ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

তামাকমুক্ত বাংলাদেশের পথে একটি বাস্তব পদক্ষেপ

বারেক কায়সার

প্রকাশিত : ০৩:৩৬ পিএম, ৯ অক্টোবর ২০২৩ সোমবার

সারাবিশ্বে অসুস্থতা ও মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো ধূমপান। প্রতি বছর ধূমপানের কারণে ৮০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায় যার প্রায় ৯৯ শতাংশ ঘটে তামাকজনিত ধূমপানের কারণে - নিকোটিন সেবনের কারণে নয়। 

বিশ্বের নানা দেশের মতো বাংলাদেশও কয়েক দশক ধরে তামাক মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে ৬২ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী রয়েছে। তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে এবং এখন সময় এসেছে কোন পদ্ধতিতে কার্যকরভাবে তামাকের ক্ষতি হ্রাস করা যায় তা পুনর্বিবেচনার। তামাকের ক্ষতি হ্রাস করার জন্য নিকোটিনকেই প্রাথমিক কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে এতদিন ভুলভাবে তামাকের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসা হয়েছে ।

মূলত, নিকোটিন একটি প্রাকৃতিক উপাদান যা বিভিন্ন শাকসবজি এবং গাছপালা, প্রধানত তামাকের মধ্যে পাওয়া যায়। যদিও, নিকোটিন আসক্তির উদ্রেক করে, তবে এটি রোগ সৃষ্টি করে না। ধূমপানের কারণে উদ্ভূত স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলো সাধারণত তামাকের দহন প্রক্রিয়া থেকে উৎপন্ন হয়। সিগারেটের ধোঁয়ায় ৭ হাজারেরও বেশি রাসায়নিক উপাদান রয়েছে যার মধ্যে অন্তত ২৫০টি স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হানিকর, যেমন হাইড্রোজেন সায়ানাইড, কার্বন মনোক্সাইড এবং অ্যামোনিয়া। কিছু উপাদান তামাক গাছেও পাওয়া যায় তবে বিষাক্ত উপাদানগুলোর প্রায় সবগুলোই সিগারেটের দহন থেকে উৎপত্তি হয়। 

ওয়ার্ল্ড ভ্যাপার্স অ্যালায়েন্স-এর পরিচালক মাইকেল ল্যান্ডল এবং কনজিউমার চয়েস সেন্টার-এর রিসার্চ ম্যানেজার মারিয়া চ্যাপলিয়া 'নিকোটিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধের ছয়টি কারণ' শিরোনামে লেখা একটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র ৬টি কারণ তুলে ধরেছে যে কেন নিকোটিন শত্রু নয় এবং কেন এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ  বন্ধ করার সময় এসেছে।

ধূমপান সংক্রান্ত ক্ষতির ক্ষেত্রে নিকোটিনের দায় সবচেয়ে বেশি নয় বরং তামাকের ধোঁয়ায় হাজার হাজার বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয় যা স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করে। তাই জনস্বাস্থ্যের উন্নতিতে, ধূমপায়ীদের ধূমপান ত্যাগ করার সম্ভাব্য সকল বিকল্প দিতে হবে। নিকোটিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফলে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি তো হবেই না বরং কম ক্ষতিকর বিকল্পগুলোর দিকে যেতে ধূমপায়ীদের নিরুৎসাহিত করবে। ইয়র্কশায়ার ক্যান্সার গবেষণায় বলা হয়েছে যে, ধূমপানের ফলে মৃত্যুর কারণ নিকোটিন নয়, এবং শুধুমাত্র নিকোটিনের ফলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে এমন কোনো প্রমাণও নেই। ধূমপানের ফলে মৃত্যুর তিনটি প্রধান কারণের মধ্যে (ফুসফুসের ক্যান্সার, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ এবং কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ) কোনোটিই নিকোটিনের কারণে হয় না।

নিকোটিন প্রতিস্থাপন থেরাপিতে নিকোটিনকে কোনো সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করা হয় না, তাই এটি ভ্যাপিং বা স্নাসের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হতে পারে না। রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস ধূমপানের পরিবর্তে ভ্যাপিংয়ের ভূমিকায় উল্লেখ করেছে: “ই-সিগারেটগুলি একটি আদর্শ তামাক ক্ষতি-হ্রাসকারী বিকল্প হিসেবে কাজ করে। ই-সিগারেট ধূমপানের ক্ষতিকর উপাদানগুলো ছাড়াই নিকোটিন নির্গমন করতে পারে। ভ্যাপিং ধূমপানের চেয়ে ৯৫ শতাংশ কম ক্ষতিকারক বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং একাধিক আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে নিরাপদ বিকল্প হিসাবে সমর্থন করেছে। বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারকেরা যদি এটি সমর্থন করে তবে বিশ্বজুড়ে ২০ কোটি জীবন বাঁচানো যেতে পারে।

নিঃসন্দেহে নিকোটিন ডোপামাইন নিঃসরণকে ত্বরান্বিত করে ধূমপানে আসক্তি তৈরি করে। তবে এটি ধূমপান ত্যাগ করতে ব্যর্থ হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। যদি নিকোটিনই ধূমপানের একমাত্র কারণ হতো, তাহলে নিকোটিন প্যাচ ব্যবহারকারী প্রত্যেকে ধূমপায়ীই ধূমপান ত্যাগ করতে সক্ষম হতো। ধূমপায়ীদের আসক্তি নির্ভর করে সাধারণত নিকোটিন ও তামাকের ধোঁয়ার সাথে অন্যান্য উপাদানের সংমিশ্রণের উপর কিছু বিহেভিয়ারাল  বেপারও আছ, যেমন, কফি ব্রেক একসাথে আড্ডা ইত্যাদি যা ধূমপায়ীদের নিকোটিন ব্যবহার বাড়িয়ে দেয় কিংবা একত্রে ধূমপান করা। একটি গবেষণার মাধ্যমে এনআরটি, ভ্যাপিং এবং ধূমপানের মধ্যে আসক্তির মাত্রা তুলনা করে দেখা গিয়েছে যে, বেশিরভাগ ভ্যাপার ধূমপায়ীদের তুলনায় অনেক কম আসক্তি অনুভব করে কারণ ভ্যাপিংয়ে তামাকের অনুপস্থিতি ও নিকোটিনে আসক্তি কম। তাই আসক্তির ক্ষেত্রে নিকোটিনকে আলাদা করে বিবেচনা করা উচিত নয়। 

কয়েক দশক ধরে নিকোটিনকে ধূমপানের সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে কারণে অনেকেই বিশ্বাস করে যে ধূমপানের ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলোর প্রধান কারণ হলো নিকোটিন। এটা স্পষ্ট যে, যারা নিকোটিন নেয়া শুরু করেন নি তাদের জন্য নিকোটিন না নেয়াটাই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পন্থা, কিন্তু নিকোটিনকে মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে এটা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা নিয়েই মূল্যয়ন করা উচিত, শুধুমাত্র এন্টি-টোব্যাকো এজেন্ডার জন্য এটার বিরোধিতা করা ঠিক নয়। স্বাস্থ্যগতভাবে  নিকোটিনের কিছু উপকারী দিকও আছে যা বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত এবং শুধুমাত্র ধূমপানের খাতিরে নিকোটিনের উপকারী দিক গুলো সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করাও ঠিক হবে না । নিকোটিনের থেরাপিউটিক সুবিধাসহ কিছু ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে যেমন বৃদ্ধির বিকাশ, পারকিনসন্স রোগের সম্ভাব্য চিকিত্সা, ক্ষুধা দমন ও ব্যায়ামের সহনশীলতা বৃদ্ধি। এবং গতানুগতিক চিন্তাভাবনাগুলো এই যুক্তিগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে রাখে যা মোটেও উচিত নয়। 

তুলনামূলক কম ধূমপায়ী যারা ধূমপান ছাড়তে অক্ষম তারা কম ক্ষতিকারক বিকল্প যেমন ভ্যাপিংয়ের দিকে ঝুঁকছেন। ধূমপায়ীরা যদি বিশ্বাস করে যে নিকোটিন স্বাস্থ্য ঝুঁকির প্রধান কারণ তাহলে তাদের     জন্য সিগারেট  ছেড়ে নিরাপদ বিকল্পকে যহন করার কোনো কারণ নেই। এতে সকলের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত কারণ তারা যদি সত্যিকারের জনস্বাস্থ্যের উন্নতি করতে চান তবে প্রত্যেক ধূমপায়ীকে অন্তত নিকোটিন গ্রহণের জন্যে কম ক্ষতিকারক বিকল্পগুলোকে গ্রহণ করতে উৎসাহী করা উচিত। যদি ধূমপায়ী, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ জনগণকে ধূমপানের প্রকৃত বিপদ সম্পর্কে অবগত করা যায়, তবেই এটি সম্ভব। 

অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি যে, নিকোটিন নিষিদ্ধকরণ নিকোটিনের কালোবাজার বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। ক্লাইভ বেটসের মতে, "যারা কালোবাজারের সাথে সংযুক্ত তারা গ্রাহকের বয়স যাচাই না করেই এইসকল পণ্যগুলো বিক্রি করে থাকে।” তাই, নিকোটিন সেবন একেবারে বন্ধ করার চেয়ে নীতি নির্ধারকদের উচিত এর ব্যাতিক্রমী সমাধান অন্বেষণ করা। কারণ, ধূমপানের ক্ষেত্রে নিকোটিন প্রধান সমস্যা নয়, সমস্যা হলো বিষাক্ত পদার্থ। যা তামাকের দহন থেকে উৎপন্ন হয়।আর এর বাস্তবমুখী সমাধান হলো কম ক্ষতিকারক বিকল্পগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধি করা। তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এবং জনস্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নতিতে ধূমপায়ীদের কম ক্ষতিকারক বিকল্প ব্যবহারে উৎসাহিত করা উচিত। 

লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, রাশিয়া।