চেহারা নয়, যার যার কর্মই পারে ভবিষ্যৎকে সাজাতে
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৪:৩৫ পিএম, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ বৃহস্পতিবার
আজকে এমন একজন নারীর সাথে পরিচিত হবো যাকে নির্দয়ভাবে খেতাব দেয়া হয়েছিলো ‘পৃথিবীর কুৎসিততম নারী’ হিসেবে। যদিও এই বুলিংকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ওেই নারী প্রমাণ করেছেন প্রথমে দর্শনধারী, পরে গুণ বিচারী প্রবাদটা সেকেলে, অযৌক্তিক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। আত্মপ্রত্যয়ী এই মার্কিন নারীর নাম লিজি ভালসাকেজ।
লিজি জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯৮৯ সালের ১৩ই মার্চ। মাতৃগর্ভে প্রায় ৩৮ সপ্তাহ থাকার পরে সাধারণত শিশুর জন্ম হয়। কিন্তু মায়ের সমস্যার কারণে চার সপ্তাহের প্রি-ম্যাচিওর শিশু হিসেবে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন। ওজন ছিল মাত্র ২ পাউন্ড ১১ আউন্স। বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান, স্বাভাবিকভাবে প্রথম সন্তান জন্মের সময় বাবা-মা উভয়েই খুব আনন্দিত ও রোমাঞ্চিত থাকেন। কিন্তু আনন্দ মাটি করে চিকিৎসকরা জানালেন, লিজি কোনোদিন কথা বলতে পারবে না, হাঁটাচলা করতে পারবে না, এমনকি নিজে নিজে হামাগুড়িও দিতে পারবে না। এমন সতর্কবাণী বাবা-মায়ের মনে কষ্ট দিলেও আশাহত করতে পারেনি। বরং তারা জোর দিয়েই বললো “আমাদের সন্তানকে আমরা দেখতে চাই, বাসায় নিয়ে আমাদের সাধ্যমতো তাকে প্রতিপালন করতে চাই। আমাদের সন্তানকে আমাদের কাছে তুলে দিন।”
জন্ম থেকেই ডান চোখে দেখতে পান না লিজি। মারফান সিন্ড্রোমের প্রকোপে অপর চোখের দৃষ্টিও ক্ষীণ। তবে এ রোগ তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, মস্তিষ্ক ও অস্থির গঠনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
বাহ্যিক অবয়বের জন্য তিনি ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড বুলিং বা টিটকারির শিকার হয়েছিলেন। আশেপাশের মানুষদের থেকেই নয়, মারাত্মকভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকারও হয়েছেন। প্রায় প্রতিটি মানুষই বুলিংয়ের তিক্ততার মুখামুখি হয়। কিন্তু তার ক্ষেত্রে এটি ছিল মাত্রাতিরিক্ত।
স্কুলে প্রথম দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে লিজি বলেন, “স্কুলে গেলাম, পিঠে ছিল স্কুল ব্যাগ, ব্যাগটা ছোটদের জন্য হলেও আমার পিঠে সেটা আমার চেয়েও অনেক বড় ছিল। এর কারণে দেখতে মনে হচ্ছিল আমি যেন কচ্ছপ আর আমার ব্যাগটা কচ্ছপের উপরের খোলস। আমার ক্লাসমেটের দিকে তকিয়ে মুচকি হাসলাম। সে আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন আমি একটা ডাইনি। আমার মতো ভয়ানক কিছু যেন সে কখনো দেখেনি।”
তারপরেও ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত সব মেনে নিয়ে সাধারণ একজন মেয়ে হিসাবেই দিন পার করছিলেন তিনি। তবে একদিনের একটা ঘটনা তার জীবনের মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়।
সময়টা ২০০৬ সাল। তিনি তখন হাইস্কুলে পড়েন। একদিন ইউটিউবে বসেন গান শোনার জন্য। এমন সময় একটি নতুন ভিডিও দেখতে পেলেন। ভিডিওটির শিরোনাম ছিল বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিত নারী। ভিডিওটি ক্লিক করে দেখলেন ভিডিওটি তাকে নিয়েই তৈরি করা হয়েছে। ৮ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপটি ইতোমধ্যে প্রায় চার মিলিয়ন বার দেখা হয়ে গেছে। নিচে হাজার হাজার নেতিবাচক কমেন্ট।
বিরাট এক ধাক্কা খেয়েছিলেন লিজি। ছোটবেলা থেকেই বুলিংয়ের শিকার হয়েছিলেন, তবে এমন ভয়ংকর আক্রমণের শিকার আগে কখনো হননি। তবে তিনি ভেঙ্গে না পড়ে জীবনকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করে নতুনভাবে জীবনের লক্ষ্য স্থির করে ফেলেছেন। ৮ সেকেন্ডের সেই ভিডিও ক্লিপটিই তার জীবন পুরোপুরিভাবে পালটে দিয়েছিল।
সেই মুহূর্তে যে চারটি লক্ষ্য স্থির করেছিলেন লিজি সেগুলো হলো-
১) একজন সুবক্তা হওয়া;
২) নিজের লেখা বই প্রকাশ করা;
৩) স্নাতক হওয়া ও নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করা এবং
৪) পরিবার তৈরি করা।
এ লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে লিজি প্রায় শতভাগ সফল হয়েছেন। ২০১২ সালে আমেরিকার টেক্সাস স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমিউনিকেশন স্টাডিজে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। জনসচেতনতা, এন্টি-বুলিং, মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য ইত্যাদি নিয়ে তিনি প্রেরণা উদ্দীপক বক্তব্য দিয়ে থাকেন। তার ভেরিফাইড নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল আছে, যার সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা আট লক্ষের বেশি।
এখন পর্যন্ত চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে তার। এর মধ্যে একটি বই যৌথভাবে লেখা। বাকি তিনটি এককভাবে নিজের লেখা। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় ‘Lizzie Beautiful: The Lizzie Velásque’ বইটি। এটি তার মা লিখেছেন। তবে এতে লিজির ছোটবেলার বিভিন্ন চিঠিপত্র সংযুক্তির ফলে একে যৌথ লেখকের বই হিসেবেই গণ্য করা হয়।
২০১২ সালে প্রকাশিত হয় লিজির দ্বিতীয় বই ‘Be Beautiful, Be You’। এতে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে নিজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য খুঁজে নিয়ে তার পরিচর্যা করতে হয়। পরের বইটি বের হয় ২০১৪ সালে, নাম ‘Choosing Happiness’। এতে তার জীবনে চলার পথে বাধাবিপত্তি কীভাবে জয় করেছেন সে সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ২০১৭ সালে প্রকাশিত বইটির নাম ‘Dare to be Kind’। এখানে তিনি আলোচনা করেছেন অসহিষ্ণুতাকে অবলম্বন করে সমাজ থেকে বুলিং কীভাবে মুছে ফেলা যায় সে বিষয়ে।
লিজির সেরা কিছু উক্তি
তার প্রত্যেকটি বই ও বক্তৃতার মূল উদ্দেশ্য মানুষকে প্রেরণা দেয়া। তার কিছু প্রেরণাদায়ক উক্তি এখানে তুলে ধরা হলো।
আপনি যেমন, ঠিক তেমনটা হওয়াই সুন্দর। সবার মতো না হওয়াটাই ভালো। যে বিষয়টা আপনাকে অনন্য করে তোলে, সেটাই আপনাকে আসলে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। কারণ, সে বিষয়টাই মূলত আপনাকে ‘আপনি‘ বানিয়েছে। আপনি যেমন, ঠিক সেভাবেই আপনাকে এই বিশ্বের খুব প্রয়োজন। এটাই সত্য; খুব সহজ এবং সাধারণ কথা।
আমি সবসময় বলে থাকি যে, বিশ্বে ইতিবাচক পরিবর্তনটা কিন্তু একজনকে দিয়েই শুরু হয়। সেই ব্যক্তিটি আপনিও হতে পারেন। তাই নিজেকে ঠিক নিজের প্রতিচ্ছবির মতো গড়ে তোলাটা শিখতে হবে। এই বিশ্বকে পরিচর্যা করার শক্তি ও ইচ্ছা শক্তি অর্জন করতে চাইলে নিজেদের পরিচর্যা কীভাবে করতে হয় সে শিল্পটা আগে আয়ত্ব করতে হবে।
সত্যিকারের সৌন্দর্য হলো নিজের স্বাতন্ত্র্য আবিষ্কার করা এবং স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত হওয়া।
আমার কাছে চূড়ান্ত সুখ মানে কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নয়, যেখানে গিয়ে আপনার চলার পথ ফুরিয়ে যাবে। আমার কাছে চূড়ান্ত সুখ মানে একটি লম্বা সফর, নিজেকে সুখী রাখতে যার প্রতিটি দিনকেই বেছে নিতে হবে।
শুধুমাত্র নিজের মতো হওয়াই সফলতার জন্য যথেষ্ট।
যে সময়টি আপনি অতিবাহিত করছেন তা সবচেয়ে সেরা হবে, না সবচেয়ে খারাপ হবে- সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আপনার হাতেই।
লিজির এক বন্ধু বলেছেন “লিজি কুৎসিত নয়, কুৎসিত তাকে দেখা আমাদের এই চোখ।
আর লিজির মা বলেন, লিজির মা হতে পেরে তিনি গর্বিত।
অথচ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হয়েও আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। নিজের রূপ চেহারা আমাদের ভোগায়। ফেয়ার এন্ড লাভলির বিজ্ঞাপন দেখে আমরা হিনমন্যতায় ভুগি। ভাবি চেহারাই সব। কিন্তু ভবিষ্যৎ কখনো রূপ দিয়ে সাজানো যায়না। যার যার কর্মই পারে ভবিষ্যৎকে সাজাতে।
এসবি/