ঋণ কেন করবেন না
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:০১ এএম, ১৪ অক্টোবর ২০২৩ শনিবার | আপডেট: ০৮:২৬ পিএম, ১৪ অক্টোবর ২০২৩ শনিবার
বাংলার গ্রামীণ সমাজের শ্রেণীবিভেদ আর দুর্বলের উপর সবলের অনাচার-অবিচার নিয়ে লেখা রবিঠাকুরের অমর কবিতা ‘দুই বিঘা জমি’। বাংলা সাহিত্যের সবচাইতে বিখ্যাত পদ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম এই কবিতাটির পটভূমি আমাদের চেনা গঙ্গা/পদ্মা পারেরই কোন গ্রাম, আর মূল চরিত্র ভূমিহীন উদ্বাস্তু একজন কৃষক, যে তার হারানো জমিকে একবার দেখার আশায় নিজ গ্রামে ফিরে আসে। দুই বিঘা জমি বাংলার কৃষকের চিরন্তন দুঃখের একটি কবিতা, আর সে কারণেই বাঙালির মানসে কবিতাটির স্থান বিশেষ উচ্চতায়।
ঋণ এবং দাসত্ব সমার্থক। এটা আজকের কথা না এটা ক্রিশ্চিয়ান সেন্টদের বক্তব্য। ১৬ শতাব্দী পর্যন্ত সমস্ত খ্রিষ্টানধর্মীয় পুরুষরা ঋণকে একটা অত্যন্ত জঘন্য পাপাচার হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ঋণের দুরাবস্থা নিয়ে ৩৬৫ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট বাসিলের বক্তব্য…
প্রত্যেকদিন এবং রাত খাতকের (ঋণগ্রস্থ) জন্যে একটা দুঃসহ যন্ত্রণা। তার জীবন হয়ে যায় স্লিপলেস এবং একটা অনিশ্চয়তায় সে সবসময় ভোগতে থাকে। যখন মানুষের সামনে যায় সে লাঞ্ছিত হয়। যখন সে ঘরে থাকে তখন সে চৌকির নিচে লুকিয়ে থাকে। প্রত্যেকটা অপ্রত্যাশিত নক, নক অন দি ডোর দরজার প্রত্যেকটা ঠকঠকানিতে সে চমকে ওঠে যে, এই বুঝি পাওনাদার এলো। রাতে তার ঘুম ভেঙে যায় দুঃস্বপ্নে যে, পাওনাদার বোধ হয় তার বালিশের পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে। ঋণ এত খারাপ জিনিস।
৩৮০ খ্রিষ্টাব্দে ঋণগ্রস্ত পিতারা বাধ্য হতেন সন্তানদের বিক্রি করে দিতে…
সেন্ট এম্ব্রোস ৩৮০ খ্রিষ্টাব্দে মিলানের একটা ঘটনা যে, যারা ঋণগ্রস্ত পিতা তারা বাধ্য হচ্ছেন তাদের সন্তানদের বিক্রি করে দিতে ক্রীতদাস হিসেবে। ঋণী লজ্জায় আত্মহত্যা করছে এবং এই কারণে তিনি তার লেখনীতে বলেছেন, সুদি ব্যবসা ঋণী ব্যবসা এটাকে ডাকাতি এমনকি খুনের সাথে তুলনীয়।
আর সুদের ব্যবসা যারা করেন ঋণের ব্যবসা যারা করেন তাদের এটা খুন বা ডাকাতির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
আসলে কিস্তির সাথে কী থাকে? আপনি কিস্তিতে কেনেন বা ঋণ করে কেনেন, কিস্তির সাথে সবসময় সুদ থাকে।
ঋণ এবং ধার দুটো ভিন্ন
তো ঋণ এবং ধার দুটো কিন্তু এক জিনিস না। আপনি ভাইয়ের কাছ থেকে ধার নিলেন চাচার কাছ থেকে ধার নিলেন বাবার কাছ থেকে ধার নিলেন এটার সাথে সুদ জড়িত না। এটা আলাদা জিনিস। বন্ধুর কাছ থেকে নিলেন এটা আলাদা জিনিস এটার জন্যে আপনাকে কোনো লাভ দিতে হচ্ছে না। ঋণ এবং কিস্তি যেভাবে সর্বনাশ ডেকে আনে!
যে ধারের সাথে বা যে লেনদেনে সুদ জড়িত সেটাই হচ্ছে ঋণ এবং এই কিস্তি সবসময় সর্বনাশ করে। কীভাবে?
আমরা একটা হিসাব করেছিলাম। হিসাবে দেখা গেল যে, ১২০ কিস্তিতে আপনি টাকাটা শোধ করবেন। প্রতি কিস্তি ১২১০ টাকা। প্রথম কিস্তিতে ১২১০ টাকার মধ্যে সুদ থাকবে ১১৪৬ টাকা ১৫ পয়সা। এটা হচ্ছে সুদ। আসল শোধ করছেন ৬৩ টাকা ৮৫ পয়সা।
তো যেখানেই ঋণ থেকে কিস্তি। কিস্তির হার কিন্তু ব্যাংকের একটাই। সেটা আপনি ফ্ল্যাট বানান, সেটা আপনি বাড়ি বানান, সেটা আপনি ব্যবসায় নেন যেটাতেই নেন।
তাহলে প্রথমবার কী করলেন? ১২১০ টাকার মধ্যে আসল শোধ করলেন ৬৩ টাকা ৮৫ পয়সা। দ্বিতীয়বার যখন দিচ্ছেন তখন ১১০৭ টাকা সুদ ১০২ টাকা আসল শোধ হলো। তৃতীয় কিস্তিতে আবার ১১৪২ টাকা সুদ ৬৭ টাকা আসল। এই হচ্ছে ফরমুলা।
প্রথম ৯০ কিস্তি পর্যন্ত শুধু সুদ। অর্থাৎ আসলের চেয়ে সুদ বেশি। মানে এক লক্ষ টাকা দেয়ার পরও দেখবেন আপনার ৫০ হাজার টাকার মধ্যে ৩০ হাজার টাকা আসল রয়ে গেছে। যখন আপনি এরপরের কিস্তিগুলোতে আসবেন শেষ কিস্তিতে এসে আসল বেশি সুদ কম। উল্টোটা তখন দাঁড়াবে।
সাধারণত মানুষ কখন ঋণ করে? ঋণ মানুষকে কী করে?
সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দেয় সেটা হচ্ছে ঋণশোধ করার দুশ্চিন্তা। সাধারণত ঋণ করে মানুষ কখন? ঋণ করে দুই সময়, সাধারণত বিয়ে এবং শ্রাদ্ধে। মুসলমানদের চল্লিশা এবং সনাতন হিন্দুদের হচ্ছে শ্রাদ্ধ।
শ্রাদ্ধের যে খরচ ট্রিমেন্ডাস খরচ। এটা চিন্তা করা খুব ডিফিকাল্ট। মানে বাবার সব বন্ধুদের দাওয়াত দিতে হবে এবং যত ধরনের আইটেম পছন্দ করতেন সব আইটেম দিয়ে তাদেরকে খাওয়াতে হবে।
আর বিয়ে তো ধুমধাম না করলে হয় না। উপেনের সে যে বিখ্যাত কাহিনী- মেয়ের বিয়ে ধুমধাম করবি না? আরে সম্পদ টাকা-পয়সা নাই তাতে কি? নে টাকা। মেয়ের বিয়ে তো আর দ্বিতীয়বার দিতে পারবি না।
তো নেপালের ঘটনা এই ডেট বইতে পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে খুব করুণ ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে যে, বর্ণবাদী প্রথা। এই নিম্নবর্ণের লোকদের কষ্টটা সবচেয়ে বেশি।
নেপালে মেয়ের বিয়ে দেবে ধুমধাম করতে হবে। মহাজন ঋণ দিলেন। মেয়ের বিয়ে হলো। বিয়ের পরদিন সকালবেলায় ঐ মহাজনের বাড়িতে মেয়েকে চলে যেতে হবে এবং ওখানে মহাজন যতদিন খুশি তাকে রাখবে।
যদি ঋণশোধ করার জন্যে তাকে পতিতালয়ে পাঠাতে হয় পতিতালয়ে পাঠিয়ে দেবে। যখন মনে করবে যে, ঋণশোধ হয়েছে তারপরে সে গ্রামে ফিরে আসবে এবং তারপরে সংসার শুরু করবে।
তো আসলে আপনার এই ঋণ থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত পরিত্রাণ নাই।
ঋণ থেকে মুক্তি লাভের জন্য নবীজী (সা.) একটা দোয়া শিখিয়ে দিতেন। সে দোয়াটি হচ্ছে, হে আল্লাহ! দুশ্চিন্তা ও দুর্দশাগ্রস্ত হওয়া থেকে অক্ষমতা ও আলস্য থেকে আমি তোমার আশ্রয় গ্রহণ করছি। হে আল্লাহ! ভীরুতা ও কৃপণতা থেকে ঋণজর্জরিত পরাভূত হওয়া থেকে আমি তোমার আশ্রয় গ্রহণ করছি।
আপনি বলবেন যে, ঋণ এত ঝামেলার কেন? রসুলুল্লাহ (স) বলেন, যে ব্যক্তি ঋণী হয় সে যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে।
অথর্ববেদে ষষ্ঠ অধ্যায় শ্লোক ১১৭-১১৯ প্রার্থনা আছে একটা ১৭-১৯ শ্লোকে, ইহলোকে উত্ত উত্তমর্ণের কাছে সকল ঋণশোধ করার শক্তি দাও। তোমার প্রসাদে আমার সকল ঋণ থেকে মুক্ত করো। ঋণ নিমিত্ত নরকপাত থেকে আমায় মুক্ত করো। অর্থাৎ হিন্দুশাস্ত্রেও কিন্তু ঋণশোধ না করলে নরক বাস নিশ্চিত। লৌকিক ও বৈদিক সকল ঋণ থেকে মুক্ত করো। দেহত্যাগের পর সর্বলোকে আমাকে মুক্ত করো।
অথর্ববেদে এই যে প্রার্থনা এটাও কিন্তু ঋণমুক্তির প্রার্থনা।
যদি মৃত ব্যক্তি দেনাগ্রস্ত হতো নবীজী (স) তার জানাজায় অংশ নিতেন না! তো বিশিষ্ট সাহাবী মোহাম্মদ ইবনে জাহাশ একটা ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, একবার আমি রসুলুল্লাহর সাথে বসে আছি, এমন সময় তিনি আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালেন হাতের তালু কপালে রেখে বলে উঠলেন, সুবহানাল্লাহ! কী কঠোর একটা নির্দেশ আমার ওপর নাজিল করা হলো।
ইবনে জাহাশ বলেন যে, আমরা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না। পরদিন সকালে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রসুলুল্লাহ! কী কঠোর নির্দেশ নাজিল করা হয়েছে? তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জেহাদ করে শহিদ হওয়ার পর যদি কারো জান ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং আবারও সে শহিদ হয় তারপর আবার তাকে জীবিত করা হয় আবারও সে শহিদ হয় যতবারই সে শহিদ হোক, শহিদ হওয়ার পরও সে ঋণশোধ না করা পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি পাবে না।
ঋণগ্রস্ত হওয়াটাকে নবীজী (স) কত অপছন্দ করতেন সেটা বোঝা যায় তার জানাজা পড়ানোর ঘটনা থেকে। তিনি যখনই কারো জানাজা পড়াতেন আগে খোঁজ নিতেন যে, মৃতের কোনো ঋণ আছে কিনা। যদি মৃত ব্যক্তি দেনাগ্রস্ত হতো তিনি জানাজায় অংশ নিতেন না। তো ঋণগ্রস্ত হলে তার শাফায়াত পাওয়া যাবে? যিনি নিজের চোখের সামনের ঋণগ্রস্ত মৃতের জানাজা পড়াতেন না।
অতএব ঋণের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকবেন।
এমনকি একবার জানাজা পড়াতে গিয়ে তিনি তিনি শুনলেন মৃত ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত এবং সে কোনো সম্পদ রেখে যায়নি যেখান থেকে ঋণশোধ করা যাবে। তিনি সাহাবীদের বললেন, তোমরা জানাজা পড়ও। কতটুকু ঋণ খোঁজ নেয়া হলো। ঋণ খুবই অল্প দুই বা তিন দিনার। উপস্থিত আরেক সাহাবা আবু কাদাতা আরজ করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমি এই ঋণের জিম্মাদার হলাম। তখন নবীজী (স) জানাজায় ইমামতি করলেন।
ঋণশোধের ব্যাপারে নবীজী (স) যে কারণে তাগাদা দিতেন… কারণ ঋণ হচ্ছে একটা নেশা আফিমের নেশার মতো। ঋণ একটা আসক্তি। যে একবার ঋণের স্বাদ পায় সে ঋণ ছাড়া অন্য কোনো অর্থে সে কোনো স্বাদ পায় না খুঁজে। তো ঋণ করার ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতে হবে।
জানাজা পড়ানোর পরদিন আবু কাদাতার সাথে দেখা হতেই নবীজী (স) জিজ্ঞেস করলেন, ঋণটা কি শোধ করেছ? আবু কাদাতা বললেন যে, পাওনাদারের পুরো প্রাপ্য পরিশোধ করা হয়েছে। নবীজী (স) স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, এখন সে শান্তি পাবে।
অতএব যাদেরই মা-বাবার ঋণ আছে একটু খোঁজ নেবেন, যদি হাতে পায়ে ধরেও হয় তাকে ঋণ করতে নিরুৎসাহিত করবেন। ঋণশোধ করার ব্যাপারে নবীজী (স) তাগাদা দিতেন এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, একজন বিশ্বাসীর আত্মা ঐ ঋণশোধ না করা পর্যন্ত প্রশান্তি পায় না সে ঝুলে থাকে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে না।
সাহাবীরা এবং পরবর্তীকালে তাবে তাবেঈন এবং সমস্ত বুজুর্গরা প্রত্যেকেই ঋণমুক্ত হয়ে মারা যাওয়ার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছেন।
হযরত জালাল উদ্দিন রুমি যখন মৃত্যুশয্যায় হঠাৎ তার মনে পড়ল, তার কাছে একজন ৫০ দিরহাম পাবে। ৫০ দিরহাম কিন্তু খুব বেশি না রৌপ্যমুদ্রা। ৫০ দিরহাম পাবে। ঋণের কথা মনে পড়ার সাথে সাথেই তিনি সক্রিয় হয়ে উঠলেন এবং ৫০ দিরহাম সংগ্রহের চেষ্টা শুরু করলেন যে, কীভাবে সংগ্রহ করা যাবে। এর মধ্যে যে পাবে সে পাওনাদার তারই ভক্ত। সে যখন শুনল যে, হুজুর অস্থির হয়ে গেছে সেও দৌড়ে আসল। তো জালাল উদ্দিন রুমিকে বলল যে, হুজুর আমার পাওনা আমি মাফ করে দিলাম। আমার কোনো দাবি নাই, আমি এটা উপহার হিসেবে উপহার দিলাম।
তখন রুমি শান্তির স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন যে, তুমি আমাকে বাঁচালে। আলহামদুলিল্লাহ! একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া থেকে আমি বেঁচে গেলাম।
নবীজী (সা.) ঋণের ব্যাপারে এত কঠোর হওয়ার কারণ হচ্ছে, একজন মানুষ যখন ঋণ করে তার চিন্তার বড় অংশ জুড়ে থাকে কীভাবে এই ঋণশোধ করবে। তার এই চিন্তা থেকে সে কিন্তু বের হতে পারে না। পাওনাদারের সামনে সে সবসময় সংকুচিত হয়ে থাকে। সে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, অমুক দিন দেবো কিন্তু সে দিতে পারে না এবং যখন দিতে পারে না তখন আবার প্রতিশ্রুতি দেয়।
এএইচ// এমএম