অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে দেশের প্রথম রেলস্টেশন কুষ্টিয়ার জগতি
তানভীর সুমন
প্রকাশিত : ০৯:১৯ পিএম, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ শনিবার | আপডেট: ০৯:২১ পিএম, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ শনিবার
বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রথম রেলগাড়ি চলেছিল। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির তৈরি সেই সময়ে ব্রডগেজ রেলপথ ধরে রানাঘাট থেকে দর্শনা হয়ে একটি ট্রেন এসে থেমেছিল কুষ্টিয়ার এই জগতি রেলস্টেশনে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রেল কোম্পানি ভারতবর্ষে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কাজের জন্য রেলপথ চালু করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এ অঞ্চল বেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে এই জগতিতে রেলপথ ও স্টেশন নির্মিত হয়। পরবর্তীতে এখানে ‘কুষ্টিয়া চিনিকল’ প্রতিষ্ঠিত হলে আখ সরবরাহ ও অর্থনৈতিক কাজে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এই রেলস্টেশন।
এছাড়া এই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে, এশিয়ার সর্ববৃহৎ কাপড়ের কলের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মিল। কুষ্টিয়ার অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তিত্ত্ব মোহিনী মোহন চক্রবর্তী ১৯০৮ সালে কুষ্টিয়া মোহিনী মিলস এন্ড কোম্পানী লিমিটেড নামে এই কাপড়ের মিলটি প্রতিষ্ঠা করেন।
কালের সাক্ষী প্রায় ১৬১ বছর বয়সী রেল স্টেশনটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ রেলস্টেশনে দু’টি লোকাল ট্রেন ছাড়া আর কোনও ট্রেন থামে না। ১৯ ৮৪ সালে প্রায় ২৬ জন স্টাফ ছিল। বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত ছিল তারা । তখন টিকিট কাউন্টার ও অনেক যন্ত্রাংশ ছিল। সেই সময়ের যন্ত্রাংশ কিছুই নেই এখন। সামান্য কিছু থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলোও বাতিলের খাতায়।
কালের সাক্ষী এই স্টেশনটি ছিল খুব ব্যস্ত স্টেশন, সে সময় মানুষের আর রেল গাড়ির ভিড়ে এখানে আসা যেত না। স্টেশন তারকাটা দিয়ে ঘেরা থাকতো, লোকজন বোঝাই থাকতো সারাক্ষণ। মানুষের ভিড়ে অনেক সময় ট্রেনে উঠাই যেত না। এখন প্রায় সময়ই থাকে মানব শূন্য।
শুরুতে ডাবল রেল লাইন থাকলেও এখন ডাবল লাইন উঠে গিয়ে, হয়েছে সিঙ্গেল লাইন। কোন ইন্টারসিটি ট্রেন থামেনা। যাত্রীদের বেশ অসুবিধা হয়। কখন কোন রেলগাড়ি দাঁড়ায় এটা টের পাওয়া বেশ মুশকিল, এ জন্য যাত্রী সংখ্যা কমে গেছে। দেশের প্রথম রেল স্টেশন এটি কিন্তু এ পর্যন্ত এর উন্নয়ন কাজ হয়নি । বাথরুম, গোসলখানা থেকে শুরু করে এখানে সবই ছিল। সময়ের ব্যবধানে এগুলোর কিছুই এখন নেই। ব্রিটিশ আমলে তৈরি রেলের দৃষ্টিনন্দন বিল্ডিং পরিত্যক্ত হয়েছে অনেক আগেই। যেকোনো সময় এটি ভেঙে পড়তে পারে।
তবে স্থানীয়রা বলেন, জগতি খুব বড় স্টেশন ছিল। এরকম দোতালা স্টেশন আর নেই। এর সবই নষ্ট হয়ে গেল। বহু বছর হলো বৃট্রিশ আমলে তৈরি বিল্ডিংটি এখন পরিত্যক্ত, ভেতরে গাছ জন্মেছে। দেয়ালগুলো ভেঙে পড়ার উপক্রম। এখন মানুষ খুব কম আসে এখানে।
বিশিষ্টজনেরা বলছেন, অন্যকোন দেশ হলে, ইতিহাসের অংশ হিসেবে এই জগতি রেলস্টেশনকে ঐতিহাসিক স্থানে রূপ দিত কিন্তু স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এখানে ট্রেন না থামা, শহর গড়ে না ওঠা, সড়ক পরিবহনের ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন চক্রান্তের ফলে গুরুত্ব হারিয়েছে , কালের সাক্ষী দেশের প্রথম রেলস্টেশনটি। যে কারণে এটি উন্নয়ন বঞ্চিত। সেই সময়ে এটির উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হলে, কুষ্টিয়া শহরটি হয়তো জগতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠতো।
তবে দেশের প্রথম রেল স্টেশন হিসেবে এটির আরো উন্নয়ন করা দরকার ছিল কিন্তু প্রায় ১৬১ বছর পার হলেই, কোনো সরকারই এই উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এর ফলে আজ হারাতে বসেছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যের একটি বড় অংশ , কালের সাক্ষী বাংলাদেশের প্রথম রেলপথ কুষ্টিয়ার জগতি কিন্তু এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এটি হতে পারতো উপমহাদেশের ঐতিহ্যের অংশ।
বিশিষ্টজনেরা আরো বলেন, দেরিতে হলেও, যদি স্টেশনটি উন্নয়ন ও পুরানো যন্ত্রাংশ সংরক্ষণের মাধ্যমে পর্যটনের একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি করা হয় তাহলে এই এলাকার উন্নয়নের পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।