সড়কে ঝরছে তাজা প্রাণ , নিভে যাচ্ছে সম্ভাবনার আলো!
তানভীর সুমন
প্রকাশিত : ০৭:২৭ পিএম, ২ অক্টোবর ২০২৩ সোমবার
সড়ক দুর্ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় হারাচ্ছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বিশ্বে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। সংস্থাটি দাবি , বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ক্ষতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আর সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের ৬৭ শতাংশই ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঝুঁকিতে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীরা।
এমনই একজন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর সীমা খাতুন । ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী । অনেক সংগ্রামের পর, মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, কুষ্টিয়া জেলার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কুমারখালি সরকারি ডিগ্রী কলেজে। স্বপ্ন দেখতেন স্বনির্ভর হয়ে জীবনকে আরেকটু সুন্দর করার। চাকরি নেন ব্রাক এনজিওতে। শুরু হয় জীবন যুদ্ধ। জীবনের একটা সময় এসে সহযুদ্ধা হিসাবে হারুন প্রামাণিককে বিয়ে করেন। হারুর পরামানিকের বাড়ি ছিলো একি থানার,নন্দলালপুর ইউনিয়নের বুজরুক বাঁখই গ্রামে । এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের, শুরু হয় শুধু এগিয়ে চলা। এক বাচ্চা আর স্বামীকে নিয়ে ভালোই চলছিল সীমার সংসার। কিন্তু গতকাল সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন সিমা খাতুন। পরিসমাপ্তি ঘটে এক সংগ্রামী জীবনের।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল সন্ধ্যায় অফিসের কাজ শেষ করে স্কুটি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন সীমা। বাড়ি ফেরার সময় কুষ্টিয়া - রাজবাড়ী আঞ্চলিক মহাসড়ক, চড়াইকোল রেল স্টেশনের পাশে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান সীমা। পরবর্তীতে ফায়ার সার্ভিস ও কুমারখালী থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মরদেহ উদ্ধার করে হাইওয়ে পুলিশের নিকট সোপর্দ করেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যানে,শুধু মাত্র ২০২২ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬ হাজার ৮২৯টি। নিহত হয়েছেন ৭ হাজার ৭১৩ জন এবং আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৬১৫ জন। দুর্ঘটনায় ১৮ হাজার ৪৬ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী— প্রতিবছর সড়কে প্রায় ৮ হাজার মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি ৮০ হাজার মানুষের পঙ্গুত্ব বরণ করে। যার মধ্যে ১৭ বছরের কম বয়সী শিশু ১২ হাজারের বেশি
কিন্তু নিরাপদ সড়কের দাবিতে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নিয়মিত সড়ক পরিসংখ্যান অনুযায়। গত চার বছরের দুর্ঘটনার তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫ হাজার ২১১ জন। পরের বছর সংখ্যাটি বেড়ে হয় ৫ হাজার ৪৩১। ২০২১ সালে সড়কে নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন। সর্বশেষ ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সড়কে মৃত্যু হয়েছে ৬ হাজার ৫৪৮ জনের। এর মধ্যে গত জুলাইয়ে সর্বোচ্চ ৭৩৯ জন নিহত হন।সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই হতদরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৮১ শতাংশ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতরা তাদের পরিবারের প্রধান বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে এসব পরিবার আর্থিকভাবেও সংকটে পড়ছে।
তবে আতঙ্কের বিষয়, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এই বছরের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী। শুধুমাত্র আগস্ট মাসে দেশে ৪০৩টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৩৭৮ জন এবং আহত ৭৯৪ জন। এছাড়াও গত জুলাই মাসে ৫১১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৭৩ জন নিহত । আগস্টে নিহত ৩৭৮ জনের মধ্যে নারী ৪৪ ও শিশু ৫১ রয়েছে। ৪০৩টি সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে ১৪২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১৪৬ জন, যা মোট নিহতের ৩৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। পথচারী নিহত হয়েছে ৯৩ জন, যা মোট নিহতের ২৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৫৭ জন, অর্থাৎ ১৫ দশমিক ০৭ শতাংশ।
তবে বিশিষ্টজনদের অভিমত—বছর বছর মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা বৃদ্ধি, নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ছোট ও ধীরগতির যানবাহনের চলাচলের কারণে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। এছাড়াও নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, নজরদারির অভাব ও আইনের বাস্তবায়ন না হওয়া, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যর্থতা। আর সাম্প্রতিক সময়ে ভাড়ায় চালিত (রাইড শেয়ারিং) ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের মোটরসাইকেলের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
তবে সবার জন্য নিরাপদ সড়ক করতে চাই, এই স্লোগানে চার বছর আগে ২০১৮ সালে আন্দোলন করেছিল শিক্ষার্থীরা। তখন সড়কে সাময়িক শৃঙ্খলা ফিরলেও বর্তমান পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দেয়া আশ্বাস এত বছর পরেও আশ্বাসে রয়ে গেছে। তাইতো রক্ত পিপাসুর মত সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিদিনই গিলে খাচ্ছে সীমাদের প্রাণ। যার কারণে দেশ হারাচ্ছে স্বনির্ভর সীমাদের। তবে জানিনা সীমাদের হারানোর ক্ষত সেরে উঠলেও, পরিবার ও রাষ্ট্র যে কর্মক্ষম হাত দুটি হারিয়েছে ,সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে কিনা?