণ বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করলেন তিনি। একপর্যায়ে তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিল। একদিন তিনি আত্মহননের পরিকল্পনাও করে ফেললেন বাড়ির কাছেই! বড় রাস্তার ওপর ওভারব্রিজ, সেই ওভারব্রিজে উঠবেন, লাফ দিয়ে নিচের রাস্তায় পড়বেন, কোনো গাড়ি এসে তাকে চাপা দিয়ে চলে যাবে। পরিকল্পনা মোটামুটি চূড়ান্ত।
কিন্তু ক্রমাগত হতাশা আর বিষণ্নতায় তিনি মানসিকভাবে এতই দুর্বল হয়ে পড়লেন যে, নির্ধারিত দিনে তার পক্ষে বাড়ির বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা, বিছানা ছেড়ে ওঠাই সম্ভব হলো না। পরবর্তী সময়ে অরনিশ লিখেছেন, এই ঘটনাটিও তাকে বুঝতে সাহায্য করে-মন কীভাবে শরীরকে প্রভাবিত করে। যা-ই হোক, আত্মহত্যার চেষ্টা করে তাতেও ব্যর্থ হওয়ায় অরনিশ একসময় কলেজে যাওয়াই ছেড়ে দিলেন। পড়াশোনায় একরকম ইস্তফা দিয়ে দিলেন। চলে গেলেন টেক্সাসে নিজ বাড়িতে।
এদিকে তাদের বাড়ির কাছেই থাকতেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত আধ্যাত্মিক সাধক স্বামী সচ্চিদানন্দ। অরনিশের বাবা ছিলেন স্বামীজীর অনুসারী। অরনিশকে তিনি নিয়ে গেলেন স্বামীজীর কাছে।
যোগগুরু স্বামী সচ্চিদানন্দ ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন সাধক। তৎকালীন সময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ এবং জাতিসংঘে বক্তৃতা করেন। স্বামীজী অরনিশকে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নতুন ধারণা দিলেন। শিথিলায়ন, মেডিটেশন, নিরামিষ খাবার, ইয়োগা, প্রাণায়াম ও মনছবির প্রক্রিয়া শেখালেন। স্বামীজীর কাছে অরনিশ নিয়মিত যাতায়াত এবং চর্চা অব্যাহত রাখলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তার বিষণ্নতা কেটে গেল। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন অরনিশ। আবার কলেজে ফিরে গেলেন এবং সফলভাবে প্রি-মেডিকেল কোর্স সম্পন্ন করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন। ছাত্রজীবনের এই ঘটনা অরনিশের জীবনকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। তার জীবনদৃষ্টি ও জীবনধারায় আসে স্থায়ী ও গভীর পরিবর্তন।
পরবর্তীকালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে তিনি যখন হাসপাতালের কার্ডিওলজি ইউনিটে কাজ করতে শুরু করেন, তখন হৃদরোগীদের কষ্ট তাকে নানাভাবে স্পর্শ করে। তিনি দেখেন, যে-সব হৃদরোগী ব্লকেজ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, তাদের এনজিওপ্লাস্টি বা বাইপাস করা হচ্ছে। বিস্ময়ের সাথে তিনি লক্ষ করেন, এনজিওপ্লাস্টি করা হয়েছে এমন রোগীদের ৩০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পরবর্তী চার থেকে ছয় মাসের মধ্যেই পুনঃব্লকেজ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। যাদের বাইপাস সার্জারি করা হচ্ছে তাদের প্রায় অর্ধেকই পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে আবার ব্লকেজ নিয়ে আসছেন।
অরনিশ লক্ষ করলেন, হাসপাতালের কার্ডিওলজি ইউনিটে স্ন্যাকস হিসেবে রোগীদের দেয়া হচ্ছে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, সাথে মেয়োনেজ। শুধু তা-ই নয়, হাসপাতালের লবিতে শোভা পাচ্ছে সিগারেট মেশিন। হাসপাতালের ক্যাফেটেরিয়ায় যে খাবারগুলো পাওয়া যাচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে চিজবার্গারসহ নানারকম চর্বিজাত খাবার ও ফাস্ট ফুড।
অরনিশ বুঝলেন গলদটা কোথায়। তিনি জানতেন, এর বছর কয়েক আগে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা প্যাথলজিস্ট ড. রবার্ট উইসলার একটি গবেষণা পরিচালনা করেন, যেখানে একদল বেবুনকে নিয়মিত হসপিটাল ডায়েট (হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের যে-সব খাবার দেয়া হয়) খাওয়ানো হয়। কিছুদিন পর দেখা যায়, বেবুনগুলোর করোনারি ধমনীতে ব্লকেজ তৈরি হয়েছে।
পুরো বিষয়টি অরনিশের মনে গভীর রেখাপাত করল। হৃদরোগীদের নিয়ে তিনি গবেষণার সিদ্ধান্ত নিলেন। ছাত্রজীবনে নিজের হতাশা-ব্যর্থতা এবং তা থেকে উত্তরণের ঘটনাটি তার এ গবেষণায় ব্যাপক প্রভাব রাখে। প্রাচ্যের বুজুর্গ-ঋষি-সাধকদের হাজার বছরের চিরায়ত শিক্ষার এক চমৎকার প্রয়োগ তিনি ঘটালেন হৃদরোগীদের জীবনে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোকে ডা. অরনিশ এ বিষয়টির উপযোগিতা নতুনভাবে উপস্থাপন করলেন সবার সামনে। সুস্থ জীবনের আশাবাদ ফিরে পেলেন হৃদরোগীরা।
লেখাটি ডা. মনিরুজ্জামান ও ডা. আতাউর রহমান-এর "এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ" বই থেকে নেওয়া।
এমএম//