ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৭ ১৪৩১

তোমারই হোক জয়

 ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী 

প্রকাশিত : ০৪:৫২ পিএম, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ বৃহস্পতিবার

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্কজনক এই দিনে দানবরূপী হিংস্র ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতাসহ পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে বর্বর-নৃশংসভাবে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে অন্ধকারের অপশক্তি অতি চতুরতায় দেশকে পুনরায় পাকিস্তানে রূপান্তরিত করার সব অপকৌশল অবলম্বন করে। সে সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ অসংখ্য মানুষ জেল-জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। এমন এক দুঃসময়ে অপশক্তির সব কদর্য পরিকল্পনা নস্যাৎ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা পুনরুদ্ধারের কঠিন ব্রতে জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছরের কষ্টের নির্বাসিত জীবন শেষে দেশ ও দলের কঠিন দুঃসময়ে তৎকালীন শাসকদের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞাকে অবজ্ঞা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। বাংলার মানুষের হারিয়ে যাওয়া অধিকার আদায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামরিক শাসনবিরোধী গণআন্দোলন গড়ে তোলেন।

তার সুদক্ষ নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। সরকার গঠনের পর জাতির জনকের হত্যার বিচারের দাবি এবং ঐতিহাসিক এ বিচারিক রায়ের কার্যকর বাস্তবায়নের মতো অবিনস্বর কার্যক্রমের জন্য তিনি চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। জাতীয় সংসদে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলকরণ ছিল শেখ হাসিনার জীবনের অন্যতম বড় অর্জন। প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালনকালীন তার উলে­খযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে-বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অমীমাংসিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন, পার্বত্য চট্টগ্রামে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি এবং ২১ ফেব্র“য়ারিকে ইউনেস্কো কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে স্বীকৃতিসহ দেশ ও জনকল্যাণমূলক অনেক কর্মযজ্ঞের সফল ও সার্থক বাস্তবায়ন।

২০০৮ সালে আবার নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকার দুর্নীতিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং সব ক্ষেত্রে সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে পেরেছিল বলেই ২০১৭ সালের নভেম্বরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের ১৭৩টি দেশের সরকারপ্রধানের মধ্যে সততার জন্য বিশ্বশীর্ষ পাঁচটি আসনের মধ্যে তৃতীয় স্থানে অধিষ্ঠিত হন। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, মাদক ও অপকর্ম-অপরাধের সঙ্গে জড়িত কেউ নিজ দল বা দলের অঙ্গসংগঠনের সদস্য, এমনকি আপন আÍীয় হলেও তাকে ছাড় না দেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি, যা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। সমুদ্র, সীমান্ত, মঙ্গা, মহাকাশ বিজয় তার নেতৃত্বেই সম্ভব হয়েছে।

নানামুখী বৈশ্বিক সমস্যা-সংকট উত্তরণে তার অনুপম ভ‚মিকা এবং সামগ্রিক বিষয়ে সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে। বহুপক্ষীয়-দ্বিপক্ষীয় এবং আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিকসহ সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল ও সংস্থার শীর্ষ নেতৃত্বের স্বীকৃতি শুধু নেত্রীকে নয়, বিশ্বব্যাপী বাঙালি জাতিকে করেছে সুমহান মর্যাদায় সমাসীন। জনগণের স্বার্থে দুরুহ কিছু সিদ্ধান্তের দৃশ্যমান বাস্তবায়ন বস্তুতপক্ষে তার ধীশক্তি ও প্রাগ্র্রসর চিন্তা-চেতনার পরিচায়ক।

বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ অদম্য অগ্রগতিতে এগিয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ৫০ বছরের অধিক অগ্রযাত্রায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কর্মযজ্ঞকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে প্রায় সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন পরিক্রমা তথা আশু-স্বল্প-দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা কার্যকরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ রোডম্যাপে অগ্রসরমান শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, লিঙ্গ সমতা, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, শ্রমঘন রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, বিশেষায়িত ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব উন্নয়ন, পোশাক ও ওষুধ শিল্পকে রপ্তানিমুখীকরণ ইত্যাদি আজ দেশের আর্থ-সামাজিক দৃশ্যপটে সমুজ্জ্বল। অন্যদিকে ভৌত অবকাঠামো, যাতায়াত ব্যবস্থা ইত্যাদিকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি ইত্যাদির সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলাবদ্ধতা নিরসন, সুপেয়-ব্যবহারযোগ্য পানি ও সুয়ারেজ প্রকল্পের মতো বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নসহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণে সফলতা-সক্ষমতা অর্জনে বাংলাদেশ আজ বিশ্বস্বীকৃত।

বিশ্বশান্তির অগ্রদূত শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক-মানবিক-গণতান্ত্রিক সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি-সমৃদ্ধির পথে তার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক বিপুলসংখ্যক পুরস্কারে ভ‚ষিত হয়েছেন। তাছাড়া দেশ-বিদেশের অনেক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। ব্রিটিশ প্রভাবশালী সাময়িক দি ইকোনমিস্ট এক সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এশিয়ার লৌহমানবী (আয়রন লেডি) আখ্যা দিয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা নারী সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। এমনকি নারী ও পুরুষ সরকারপ্রধানদের মধ্যেও তিনি সবচেয়ে উলে­খযোগ্যদের একজন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা তিন দফায় পরিচালিত সরকারের নারী উন্নয়নে অভ‚তপূর্ব অর্জন শুধু দেশে নয়, বিশ্ব পরিমণ্ডলেও স্বীকৃত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের অদম্য উন্নয়ন-অগ্রগতি পরিক্রমায় নারী উন্নয়নে গুরুত্বারোপ অব্যাহত রেখেছেন। তার দৃঢ় নেতৃত্ব, সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও প্রজ্ঞার অপূর্ব সম্মিলন দেশের নারী সমাজের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে অনন্য নজির স্থাপন করেছে। নারী শিক্ষার বিকাশ, নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা, নারী সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণয়ন এবং কর্মক্ষেত্র-রাজনীতিতে নারীর অবাধ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে তার কর্মযজ্ঞ অতুলনীয়। মার্কিন অর্থ ও বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী ফোর্বসের ২০২২ সালের বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ৪২তম অবস্থানে। নারীর উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন, অধিকার প্রতিষ্ঠায় নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারীসমাজকে এগিয়ে নেওয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নসহ সব ক্ষেত্রে প্রাগ্রসরতা ন্যূনতম বিবেকপ্রসূত ব্যক্তির কাছেও গুরুত্ব পেয়েছে। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা তথা ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার সফল বাস্তবায়নের কর্মযজ্ঞ অব্যাহতভাবে এগোচ্ছে, যার ধারাবাহিকতা একান্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে তরুণ প্রজ ন্ম তথা দেশের ৩২ শতাংশ জনগোষ্ঠীর অমিত সম্ভাবনাকে ফলপ্রসূ ও কার্যকর করার জন্য আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত যুগোপযোগী শিক্ষা কার্যক্রম, তথ্যপ্রযুক্তি, কারিগরি দক্ষতায় উৎকর্ষ অর্জন এবং যথোপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা বাস্তবায়নে জননেত্রী শেখ হাসিনার অভাবনীয় পদক্ষেপগুলো প্রশংসনীয়। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের বজ কঠিন ব্রত তথা বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জোরালো অঙ্গীকারের প্রতিফলন বঙ্গবন্ধুকন্যার চিন্তা ও কর্মে জাতি অবলোকন করে চলেছে। বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার মাঝে লুকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা ও দেশবাসীর ধ্যান-ধারণা। আজকের এই দিনে মহান স্রষ্টার কাছে এই মহীয়সী নেত্রীর ঝুঁকিমুক্ত-নির্ভয়-নির্ভার জীবন, সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু প্রত্যাশা করছি। জ ন্ম দিন শুভ হোক। অজস্র মহিমায় কল্যাণময় হোক।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এসবি/