সুস্থতা নির্ভর করে দেহের অনুজীবের ওপর
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৬:২৫ পিএম, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ মঙ্গলবার
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথের (NIH) অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন-এর গবেষকরা বলছেন, আমাদের দেহের ‘বিল্ডিং ব্লক’ হচ্ছে সেল বা কোষ, যার সংখ্যা প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন। অন্যদিকে মানবদেহে অণুজীবের সংখ্যা ৩৯ ট্রিলিয়ন!
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মাইক্রো ইনোভেশন-এর ডিরেক্টর প্রফেসর রব নাইট মজা করে বলেছেন, "You are more microbe than human; You are about 43% human." অর্থ্যাৎ আমরা হচ্ছি মাত্র ৪৩% মানুষ!
দেহের ৬০% পানি; অণুজীব ১-৩%, ওজন করলে হবে ৯০০-২,৭০০ গ্রাম।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের শরীরে থাকা অণুজীবগুলোর বেশিরভাগ থাকে পরিপাকতন্ত্রের বৃহদান্ত্রে। এছাড়াও থাকে আমাদের মুখ, নাক, ত্বক, পরিপাকতন্ত্র এবং স্ত্রী-প্রজননতন্ত্রে।
বিজ্ঞানীরা এতদিন প্রচলিত পদ্ধতিতে মানবদেহে কয়েকশ'র বেশি জীবাণু শনাক্ত করতে পারেন নি। তবে আধুনিককালে গবেষকগণ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে মানবদেহে দশ হাজারেরও বেশি অণুজীব শনাক্ত করেছেন।
বিস্ময়কর হলো, আমাজন রেইন ফরেস্ট এবং সাহারা মরুভূমিতে যত ধরনের অণুজীব বা জীবাণু পাওয়া যায় প্রায় তত ধরনের জীবাণু পাওয়া যায় আমাদের শরীরে!
মানবদেহের সুস্থতার পেছনে এসব অণুজীবের রয়েছে অসামান্য ভূমিকা। মানবদেহের অণুজীবগুলো মূলত দুই ধরনের- উপকারী এবং ক্ষতিকর। উপকারী অণুজীবগুলোকে বলা হয় প্রো-বায়োটিকস।
ন্যাশনাল ইন্সটিউট অফ হেলথ একটি নতুন প্রজেক্ট চালু করেছে- 'হিউম্যান মাইক্রোবিয়ম প্রজেক্ট'। এর ম্যানেজার ড. লিটা প্রক্টর বলেন, 'আমরা যে খাবার খাই- কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট- এগুলো হজম করার মতো পর্যাপ্ত এনজাইম আমাদের শরীর তৈরী করতে পারে না। আমাদের পরিপাকতন্ত্রে যে সব জীবাণু আছে, এই জীবাণুগুলো কিছু এনজাইম তৈরী করে যা খাবার হজম করতে সাহায্য করে।'
এছাড়াও, পরিপাকতন্ত্রের অণুজীবগুলো ভিটামিন বি-১, বি-২, বি-৫, বি-৭, ভিটামিন কে, ফোলিকস এসিড ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন তৈরী করে থাকে। শুধু তাই নয়, পরিপাকতন্ত্রের এসব অণুজীব গুরুত্বপূর্ণ 'এন্টি-ইনফ্ল্যামাটরি এজেন্ট' তৈরি করে, যা ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। ফলে আমরা থাকি সুস্থ ও নীরোগ।
ইমিউন সিস্টেমের সত্তর শতাংশের অবস্থান আমাদের পরিপাকতন্ত্রে। আমাদের পরিপাকতন্ত্রে রয়েছে বিশাল নার্ভাস সিস্টেম। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের স্পাইনাল কর্ডে যত সংখ্যক নিউরোন রয়েছে সমসংখ্যক নিউরোন রয়েছে আমাদের পরিপাকতন্ত্রের স্নায়ুতন্ত্রে।
সেরোটনিন হলো একটি আনন্দবর্ধক হরমোন। সেরোটনিন এর মাত্রা ঠিক থাকলে আমরা আনন্দে থাকি, মাত্রা কমে গেলে আমরা ভুগি বিষণ্ণতায়। সেরোটনিনের ৭০ শতাংশ তৈরী করে পরিপাকতন্ত্রের নার্ভাস সিস্টেম।
নিউরোট্রান্সমিটার- আমাদের মস্তিষ্কে যত ধরনের তৈরি হয় তত ধরনের তৈরী হয় আমাদের পরিপাকতন্ত্রের স্নায়ুতন্ত্র থেকে। একারণে বিজ্ঞানীরা এখন পরিপাকতন্ত্রের স্নায়ুতন্ত্রকে বলছেন সেকেন্ড ব্রেইন বা বা দ্বিতীয় মস্তিষ্ক!
আসলে পরিপাকতন্ত্রের সুস্থতা দরকার সামগ্রিক সুস্থতার জন্যেই। অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন তৈরী হতে পারে পরিপাকতন্ত্রের অসুস্থতা থেকে। পরিপাকতন্ত্র যদি অসুস্থ থাকে আপনি বিষণ্ণতা, উদ্বেগে ভুগবেন দিনের পর দিন।
পরিপাকতন্ত্রের সুস্থতা নির্ভর করে গাট অর্গানিজম তথা পরিপাকতন্ত্রে যে জীবাণুগুলো আছে তাদের উপর। পরিপাকতন্ত্রের জীবাণুগুলো যত সুস্থ ও প্রাণবন্ত থাকবে পরিপাকতন্ত্র তত সুস্থ ও প্রাণবন্ত থাকবে। এজন্যে প্রয়োজন সুস্থ-সঠিক খাদ্যাভ্যাস।
আপনার খাদ্যাভ্যাসকে এমনভাবে সাজান যেন তা আপনার পরিপাকেতন্ত্রের উপকারী জীবাণুর সংখ্যা বাড়ায়। এজন্যে নিয়মিত খান প্রো-বায়োটিক ফুড।
সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রো-বায়োটিক ফুড হলো টক দই। এতে রয়েছে ২৫০ প্রজাতির ল্যাক্টোবেসিলাস অণুজীব।
এ-ছাড়াও খেতে পারেন পনীর, ঘোল বা মাঠা, লাচ্ছি, ফার্মেন্টেড সয়া দুধ, ফার্মেন্টেড বাধাকপি।
ডায়রিয়ার পর এবং এন্টিবায়োটিক সেবনের পর প্রো-বায়োটিক সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করুন। কেননা ডায়রিয়া পরিপাকতন্ত্রকে দুর্বল করে দেয় এবং অণুজীবের সংখ্যা কমায়। একই ব্যাপার ঘটে এন্টিবায়োটিক সেবনের পর।
উপকারী অণুজীবকে পুষ্ট রাখতে কিছু করণীয়-বর্জনীয়
> দেহে শুধু উপকারী অণুজীব পাঠালেই চলবে না, এদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে পাঠাতে হবে এদের খাবার। অনুজীবের খাবারকে বলা হয় প্রি-বায়োটিকস- মূলত আঁশ সমৃদ্ধ খাবার। কিছু প্রি-বায়োটিক খাবার হচ্ছে আপেল, কলা, টমেটো, ওটস, বার্লি, রসুন, পেঁয়াজ, সয়াবিন, গম, সামুদ্রিক শৈবাল, তিসি, বীজ ও বিন, মটরশুঁটি ও সবুজ শাকসবজি।
> এমন খাবার খাবেন না যা খেলে আপনার উপকারি অণুজীবগুলো কষ্ট পায় বা মারা যায়। যেমন- ডেড ফুড বা মৃত খাবার। প্যাকেটজাত যাবতীয় খাবার ডেড ফুড। অতিরিক্ত ভাঁজাপোড়া-ভূনা খাবারও যত কম খাওয়া যায় ততো মঙ্গল।
> অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক সেবন করা থেকে বিরত থাকুন। চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত মুড়িমুরকির মতো এন্টিবায়োটিক খাবেন না।
> অতিরিক্ত গ্যাস্টিকের ওষুধ সেবন করা থেকেও বিরত থাকুন। ক্যান্সার সৃষ্টির পাশাপাশি দেহের উপকারী জীবাণুকেও ধ্বংস করে ফেলে গ্যাস্টিকের ওষুধ।
> স্ট্রেস, টেনশন বা মানসিক চাপ পরিপাকতন্ত্রের স্নায়ুতন্ত্রকে দুর্বল করে ফেলে। এগুলো থেকে দেহমনকে মুক্ত রাখতে নিয়মিত দুবেলা মেডিটেশন করুন। এতে আপনার পরিপাকতন্ত্রের স্নায়ুতন্ত্র উদ্দীপিত হবে, আপনি সুস্থ থাকবেন। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবেন সুস্থ কর্মময় দীর্ঘ জীবনের দিকে।
এমএম//