জনগণ সিন্ডিকেট করলে অন্য সিন্ডিকেট পাত্তা পাবে না: বাণিজ্যমন্ত্রী
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৫:৩৮ পিএম, ২৫ নভেম্বর ২০২৩ শনিবার
জনগণ সিন্ডিকেট করলে অন্য কোনো সিন্ডিকেট আর পাত্তা পাবে না বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা টিপু মুনশি।
তিনি বলেছেন, একদিন সময় আসবে, যখন ভোক্তারই প্রতিবাদ করবে।
জনগণ সিন্ডিকেট করলে অন্য কোনো সিন্ডিকেট আর পাত্তা পাবে না। ভোক্তা অধিদপ্তর সেই জ্ঞানটাই দিতে চাইছে মানুষকে, যে জনগণের ক্ষমতাই সবচেয়ে বড় ক্ষমতা। তাদের (জনগণ) ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, জ্ঞান থাকতে হবে, আইন সম্পর্কে জানতে হবে। জনগণ যদি তাদের অধিকার সম্পর্কে জানে এবং সচেতন হয়, তাহলে অনেকটা সমস্যা লাঘব হয়ে যাবে।
শনিবার (২৫ নভেম্বর) সকালে রাজধানীর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে আয়োজিত ভোক্তা অধিকার সচেতনতা বিষয়ক বিতর্ক প্রতিযোগিতার গ্র্যান্ড ফাইনাল ও পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। 'দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বেসরকারী খাতের ভূমিকা' শীর্ষক ছায়া সংসদটি যৌথভাবে আয়োজন করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি খাত এবং সরকারি খাতের যৌথ ভূমিকাই মুখ্য উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন দেশে উৎসবের সময় ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য কমায়। আমি এবার ব্যবসায়ীদের খুব অনুরোধ করলাম, সামনে রোজার ঈদ, আপনারা দয়া করে একটু বিবেক সম্পন্ন হোন এবং সেই বিবেচনায় একটু দাম কমিয়ে মানুষকে স্বস্তি দিবেন। কিন্তু তারা তা করেনি। পরে আমাকে বলতে হয়েছে, আপনাদের বিশ্বাস করে আমি ভুল করেছি।
তাৎক্ষণিক পণ্য আমদানীতে সমন্বয়হীনতা রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, এই কথাটি আমি স্বীকার করতে রাজি। কেননা আমরা যখন চাইলাম ডিম আমদানী করবো, সেদিন থেকে প্রায় এক মাস পরে আমাদের বলতে হলো। কারণ আমরা সেই নির্দেশটা দিতে পারি না। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় আমাদের এসিস্ট করলো যে, তোমরা এই দামে দিতে পারো। যার জন্য সেখানে একটু সমন্বয়হীনতা বলবো না, একটু দেরি হয়েছে। পেঁয়াজ ও আলুর ক্ষেত্রেও কিছুটা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের যে পেঁয়াজ প্রয়োজন, তার থেকে ৭-৮ লক্ষ টন পেঁয়াজ ঘাটতি আছে। আমরা প্রায় ২৫-২৬ লক্ষ টন পেঁয়াজ খাই। আমাদের সেই পরিমাণই উৎপাদন হয়। কিন্ত ২৫-২৬ শতাংশ পেঁয়াজ রাখতে পারি না। পঁচে যায়। যার জন্য পেঁয়াজটা আমাদের আমদানি করতে হয়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা যখন পেঁয়াজ আমাদানী করতে চাইলাম, তখন কৃষকদের কথা বিবেচনা করে কৃষি মন্ত্রণালয় মনে করলো, এখন আমদানি না করাই ভালো। তখন আমরা আমদানি করতে পারলাম না। তার এক মাস পরে ভারতে পেঁয়াজ আমদানীর উপর ৪০ শতাংশ ডিউটি বসালো। আমরা যখন পেঁয়াজের দাম ৬৫ টাকা ঠিক করে আমদানির সিদ্ধান্ত নিলাম, তার কিছুদিন পর তারা প্রতি টনে ৮০০ ডলার ঠিক করে দিলো। প্রতি কেজি ৯০ টাকা করে দাম ঠিক করে দিলো। এর কমে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা যাবে না। আমরা সেই বিপদে পড়ে গেলাম। যার জন্য কিছুটা সমন্বয়হীনতা বা দেরি বলি, সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা দেরি হয়েছে। তার কিছুটা প্রভাব বাজারে পড়েছে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি থাকবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী আরও বলেন, নির্বাচনী ইশতেহার দলের একটি গ্রুপ আছে তারা তৈরি করে। যেহেতু আওয়ামী লীগের মূল উদ্দেশ্য জনগণ, সেহেতু আমি আশা করি তারা সেই দিক বিবেচনা করে ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি রাখবেন যাতে জনগণের স্বস্তি হয়।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়ে জনতে চাইলে তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার। সেজন্য আমাদের সদিচ্ছা তো আছেই। আমরা তো আপ্রাণ চেষ্ট করে যাচ্ছি, যেনো দ্রব্যমূল্য যেটা যৌক্তিক সেটা হয়। আমরা আজকে বৈশ্বিক একটি পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর এখন আবার ফিলিস্তিন-হামাস যুদ্ধ। গত পাঁচ বছরের মধ্যে সাড়ে তিন বছর আমাদের গেছে এসব ঝামেলাতে। তারপরও একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি মনে করি, মানুষকে ভালো রাখতে হলে, দ্রব্যমূল্য তাদের ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে। সেজন্য চেষ্টা চলছে।
হঠাৎ করে বাজারে বিক্রেতারা কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা যদি গরুর মাংস আমদানি করি তাহলে ৪০০-৪৫০ টাকায় গরুর মাংস খাওয়াতে পারবো। কিন্তু আমরা চেয়েছি দেশের খামারিরা যাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। আগে করোবানির ঈদে ভারত থেকে গরু আসতো। এখন একটি গরুও অফিসিয়ালি ঢুকতে পারবে না। দরকার নেই আমাদের। এতে আমাদের তরুণরা উদ্যোক্তা হচ্ছে। আমরা চাই, আমাদের খামারিরা শক্তিশালী পর্যায়ে যাক।
বিতর্ক প্রতিযোগিতার বিতার্কিকদের প্রশংসা করে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে জাতীয় সংসদে আমাকে খুব ধোলায় হয়েছে। সংসদের বিরোধী দল আমাকে বলেছে, তুমি পদত্যাগ করো না কেন? সিন্ডিকেট থামাও না কেন? এমন অনেক কথা আমাকে শুনতে হয়েছে। আমি যদি এসব বিতার্কিকদের মতো বুদ্ধিমান বক্তা হতাম, তাহলে আমি সংসদে তাদের (বিরোধী দল) এড্রেস করতে পারতাম। যা আমি এখানে শিখেছি।
ছায়া সংসদে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ. এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, কাউকে বাদ দিয়ে আমরা কাজ করতে পারবো না। আমাদের ব্যবসায়ী সমাজ, যেসব প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয় আছে, সবাই মিলে আমরা কাজ করছি। ভোক্তা অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা প্রতিযোগিতা কমিশন এককভাবে কিছু করতে পারবে না। ব্যবসায়ী সমাজকে আমরা যতক্ষণ না পর্যন্ত যুক্ত করতে পারবো ততক্ষণ ফলাফল আসবে না।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিল সোনার বাংলা বিণির্মাণের। আমরা সেই পথেই যাচ্ছি। আমাদের উন্নয়নসহ প্রতিটি খাত ইতিবাচকভাবে অন্য মাত্রায় গেছে। আমরা ২০২৬ সালের পর একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্রে পরিণত হবো। প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালে যে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন, সেটি এখন বাস্তব। তিনি এখন স্বপ্ন দেখছেন স্মার্ট বাংলাদেশের। সেই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে স্মার্ট তরুণ সমাজ দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে গত ৮ আগস্ট এ বিতর্ক প্রতিযোগিতার শুরু হয়। বেশ কয়েকটি ধাপে প্রতিযোগিতা শেষে ফাইনালে মুখোমুখি হয় ইডেন মহিলা কলেজ ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের বিতার্কিকরা।
প্রতিযোগিতায় সরকারি দল ইডেন মহিলা কলেজের বিতার্কিকদের হারিয়ে বিরোদী দল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের বিতার্কিকরা জয়ী হয়। প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ী দল ও রানার্স আপ দলের হাতে ট্রফি ও সনদসহ অর্থ পুরস্কার তুলে দেন বাণিজ্যমন্ত্রী। বিজয়ী দল ২ লাখ টাকা ও রানার্স আপ দল ১ লাখ টাকা পুরস্কার পান।
প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, ড. এস এম মোর্শেদ, অধ্যাপক ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন, সাংবাদিক মো. তৌহিদুল ইসলাম ও সাংবাদিক দৌলত আক্তার মালা।
প্রতিযোগিতা শেষে দ্রব্যমূল্য বাড়ার বিভিন্ন কারণ তুলে ধরে সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, আমরা প্রকৃত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নয়। তারা বড় বড় পুঁজি নিয়ে বাজারে আসে। লাভ যেমন আছে তেমনি ঝুঁকিও রয়েছে। তাই ভ্যাট-ট্যাক্স সহনীয় রেখে উন্মুক্ত আমদানি ব্যবস্থা রাখতে হবে। ডলার সংকটে কাঁচামাল আমদানিতে ব্যাঘাত ঘটায় অনেক শিল্পকারখানা তার ক্যাপাসিটি অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না। উৎপাদন ঘাটতির কারণে শিল্পপণ্যের জোগান ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সরবরাহ ঘাটতির কারণে পণ্যমূল্য বাড়ছে। তবে মূল্যস্ফীতি এবং মুদ্রাস্ফীতিও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আরেকটি প্রধান কারণ। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য চাহিদা মোতাবেক তাৎক্ষণিক আমদানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে না পারলে ডিমান্ড অনুযায়ী সাপ্লাই ঘাটতি হলে ভোক্তাদের দুর্ভোগ বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, উৎপাদন বাড়াতে পারলে বাজার সিন্ডিকেট করা সম্ভব হবে না। বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানি যাদের ওপর কোম্পানিগুলোর দ্রব্যমূল্য অনেকখানি নির্ভর করে তারা প্রত্যেকেই সমাজের মর্যাদাবান ও বিষ্ণুশালী। তাই এসব কর্পোরেট কাছে অনুরোধ আপনারা সাধারণ মানুষের কল্যাণে বাজার ব্যবস্থাপণাকে স্থিতিশীল রাখবেন। যাতে এদেশের সবসময় আপনাদের অবদানের কথা স্মরণ রাখে।
এমএম//