তামাক ও মাদক : যুগে যুগে শোষণের হাতিয়ার
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০২:৫৩ পিএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ বৃহস্পতিবার
‘একটি সমগ্র জাতিকে অর্থের লোভে বলপূর্বক বিষপান করানো; এমনতরো নিদারুণ ঠগীবৃত্তি কখনও শোনা যায় নাই। চীন কাঁদিয়া কহিল, ‘আমি অহিফেন খাইব না।’ ইংরাজ বণিক কহিল, ‘সে কি হয়?’ চীনের হাত দুটি বাঁধিয়া তাহার মুখের মধ্যে কামান দিয়া অহিফেন ঠাসিয়া দেওয়া হইল; দিয়া কহিল, ‘যে অহিফেন খাইলে তাহার দাম দাও।’
বহুদিন হল ইংরেজরা চীনে এরূপ অপূর্ব বাণিজ্য চালাইতেছে। যে জিনিস সে কোনো মতেই চাহে না, সেই জিনিস তাহার এক পকেটে জোর করিয়া গুঁজিয়া দেওয়া হইতেছে, আর-এক পকেট হইতে তাহার উপযুক্ত মূল্য তুলিয়া লওয়া হইতেছে। অর্থ-সঞ্চয়ের এরূপ উপায়কে ডাকাইতি না বলিয়া যদি বাণিজ্য বলা যায়, তবে সে নিতান্তই ভদ্রতার খাতিরে!
... ইহা আর কিছু নয়, একটি সবল জাতি দুর্বলতর জাতির নিকটে মরণ বিক্রয় করিয়া ধ্বংস বিক্রয় করিয়া কিছু কিছু করিয়া লাভ করিতেছেন। এক পক্ষে কতই বা লাভ, আর-এক পক্ষে কী ভয়ানক ক্ষতি!
... এইরূপে এক বিদেশীয় জাতির হীন স্বার্থপরতা ও সীমাশূন্য অর্থলিপ্সার জন্য সমস্ত চীন তাহার কোটি কোটি অধিবাসী লইয়া শারীরিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধঃপতনের পথে দ্রুতবেগে ধাবিত হইতেছে। যেন, ইংরাজদের নিকট ধর্মের অনুরোধ নাই, কর্তব্যজ্ঞানের অনুরোধ নাই, সহৃদয়তার অনুরোধ নাই, কেবল একমাত্র পয়সার অনুরোধ বলবান।’ (চীনে মরণের ব্যবসায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
প্রায় দেড়শ’ বছর আগে লেখা এই নিবন্ধে চীনকে অহিফেন (আফিম) খাইয়ে নিঃস্ব করার যে বিবরণ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়েছেন, সেই একই ফর্মুলা উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর প্রয়োগ করছে (উভয় অর্থেই!) দানবাকৃতির বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো।
আফিম যুদ্ধ
১৮ শতকে ইংরেজরা চীন থেকে প্রচুর পরিমাণে চা আমদানি করলেও এর বিনিময়ে রপ্তানি করার মতো মানসম্পন্ন কোনো পণ্য তাদের ছিল না। ফলে দেখা দিল বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি। ব্রিটিশ কোষাগার দেউলিয়া হওয়ার জোগাড়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন বাংলা-বিহারের বিস্তীর্ণ ফসলি জমিতে কৃষকদের আফিম চাষ করতে বাধ্য করল। বর্তমান সময়ে তামাক চাষীরা যেমন ঋণের জালে সর্বস্বান্ত হয়, ঠিক সেইভাবে বাংলা ও বিহারের আফিম চাষীরা দেনার ভারে পিষে যেতে লাগল। আর সেই আফিম ইংরেজরা চোরাই পথে চীনে পাচার করতে শুরু করল।
এখন যেমন ভেপিং বা ই-সিগারেটকে স্টাইলিশ হিসেবে হাজির করা হচ্ছে, ১৮ শতকেও আফিম খাওয়াটাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এক ধরনের ফ্যাশনে পরিণত করে। ভারতবর্ষে তখন সমাজের উচ্চস্তরে আপ্যায়নের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ছিল—‘অনুগ্রহ করে আফিম সেবা গ্রহণ করুন।’ চীনেও শুরুতে উচ্চবিত্তদের টার্গেট করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
ইংরেজরা জানত একবার কাউকে আফিমে আসক্ত করা গেলে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সে কিনতেই থাকবে, যা বেনিয়াদের দেবে নিশ্চিত মুনাফা। মাদকের কারবার ব্রিটিশদের কপাল খুলে দিল। এবার চীনের কোষাগার ফাঁকা হতে লাগল। কোটি কোটি চীনা হয়ে পড়ল নেশায় বুঁদ ও অকর্মণ্য।
নেশার পয়সা জোগাড় করতে স্ত্রী-সন্তানকে বিক্রি করে দিতেও দ্বিধাহীন! সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্যে হুমকি বিবেচনা করে চীন সম্রাট আফিম আমদানি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
এদিকে ব্রিটিশদের মাথায় হাত। আফিমের কারবার বন্ধ হওয়া মানে বাংলা-বিহার-মাদ্রাজ হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। ভারতবর্ষের একের পর এক রাজ্য জয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভাড়াটে সৈন্যদল যে যুদ্ধ করত, এর খরচ আসত মাদকের কারবার থেকে। মাদকের অর্থেই তারা গড়ে তোলে বন্দর নগরী বোম্বে (এখনকার মুম্বাই)। ব্যবসায়িক স্বার্থরক্ষায় রানি ভিক্টোরিয়ার যুদ্ধজাহাজের বহর চীন আক্রমণ করল। পর্যুদস্ত চীনকে বাধ্য করল আরও একশ’ বছর আফিম গিলতে।
নতুন বোতলে পুরনো মদ
এই জবরদস্তি ও আগ্রাসন এখনও চলছে, তবে ভদ্রতার মুখোশে। যেহেতু ইউরোপ-আমেরিকায় জনসচেতনতা বাড়ছে, নাগরিক স্বাস্থ্য রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ণ করা হচ্ছে, সিগারেটের বিক্রি কমছে; তাই মুনাফা ঠিক রাখতে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলোর দৃষ্টি এখন আফ্রিকা ও এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলোর দিকে। নিকোটিনে আসক্ত করতে এসব দেশে তারা চালাচ্ছে জোর প্রচারণা।
ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্যে তামাক কোম্পানিগুলো হেন পদক্ষেপ নেই যা নিতে সংকোচ করে। কখনো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাঁধে বন্দুক রেখে, কখনো সেলিব্রেটিদের পণ্যদূত বানিয়ে, সেটাও কাজ না করলে আধুনিককালের মীরজাফর-জগৎ শেঠদের হাত ধরে।
প্রভাবশালী ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, আফ্রিকার অন্তত আটটি দেশের সরকার জনস্বার্থে তামাক পণ্য ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ টানার চেষ্টা করেছিল। বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো (বাংলাদেশেও এদের ব্যবসা রয়েছে) তখন হুমকি দেয়—‘সংসদে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাশ করলে তা হবে সংবিধান, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য আইনের লঙ্ঘন! ফলে সংশ্লিষ্ট দেশকে এর খেসারত দিতে হবে।’ বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি কে নেবে? অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেক ক্ষেত্রেই তাই মুখ বুজে মেনে নেয় তামাক কোম্পানির দাবি।
ইউনিয়ন ফর ইন্টারন্যাশনাল ক্যান্সার কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট ও জর্ডানের রাজপরিবারের সদস্য দিনা মিরেদ বলেন, ‘বড় তামাক কোম্পানিগুলো আমাদের মতো দেশগুলোর ওপর শিকারীর মতো হামলে পড়েছে। ওরা আমাদের তরুণদের ফুসফুস কব্জা করতে চায় এবং ওরা সেটা সফলভাবেই করছে!’
দেশের কিশোর-তরুণরা ধূমপান ও ভেপিংয়ে আসক্ত হলে দুর্বল ফুসফুস নিয়ে তো দমই নিতে পারবে না। নেশা ও রোগে ধুঁকে ধুঁকে মরবে। হয়তো সেটাই কারো গূঢ় উদ্দেশ্য!
এএইচ