গাজায় স্থল অভিযান চালিয়ে কী অর্জন করতে পারবে ইসরায়েল?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৫:২৪ পিএম, ১৫ অক্টোবর ২০২৩ রবিবার
হামাস নেতাদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন ইসরায়েলের নেতারা এবং বলেছেন 'গাজা আগে যা ছিলো সেই অবস্থায় আর কখনো ফিরে যাবে না'।
“প্রতিটি হামাস সদস্য একজন মৃত ব্যক্তি,” হামাস যোদ্ধাদের ইসরায়েলে হামলা চালানোর ঘটনায় ১৩০০ মানুষ নিহত হবার পর এমন মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
গাজার সম্ভাব্য অভিযানের নাম দিয়েছে ইসরায়েল- দ্যা অপারেশন সোর্ডস অফ আয়রন। ধারণা করা হচ্ছে, গাজার ইতিহাসে যত সামরিক পরিকল্পনা এর আগে হয়েছে, এটি হবে তার যে কোনটির চেয়ে অনেক বেশি জোরালো অভিযান।
কিন্তু এটা কি বাস্তবসম্মত সামরিক অভিযান? সামরিক কমান্ডাররা কীভাবে এটিকে সফল করে তুলবেন?
গাজা উপত্যকায় স্থল অভিযান মানে হলো শহরের ঘরে ঘরে লড়াই, যা বেসামরিক নাগরিকদের জীবন ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে।
বিমান হামলায় এর মধ্যেই শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং চার লাখেরও বেশি মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
এখন ইসরায়েলির সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব হলো ১৫০ জন জিম্মিকে উদ্ধার করা, যাদের গাজার অজানা জায়গায় রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ হারজি হালেভি হামাসকে ‘বিলুপ্ত’ করে দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন এবং এর একজন নেতাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন।
কিন্তু তাহলে হামাসের ষোল বছরের সহিংস শাসনের পর গাজা কেমন হবে সেটা নিয়ে কী কোন লক্ষ্য কাজ করছে ?
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর বেতারের সামরিক বিশ্লেষক আমির বার শালম বলেছেন, “ইসরায়েল হামাসের সব সদস্যকে বিলুপ্ত বা অকার্যকর করা সম্ভব হবে বলে মনে করি না। কিন্তু আপনি তাদের দুর্বল করতে পারেন যাতে করে এর কোন অভিযান চালানোর সক্ষমতা না থাকে”।
এটা হতে পারে অনেক বেশি বাস্তববাদী লক্ষ্য। হামাসের সঙ্গে চারটি যুদ্ধ করেছে ইসরায়েল। কিন্তু এর রকেট হামলা ঠেকানোর প্রতিটি চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেঃ কর্নেল জোনাথন কনরিকাস বলেছেন যুদ্ধের পর কোন ইসরায়েলি নাগরিককে হত্যা বা হুমকির সামরিক সক্ষমতা আর হামাসের থাকবে না।
স্থল অভিযানে যত ঝুঁকি
অনেকগুলো বিষয় আছে যা সামরিক অভিযানকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে পারে।
ইসরায়েলের আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকবে হামাসের সামরিক শাখা আল কাশাম ব্রিগেড। বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরক বসানো হবে। সেট করা হবে অ্যামবুশ। গাজার বিস্তৃত টানেল নেটওয়ার্ক ইসরায়েলি সৈন্যদের ওপর হামলায় ব্যবহৃত হবে।
২০১৪ সালে ইসরায়েলি পদাতিক ব্যাটালিয়ন মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছিলো অ্যান্টি ট্যাংক মাইন, স্নাইপার আর অ্যামবুশের কারণে। গাজা শহরের উত্তরাঞ্চলের কাছে শত শত বেসামরিক নাগরিক মারা গিয়েছিলো সেই লড়াইয়ে।
এ কারণেই ইসরায়েল এবার এগার লাখ বেসামরিক নাগরিককে দ্রুত গাজা ছাড়তে বলেছে। এরা গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলে বসবাস করে।
ইসরায়েল এবার সতর্ক করে বলেছে যুদ্ধ কয়েক মাস স্থায়ী হতে পারে। তারা রেকর্ড সংখ্যক ৩ লাখ ৬০ হাজার রিজার্ভ সেনাকে জড়ো করেছে।
প্রশ্ন হলো ফিরে যাবার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়াই কতদিন এটা অব্যাহত রাখতে পারবে ইসরায়েল।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা বলেছে গাজা দ্রুত ‘জাহান্নামের গর্তে’ পরিণত হচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। পানি, বিদ্যুৎ ও তেল সরবরাহ বন্ধ আছে। এখন মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেই গাজা ছাড়তে বলা হচ্ছে।
“সরকার ও সামরিক বাহিনী মনে করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের সাথে আছ- বিশেষ করে পশ্চিমা নেতারা। এখন চিন্তা হলো অবস্থান সংহত করো, আমাদের হাতে অনেক সময় আছে,” বলছিলেন ইসরায়েলের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বিষয়ক সাংবাদিক ইয়সি মেলমান।
কিন্তু দ্রুত হোক আর বিলম্বেই হোক যখন ক্ষুধার্ত মানুষের ছবি আসবে তখনি ইসরায়েলের সহযোগী দেশগুলো এর মধ্যে হাত দিবে।
জিম্মিদের রক্ষা করা
জিম্মিদের মধ্যে অনেকেই ইসরায়েলি। তবে এদের মধ্যে বিদেশী নাগরিকও আছেন অনেকে, যাদের অনেকের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। এসব কারণেই যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের এই অভিযানে অংশীদারিত্ব আছে।
প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ফরাসি-ইসরায়েলি পরিবারকে আশ্বস্ত করে বলেছেন তাদের প্রিয়জনকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা হবে। “ফ্রান্স কখনো তার সন্তানকে পরিত্যক্ত রেখে আসে না”।
এই জিম্মিদের ভাগ্যও অনেকটা প্রভাব রাখবে সামরিক পরিকল্পনায়। ইসরায়েলের নেতাদের ওপর এজন্য অভ্যন্তরীণ চাপও আছে।
আমির বার শালম ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকের সময়কার ঘটনার সাথে তুলনা করেছেন। ওই সময় ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীরা ইসরায়েলি অ্যাথলেটদের অপহরণ করেছিলো এবং নিহত হয়েছিলো ১১ জন। সে সময় ওই হামলার সাথে জড়িত সবাইকে হত্যার জন্য অপারেশন পরিচালনা করা হয়েছিলো।
তার মতে সরকার এবারও অপহরণের সাথে জড়িত সবাইকে ধরতে চায়। জিম্মি সবাইকে উদ্ধার করাটা হয়তো ইসরায়েলের এলিট ইউনিট সায়েরেত মাতকাল এর কমান্ডোদের সক্ষমতার প্রমাণ দিবে।
হামাস অবশ্য ইসরায়েল হামলা করলে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে জিম্মিদের গুলি করে হত্যার হুমকি দিয়েছে।
২০১১ সালে ইসরায়েল হামাসের হাতে পাঁচ বছর আটক থাকা গিলাড শালিত নামে একজন সেনার বিনিময়ে ১ হাজার বন্দীকে মুক্তি দিয়েছিলো।
কিন্তু এখন বড় সংখ্যায় বন্দীদের ছাড়তে ইসরায়েলকে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে হবে। কারণ এর আগে মুক্তি পাওয়াদের একজন হলেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার, যিনি এখন গাজায় হামাসের বড় রাজনৈতিক নেতাদের একজন।
প্রতিবেশীদের ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ
স্থল অভিযানের সময় ও ফলাফলকে আরও একটি বিষয় প্রভাবিত করতে পারে। তাহলো- ইসরায়েলের প্রতিবেশীদের প্রতিক্রিয়া।
মিশরের কাছ থেকে দাবি ক্রমশ বাড়তে পারে। গাজার সাথে দেশটির সীমান্ত আছে। তারা ইতোমধ্যেই রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং দিয়ে মানবিক সহায়তা দেয়ার জন্য চেষ্টা করছে।
ইসরায়েলের ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের অফির উইন্টার বলছেন, “গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান যত বাড়বে, মিশরও তত বেশি চাপে পড়বে এটা প্রমাণের জন্য যে তারা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেনা”।
অন্যদিকে ইসরায়েলের উত্তর সীমান্ত লেবাননের সাথে এবং সেটিও এখন ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। হেজবুল্লাহর সাথে কয়েকটি সংঘর্ষ ইতোমধ্যেই হয়েছে। তবে তারা নতুন করে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি।
ইরান, হেজবুল্লাহর প্রধান পৃষ্ঠপোষক, অবশ্য নতুন ফ্রন্ট খোলার হুমকি দিয়ে রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন কোন দেশ বা সংগঠন যদি চলতি পরিস্থিতির সুবিধা নেয়ার চিন্তা করে তাদের প্রতি তার একটি শব্দ- ‘করবেন না’।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমানবাহী রণতরী ইতোমধ্যেই পূর্ব ভূমধ্যসাগরে পাঠানো হয়েছে।
ইসরায়েল গাজা এবং এর উপকূলীয় এলাকার আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ করে পাশাপাশি সীমান্ত দিয়ে কারা যাতায়াত করবে ও কী ধরনের পণ্য প্রবেশ করতে পারবে তা তদারকি করে।
গাজার জন্য ইসরায়েলের ‘শেষ খেলা’
যদি হামাস ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে প্রশ্ন উঠবে যে তার জায়গায় কী হবে।
ইসরায়েল ২০০৫ সালে তার সামরিক বাহিনী ও হাজার হাজার বসতি স্থাপনকারীকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়েছিলো গাজা উপত্যকা থেকে এবং দখলদার বাহিনী হিসেবে সেখানে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা তাদের নেই।
অফির উইন্টার মনে করেন ক্ষমতার পালাবদল ক্রমশ ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে সেখানে ফিরিয়ে আনার পথ তৈরি করবে। হামাস তাদের ২০০৭ সালে বিতাড়িত করেছিলো। এই কর্তৃপক্ষ এখন পশ্চিম তীরের একাংশ পরিচালনা করে।
তার মতে মিশরও আরও বাস্তববাদী প্রতিবেশীকে স্বাগত জানাবে।
গাজার ধ্বংস হওয়া অবকাঠামো আবারো আগের মতো পুনঃনির্মাণ করতে হবে।
ইসরায়েলে হামাসের হামলার আগে গাজায় প্রবেশে বেশ কড়াকড়ি ছিলো। এখন ইসরায়েল আরও বেশি কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে।
গাজায় বড় ধরনের নিরপেক্ষ এলাকা তৈরির আহবান আসছে। শিনবেত সিকিউরিটি সার্ভিসের সাবেক একজন প্রধান ইয়োরাম কোহেন বলছেন প্রায় দু কিলোমিটারের ‘ দেখা মাত্র গুলির’ এলাকাটি প্রতিস্থাপন করতে হবে।
তবে যুদ্ধের ফল যাই হোক না কেন, এবারের মতো হামলা যেন আর কখনো না হয় সেটিই নিশ্চিত করতে চাইবে ইসরায়েল।
সূত্র: বাসস
এসবি/