শুভ জন্মদিন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
তিনি সংগঠক নন, তিনি নিজেই একটি সংগঠন
সাইফ আহম্মেদ
প্রকাশিত : ১২:৩১ এএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ শনিবার
তিনি বড় ভালো লোক। তাঁর নামের সঙ্গে এত বেশি বিশেষণ যথার্থ হয় যে, সব বিশেষণই তাঁর গুনের কাছে ম্লান। তাই খুব সাধারণ একটি কথা দিয়েই লেখাটা শুরু করলাম। তিনি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন। বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি অভিনেতা, তিনি ছড়াকার, তিনি লেখক, তিনি মঞ্চসফল নির্দেশক, তিনি নাট্য পরিচালক, তিনি সংগঠক। আসলে এক জীবনে এতকিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা যায় এবং সাফল্যেও চূড়াও ওঠা যায়। তাঁকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। তাঁর সব সাফল্যের অন্তরালে হিমালয়সম এক ব্যক্তিত্ব বাস করে। যার জোরে তিনি সাধারণ থেকে হয়ে উঠেছেন অসাধারণ। লেখার শুরুতে তাই বড় ভালো লোক কথাটা লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। তিনি পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন। শুভ জন্মদিন দাদা।
তাঁর সফল অভিনয় দেখতে দেখতেই বড় হয়েছি নাটকের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন এর প্রথম ধারাবাহিক নাটকের তিনি নায়ক। তিনি বাঙালিকে টিভি সেটের সামনে বসানোর অভ্যাস করেছেন তাঁর অভিনয় শৈলীর জাদুতে। মঞ্চেও তিনি অভিনয়ের ব্যাকরণ তৈরি করেছেন। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়কে মূল্যায়ন করেছেন তাঁর প্রকাশিত নাটকে ভিন্নভাবে। কীত্তনখোলা নাটকে ইদু কনকদার চরিত্রের একটি সংলাপ ছিল, ‘আঠার ফুট চওড়া রাস্তা বানালাম’। সেলিম আল দীন তাঁর প্রকাশিত কীত্তনখোলা নাটকের বইয়ের ফুটনোট দিয়ে লিখেছেন, ‘অভিনেতা পীযূষ আঞ্চলিক ভঙ্গিতে বলে টুয়ান্টি ফাইভ ফুট’। তাঁর অভিনয় সেলিম আল দীনকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, নাট্যাচার্যের লেখা সংলাপ পরিবর্তন করে ফেলার প্রসঙ্গটিও স্থান পেয়েছে সেলিম আল দীন রচিত ‘তিনটি মঞ্চ নাটক’ বইয়ে।
এই মহানায়কের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে কাজ শুরু করার ক্ষণটি আমার জন্য খুব একটা সুখকর ছিল না। আমি তখন আবদুল্লাহ আল মামুন এর সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করি। স্যুটিংয়ে মামুন ভাই একটু দেরিতেই পৌছাতেন আমরা সহকারীরা তাঁর পৌছানোর আগেই স্যুটিং শুরু করে দিতাম। ‘ধারাবাহিক নাটক বাবা’ এর সুটিং সেটে পীযূষদার সেদিন প্রথম স্যুটিং ছিল। মামুন ভাই তথনও সেটে পৌছাননি। আমি বেশ কবার পীযূষদাকে স্যুটিং শুরুর জন্য তাগাদা দিচ্ছিলাম। দাদা বারবারই জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘মামুন ভাই কখন আসবেন’? এক সময় আমার মনে হলো দাদা হয়ত সহকারীর পরিচালনায় অভিনয় করতে চাচ্ছেন না। তাই মামুন ভাইয়ের খোঁজ করছেন। বিষয়টি মামুন ভাইকে অবগত করি এবং দাদা নিজে থেকেই আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কোন দৃশ্য করতে চাচ্ছ’? এর মাস খানেকের মধ্যেই আমার নিজের পরিচালনা করা একটি নাটক ‘কনে দেখা’তে পীযূষদাকে নিয়ে কাজ করলাম। তাঁর সব গুণের কথাই সর্বজনবিদিত তাই অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার আজকের লেখার বিষয় নয়। আমি এসব এর দেখেছিও কিঞ্চিৎ। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার অন্তত একটি অধ্যায় আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে সেই অভিজ্ঞতাটা লিখেই দাদাকে জন্মদিনের অর্ঘ্য দিতে চাই এই শরতে।
শিরোনামেই উল্লেখ করেছি, তিনি আসলে সংগঠক নন, তিনি নিজেই একটি সংগঠন। সম্ভবত সালটা ২০১৬ হবে। পীযূষ দা একদিন আমাকে বললেন তৈরি হও। মাগুরায় একটি উপনির্বাচন হবে সেই নির্বাচনে কাজ করতে যেতে হবে। আমিও উৎসাহ নিয়েই প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। ধারণা করতে থাকলাম নিশ্চয়ই দলেবলে বেশ কিছু লোক আমরা ঢাকা থেকে যাব। যাত্রার সময় যখন আসল তখন জানলাম। যাচ্ছেন পীযূষ দা একাই আমি শুধু তাঁর সঙ্গে যাচ্ছি। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, কেমন হবে কাজটা? সবাই দেখি নির্বাচন করতে যায় গাড়ি বহর নিয়ে। আমরা দুই জন গিয়ে নির্বাচনে কি প্রভাব ফেলতে পারব। মাগুরায় পৌছানোর পর বুঝতে পারলাম। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে যান সেখানে দল-বল-সংগঠন কিছুই লাগে না। প্রতিদিন গ্রামের পর গ্রাম আমরা ভ্রমণ করছি। নির্বাচনী সভা করছি। কোথা থেকে যেন লোকজন এসে সভাগুলোকে সফল করে তুলছেন। যারা আসছেন তাদের অধিকাংশেরই এক কথা, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় নামটা শুনেই তারা চলে এসেছেন। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম। জ্ঞান অর্জন করলাম একজন ব্যক্তি একটি নামও একটি সংগঠন হয়ে উঠতে পারে।
সে বছর থেকেই শুরু ২০১৭ সালে এসে সত্যি সত্যি একটি সংগঠন এর জন্ম দিতে দেখলাম পীযূষ দা’কে। আমাকে একদিন বললেন শাহাবগের একটি রেস্তোরাঁয় কিছু লোককে ডেকেছি কথা বলব তাদের সঙ্গে। আমি বাধ্যগত ছাত্রের মত গিয়ে হাজির হলাম। দেখলাম একে একে পত্রিকার সম্পাদক, বিশ^বিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক ভিসি, সাবেক আমলা, কবি-সাহিত্যিক, সংস্কৃতিজন, সমাজকর্মীরা আসতে থাকলেন। আমার অবাক হওয়ার তখনো কিছু বাকি ছিল। যখন জানলাম যারা এসেছেন তাঁরাও আসলে জানেন না কী কথা বলার জন্য তাদের আমন্ত্রণ করেছেন পীযূষ দা। তাঁরা নিজেরাই আলোচনা করছিলেন কী কারনে আজ পীযূষ ডেকেছেন আমাদের? আজ কী পীযূষের জন্মদিন? অবাক বিশ^য়ে লক্ষ করলাম এই বিশাল ব্যক্তিত্বের মানুষেরাও চলে এসেছেন বিষয় না জেনেই। এসেছেন শুধু একটি নাম শুনেই। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি ছবি তুলছি। সব আয়োজন দেখছি আর আমন্ত্রিতদের থেকে দুরে দুরে থাকছি। কারণ, তাঁরা যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, কী কারণে দাদা তাঁদের ডেকেছেন? আমি তো কোনো উত্তরই দিতে পারব না, কারন আমি নিজেই বিষয়টি নিয়ে কিছু জানি না। যথা নিয়মে আলোচনা শুরু হলো কিছুটা আঁচ করতে পারলাম। আসলে দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে ভাবার বা কাজ করবার অভিপ্রায়ে এই আলোচনা। এ ধরনের বেশ কটি সভা হলো, আমন্ত্রিতরা সবাই দাদার সঙ্গে একমত হলেন। দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম স্তম্ভ ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন একটি সাংগঠনিক কাঠামো। অবশেষে ২০১৮ সালের ৭ জুলাই আতœপ্রকাশ করল দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার সংগঠন ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’। আমি পীযূষদার কাছে আজন্ম কৃতজ্ঞ থাকব এই কারনে যে কিভাবে একজন ব্যক্তির উদ্যোগে একটি এতবড় সংগঠন গড়ে উঠতে পারে, তা দেখার এবং এই কার্যক্রমের সঙ্গে আমাকে জড়িত থাকার সুযোগটি তিনি করে দিয়েছেন বলে। আমি প্রায়শই এভাবে বলি, আমি একটি সংগঠন এর জন্ম হতে দেখেছি। দেখতে দেখতে সম্প্রীতি বাংলাদেশ এখন পাঁচ বছর পার করে ছয়ে পা দিয়েছে। সংগঠন বিস্তৃতি লাভ করেছে। এখন জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়েও ছড়িয়ে গেছে ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ এর কার্যক্রম। আমি শুধু ভাবি, কিভাবে একজন ব্যক্তি হয়ে ওঠেন একটি সংগঠন।
সম্প্রীতির প্রয়োজনেই দেশের অনেক জায়গায় গিয়েছি পীযূষদার সঙ্গে। লক্ষ করেছি গ্রাম থিয়েটার করা নিজের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের কারণে শুধু নয়। ব্যক্তি পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক অসাধারণ গ্রহনযোগ্যতার কারণেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় এত কিছু করা।
পীযূষদার গুণের যেকোনো বিষয় নিয়েই পাতার পর পাতা লেখা যায়। তবে এই সংগঠন তৈরির অভিজ্ঞতা বলে দাদাকে জন্ম দিনের অর্ঘ্য দিতে চাই কারন। তিনি অসাম্প্রদায়িক মচেতনার মানুষগুলোর জন্য একটি আশ্রয় তৈরি করেছেন। যতদিন বাঙালি বেঁেচ থাকবে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনাও বেঁচে থাকবে এটা দৃঢ়চিত্তে বলতে পারি। তবে এটিকে একটি কাঠামোতে নিয়ে আসার দায়টি পূর্ণ করেছেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। পীযূষদার জন্মদিনে তাই কামনা তিনি হাজার বছর আয়ু লাভ করুন। শুধু তাঁর বেঁচে থাকার জন্য নয়। আমাদের মত অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ গুলোর বাতিঘর হয়ে থাকার জন্য।
আমি লেখক নই। লেখার অভ্যাসও খুবই কম। তবে এই ব্যক্তিত্বকে যতদিন দেখছি। শুধু অবাকই হচ্ছি না। নতুন কিছু আবিস্কার করছি। মানুষ তার চিন্তার চেয়েও বড় হতে পারে এটা তাঁকে দেখে শিখছি। তাই পীযূষদার জন্মদিনে সামান্য অভিজ্ঞতা লিখে রাখলাম।
শুভ জন্মদিন পীযূষদা।
সাইফ আহম্মেদ, নির্মাতা