শ্রীকৃষ্ণের আর্বিভাব তিথি
স্মৃতি মন্ডল
প্রকাশিত : ০৭:১৯ পিএম, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ মঙ্গলবার
শ্রীমদ্ভগবদগীতায় জ্ঞানযোগের চতুর্থ অধ্যায়ে সাত ও আট নং শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যূত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই"। সাধুদের পরিত্রাণ করার জন্য এবং দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার জন্য এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই"।
দ্বাপর যুগ, অসুর দম্ভ আর অশুভ শক্তির কালো ছায়া স্বর্গমর্ত্যে। সেই সময় পাশবিক শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে সত্য সুন্দর ও শুভশক্তির উত্থানে ধরাধামে পূর্ণ অবতাররূপে আর্বিভূত হয়েছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। বিষ্ণুর অষ্টম অবতার শ্রীকৃষ্ণ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে শ্রীকৃষ্ণ পরম পুরুষোত্তম, শ্রীমদ্ভগবদগীতার প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর উপাধিতে ভূষিত।
পুরান মতে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথির রোহিনী নক্ষত্রে অত্যাচারী রাজা কংসের কারাগারে দেবকীর গর্ভে জন্ম শ্রীকৃষ্ণের। শাস্ত্র থেকে জানা যায়, ৩২২৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ১৮ অথবা ২১ জুলাই বুধবার ছিলো কৃষ্ণের জন্মদিন। তবে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তিথি মেনেই প্রত্যেক বছর কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী হিসেবে পালন করেন। প্রচলিত আছে, এই দিনে শ্রীকৃষ্ণের আরাধনায় মনের সকল ইচ্ছে পূরণ হয় ভক্তদের।
মথুরার রাজপরিবারের সন্তান শ্রীকৃষ্ণ। যাদববংশীয় বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম সন্তান। দেবকীর বাবা উগ্রসেনকে বন্দী করে মথুরার সিংহাসন দখল করেন দেবকীর দাদা কংস। পরবর্তীতে দেবকীর সাথে বসুদেবের বিয়ের পর এক দৈববাণীর মাধ্যমে কংস জানতে পারেন যে দেবকীর গর্ভের অষ্টম সন্তানই হবে তার মৃত্যুর কারণ। নববিবাহিত দম্পতিকে কারারুদ্ধ করেন কংস। এরপর কারাগারেই জন্মের পর ছয় পুত্রকে হত্যা করে কংস। দেবকী তার সপ্তম গর্ভ রোহিনীকে দিলে জন্ম হয় বলরামের আর অষ্টম গর্ভে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে জন্ম হয় শ্রীকৃষ্ণের।
কৃষ্ণের জন্মের রাতেই দৈব সহায়তায় কারাগার থেকে বের হন বসুদেব, ভয়াল দুর্যোগ উপেক্ষা করে গোকুলে যশোদা ও নন্দের কাছে রেখে আসেন শ্রীকৃষ্ণকে। যশোদা নন্দন হিসেবে গোকুলে বেড়ে উঠতে থাকা গোপাল বাল্যকালেই রাক্ষসী পুতনাকে বধ করে, কালীয়নাগকে হত্যা, গোবর্ধন ধারণসহ নানা অলৌকিক শক্তির প্রমাণ দিতে থাকে। কংস বধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকা শ্রীকৃষ্ণ দিনে দিনে নিপীড়িত মানুষের আশার আলো হয়ে উঠে। চারিদিকে ছড়িয়ে পরে কৃষ্ণনাম, আর মৃত্যুভয়ে তটস্থ হয়ে থাকা কংস নানাভাবে ষড়যন্ত্র করেও শ্রীকৃষ্ণকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়। যৌবনে মথুরায় ফিরে গিয়ে মামা কংসকে বধ করে দৈববানীকে সত্য করেন শ্রীকৃষ্ণ। কংসের পিতা উগ্রসেনকে পুনরায় যাদবকুলের রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসান। মথুরার যুবরাজ শ্রীকৃষ্ণের সাথে সেসময় সখ্যতা গড়ে ওঠে অর্জুনসহ কুরু রাজ্যের পান্ডব রাজপুত্রদের। পরবর্তীতে দ্বারকা নগরীতে রাজত্ব স্থাপন করেন শ্রীকৃষ্ণ।
পরবর্তীতে যখন কুরক্ষেত্রের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে তখন শ্রীকৃষ্ণ পান্ডব ও কৌরব উভয়পক্ষকে সুযোগ দেন তার কাছে সাহায্য হিসেবে দুটি জিনিসের একটি বেছে নিতে। দুটি জিনিসের মধ্যে একটি ছিলো স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যিনি যুদ্ধের সময় অস্ত্র হাতে নেবেন না বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং অপরটি ছিলো তার নারায়ণী সেনা। পান্ডবদের পক্ষে অস্ত্র ছাড়াই শ্রীকৃষ্ণকে বেছে নেন অর্জুন। কৌরবদের পক্ষে নারায়ণী সেনা গ্রহণ করেন দুর্যোধন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের রথের সারথি ছিলেন কৃষ্ণ, পুরো যুদ্ধের মহানায়ক হিসেবে কৃষ্ণ জ্ঞান দান করে গেছেন অর্জুনকে। শ্রীকৃষ্ণ জানতেন মহাভারতের যুদ্ধ ও পরিণতি। পাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যে শান্তি স্থাপনে উদ্যোগ নিলেও ব্যর্থ হয়েছিলেন দূর্যোধনের দাম্ভিকতা ও কুপ্রচেষ্টার কাছে। প্রতিপক্ষ যখন প্রিয়জন তখন সেই যুদ্ধের রক্তক্ষরণ কুরুক্ষেত্রের সীমানা ছাড়িয়ে পাণ্ডব ও কৌরবদের হৃদয়কে আহত করেছিলো। তবুও মহাভারতের সেই যুদ্ধ ছিলো অনিবার্য। জয়ী হয়েছিলো পাণ্ডবরাই, শ্রীকৃষ্ণ তাদের ন্যায় পাইয়ে দিয়েছিলো। মহাভারতের যুদ্ধ ন্যায়ের যুদ্ধ, ধর্ম প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মানবকুলের শেষ আশ্রয়, অগতির গতি, জগতের গুরু। সকল অন্ধকার দূর করে মঙ্গল প্রতিষ্ঠায় জীবাত্মার বন্ধন সুদৃঢ় করেছেন। গীতার মাধ্যমে দেখিয়েছেন জীবনের দিশা। অর্জুনের মাধ্যমে শ্রীমদ্ভগবদগীতায় আঠার অধ্যায়ে জাগতিক সকল জ্ঞান, কর্ম, ধ্যান, আত্মসংযম, বুদ্ধি, মোহ, মুক্তি, সত্য, ন্যায়-অন্যায়, পাপ, ভক্তি ও মোক্ষলাভসহ জীবনাচরণে প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞান দান করেছেন। গীতার জ্ঞান থেকে মানব আত্মা তার মুক্তির দিশা খুঁজে নেবে নিজ নিজ অবস্থান এবং পরিস্থিতির সাপেক্ষে। যা একই ভাবে বিদ্যমান সেই ইতিহাস সৃষ্টির আদিকাল থেকে। জন্মাষ্টমীর এই পবিত্র তিথীতে পূর্ণ হউক সকলের প্রার্থনা, সকলের মনস্কামনা।
কেআই//