ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

আলোর লড়াইয়ে আহমদ রফিক

সৌমিত্র শেখর

প্রকাশিত : ১১:০৩ এএম, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ মঙ্গলবার | আপডেট: ১১:১৪ এএম, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ মঙ্গলবার

মানুষ জন্মগ্রহণ করলে তার মৃত্যু একদিন অবধারিত। এই নশ্বর দেহ মানুষকে ছেড়ে যেতে হবে—এটাই স্বাভাবিক। এ কথা ধর্মেও বলে, সমাজেও বলে, চারদিকে ব্যক্ত এই শাশ্বত কথা। কিন্তু দেহের বিনাশই যে চিরমৃত্যু নয়, এ কথা আজ মানবসমাজে প্রতিষ্ঠিত।

সভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে দৈহিক মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই। সভ্যতা বলে যে ধারণাটি আমরা মানি, তার পেছনে আছে মানুষের বেঁচে থাকা। চিরজীবিতরাই সভ্যতা নির্মাণ করেছিলেন এবং করছেন। সেদিক থেকে চিন্তা করলে খুব কম লোকই শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে।

এটি শুধুই কোনো জন্ম-মৃত্যুর জাগতিক বিষয় নয়। এটি একটি লড়াই। জ্ঞান, চিরন্তনতা এবং অবদান রক্ষার প্রতিযোগিতাও বটে। এই প্রতিযোগিতা কখনো নিজের সঙ্গে নিজে, কখনো পরিপার্শ্বের সঙ্গে, কখনো অন্যের সঙ্গে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতার ফল গিয়ে মেলে একটি ভরকেন্দ্রে এবং সেই ভরকেন্দ্রই তৈরি করে সভ্যতা। সভ্যতার গতিমুখে থাকে কিছু নির্দিষ্ট প্রতীতি এবং প্রতীতিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি, সংস্কৃতি, অগ্রগতি। আহমদ রফিক হলেন তেমনি একজন মানুষ, যিনি সময়ের এই ভরকেন্দ্র তৈরিতে অবদান রেখেছেন এবং সভ্যতায় হয়তো তা সামান্য সঞ্চয়।
আহমদ রফিক ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানি সময় আর বাংলাদেশ কাল—এই তিনটি সময় প্রত্যক্ষ করেছেন। জন্মেছিলেন ব্রিটিশ আমলে।

পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে নবযৌবনপ্রাপ্ত এই মানুষটি প্রথমেই একটি আশা নিয়ে জীবন শুরু করেন, ওই সময়ের অন্যদের মতো। ব্রিটিশদের শোষণ বয়সের কারণেই তাঁর বুঝার কথা ছিল না, কিন্তু পরে তিনি জেনেছিলেন এই শোষণের মাত্রা; পরে আরো বেশি করে বুঝেছিলেন। কিন্তু এই জানা ও বোঝার চেয়ে অনেক বেশি প্রত্যক্ষ করেছিলেন ওই সময়ের পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচার এবং আগ্রাসন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হিসেবে তিনি যখন পড়ছিলেন, ওই সময় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ভাষার ওপর আধিপত্য বিস্তারের প্রত্যক্ষ চেষ্টা করে এবং এ কারণেই ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সৃষ্টি হয়। এই সংগ্রামে আহমদ রফিক ছিলেন সামনের সারিতে। পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হোক—এই আন্দোলনে ওই সময় ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে সারা দেশে অনেকেই যুক্ত ছিলেন। সবার আদর্শ ও উদ্দেশ্য কিন্তু এক ছিল না। তবে লক্ষ্যের মিল ছিল, আর সেটি হলো রাষ্ট্রভাষা বাংলা। আহমদ রফিক রাষ্ট্রভাষা বাংলা হোক এটাই চেয়েছিলেন। কিন্তু এর চেয়েও বেশি প্রত্যাশা ছিল তাঁর এবং সেখানেই আহমদ রফিকের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের প্রতিফলন পাওয়া যায়।

জীবনের প্রথম থেকেই তিনি মেহনতি মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে সামনে রেখেছিলেন। বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী অধ্যাপক অরবিন্দ পোদ্দারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আলাপ ও তাঁর সাহচর্যপ্রাপ্তি আহমদ রফিকের জীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। আর তাই তিনি মনে করেন, সাধারণ মানুষের মুক্তি না হলে দেশের মুক্তি সম্ভব নয়। আর সাধারণ মানুষের একমাত্র ভাষা যেহেতু তার মাতৃভাষা, অতএব মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা মূলত মেহনতি মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রথম পদক্ষেপ। আর সে কারণেই তিনি বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, বিশেষ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হোক—এই সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। এই সংযুক্তি খুব সহজে ছিল না।

পশ্চিম পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু আমলা ও বাঙালিবিরোধী মানুষের মনোভাবকে পাশ কাটিয়ে তরুণ বয়সে যে সংগ্রামে তিনি লিপ্ত হয়েছিলেন, সে কারণে তাঁকে মূল্যও দিতে হয়েছিল অনেক বেশি। মেডিক্যালে ভর্তি হয়ে সাধারণভাবে তিনি তাঁর ছাত্রজীবন শেষ করতে পারেননি। এমনকি তিনি এমবিবিএস পাস করেও চিকিৎসা করার ছাড়পত্র হাতে পাননি। তবে আপসের চোরাবালিতে তিনি কখনোই নিজেকে সমর্পণ না করার কারণে শেষ পর্যন্ত আদর্শিক মানব হিসেবে আজ সবার সামনে পরিচিতি পেয়েছেন। পাকিস্তান আমলে বাঙালির যে সাংস্কৃতিক লড়াই, সেই লড়াইয়ে আহমদ রফিক সব সময় ছিলেন এবং সংগঠকের ভূমিকা নিয়েছিলেন।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তান আমলে সংঘটিত সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা—এ কথা সর্বজনস্বীকৃত। আহমদ রফিক ছিলেন সেই সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। যে কারণে পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশে যখন স্বৈরাচারী শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, ওই সময় বাংলাদেশের মানুষের যে সাংস্কৃতিক লড়াই, সেই লড়াইয়ে তাঁকে সামনের সারিতে পাওয়া গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে একসময় রবীন্দ্রচর্চা প্রায় অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়েছে ঠিক পাকিস্তানি ধারায়। বিশেষ করে আশির দশকে রবীন্দ্রনাথের ওপর খানিকটা পাকিস্তানি কায়দায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। এ সময় রবীন্দ্রচর্চা নামে আহমদ রফিক একটি সংগঠন করেন এবং সেই সংগঠনের অধীনে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের আদর্শ চর্চা ও বিস্তারের জন্য কাজ করেন।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা ধরনের গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। আহমদ রফিকের রবীন্দ্রনাথকেন্দ্রিক গ্রন্থের সংখ্যা দশের ওপর। যে সময় এ দেশে রবীন্দ্রচর্চা স্থবির হয়ে পড়েছিল, ওই সময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে এসেছিলেন এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁর যে দরদ এবং রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশকেন্দ্রিক যে ভাবনা ভেবেছিলেন—এই বিষয়গুলো নিয়ে সবিস্তারে গ্রন্থ রচনা করে তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ এবং রবীন্দ্রনাথ মূলত একই সত্তার অংশ। আজ বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চার যে বিস্তার এবং রবীন্দ্রনাথকেন্দ্রিক যে বহুমাত্রিক গ্রন্থ রচিত হচ্ছে, তার পেছনে আহমদ রফিকের নীরব অবদান রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নানামুখী প্রভাব কিভাবে কার্যকর হয়েছে এবং আর কিভাবে কার্যকর হতে পারে—সে বিষয়ে তিনি যতটা সবিস্তারে গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, তাতে এ কথা নিশ্চিত করেই বলা চলে, সাধারণ বাঙালির কাছে আজকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করার পরিপ্রেক্ষিত ও প্রয়োজনীয়তা সবিস্তারে উপলব্ধ হয়েছে। এটাও এক ধরনের বিদ্যায়তনিক লড়াই; আলো দিয়ে আলো জ্বালার মতো।

আহমদ রফিক আজও সেই লড়াইয়ে আগুয়ান এবং তিনি বলা চলে আদর্শের রূপরেখা বর্ণিল ও উজ্জ্বল রেখে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আলোর আধার বাড়িয়ে রেখেছেন। মানুষ জন্মালে একদিন মরবেই, কিন্তু এ লড়াইয়ের কোনো মৃত্যু নেই।

লড়াকু এই মানুষটিকে আজ জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

 লেখক : উপাচার্য, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

এসবি/