সিঙ্গাপুরের জাতির জনক লি কুয়েন কীভাবে আধুনিক সিঙ্গাপুর করলেন?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৫:২২ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩ মঙ্গলবার
মাত্র ৫০ বছর আগেও সিঙ্গাপুর ছিল অনুন্নত একটি দেশ। অথচ এখন বিশ্বের উন্নত দেশ গুলোর একটি এটি।
টিংকু আব্দুল রহমান সিঙ্গাপুর কে মালয়েশিয়া থেকে বিছিন্ন করে দেন বিক্রি জারি করে। দুনিয়ার ইতিহাসে একমাত্র সিঙ্গাপুরই ছিল এমন এক দেশ, যারা কিছুতেই স্বাধীনতা চাইছিল না। সিঙ্গাপুর ছিল গরীব এক দ্বীপ। যারা পুর নির্ভরশীল ছিল মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় সাহায্যের উপর। ফলে মালয়েশিয়া এই বোঝা ঝেড়ে ফেলতে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সে সময় সিঙ্গাপুরের মাথা পিছু আয় ছিল ৩২০ ডলার। অথচ মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে দুর্নীতি মুক্ত অর্থনীতির এই দেশটির মাথা পিছু আয় ৬০ হাজার ডলারের বেশি।
সিঙ্গাপুরে চাষযোগ্য জমি নেই বললেই চলে। মাত্র দশ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয় বাকিটা আমদানি করতে হয়। মুক্ত অর্থনীতির ফলে যেকোনো বিদেশি সহজেই সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগ করতে পারে।
চাইনিজ এবং ভারতীয়দের মেলবন্ধন সিঙ্গাপুর। এশিয়ার প্রধান দুই অর্থনীতি ভারত ও চীনের মাঝে এর অবস্থান। এদেশকে ভারতীয় এবং চাইনিজরা সেকেন্ড হোম মনে করে। তামিল চাইনিজ সিঙ্গাপুরের সরকারি ভাষা।
একজন নেতা ইচ্ছা করলেই কিভাবে একটি দেশের চেহারা পরিবর্তন করে দিতে পারেন, তার উৎকৃষ্ট উদহারণ বলা যেতে পারে সিঙ্গাপুরের মহান নেতা এবং দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ যিনি তার ৩১ বছরের (১৯৬৫-১৯৯০) শাসনামলে একটা জেলেপল্লীকে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন।
স্বাধীনতার ঠিক পরেই দেশটির নেতারা বুঝতে পারলেন যে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ অপরিহার্য। যার ফলে বিদেশি পণ্যের উপর শুল্ক হার অনেক কমানো হয়।
একই সাথে দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন তথা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা হয়। ঐতিহাসিকভাবেই, সিঙ্গাপুরের সমুদ্র বন্দর কৌশলগত ভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এসকল কারণেই সিঙ্গাপুর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক কেন্দ্র হয়ে উঠে। প্রচুর বিনিয়োগ আসতে শুরু করে। বর্তমানে গুগল, ফেসবুক,শেভরন, টয়োটা, পেপসিকো সহ এমন কোনো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান নেই, যারা সিঙ্গাপুরে আঞ্চলিক সদরদপ্তর খোলেনি।
সিঙ্গাপুরের ভৌগোলিকগত অবস্থানের গুরত্ব বুঝতে পেরে দেশটির নেতা বিমানবন্দর,সমুদ্রবন্দর এবং সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে নজর দিয়েছিলেন। তাই অল্প সময়েই সিঙ্গাপুর পরিণত হলো এয়ারলাইস্ গুলোর ট্রানজিট হাব। এখন সাংহাই এর পর সিঙ্গাপুর ই বিশ্বের ব্যস্ততম বিমানবন্দর।
দেশটির তরুণ নেতা লি কুয়ান ইউর সংগ্রাম শুরু:
১৯৬৫ সালে যখন দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করে তখন দেশটির মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫০০ ডলার। চারদিকে হাজারো মানুষের হাহাকার,মাত্র ৪০% শিক্ষিত মানুষকে টেনে তুলে ধরা,স্বাস্থ্য ও বাসস্থান সেবা নিশ্চিত করা তার জন্য বড় একটি চিন্তার বিষয় হয়ে দাড়ায়।তবে তিনি হাল ছেড়ে দেন নি। বরং এই স্বাধীনতার কঠিন সিদ্ধান্তটি যে সিঙ্গাপুরের জন্য আশীর্বাদ তা তিনি পরে প্রমাণ করেন।
প্রথম তিন দশকের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লি কুয়ান ইউ তৃতীয় বিশ্বের নিচ থেকে একটি দরিদ্র বন্দরকে এক প্রজন্মের মধ্যে প্রথম বিশ্বে উন্নীত করেন। গণতন্ত্র, বিশেষ করে পশ্চিমা উদারনৈতিক গণতন্ত্র সম্পর্কে, লি-র গুরুতর আপত্তি ছিল। Discipline, not democracy — তিনি যুক্তি দেখান যে অধিকাংশ দেশের যা প্রয়োজন তা হচ্ছে গণতন্ত্রের বদলে 'শৃঙ্খলা'। সিঙ্গাপুর বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে এশিয়ার শীর্ষে, বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
১৯৬৫ সালে যখন লি কুয়ান ইউ দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু জিডিপি ছিল বছরে প্রায় ৪০০ ডলার। আজ সিঙ্গাপুরে মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ৫০,০০০ মার্কিন ডলার। সিঙ্গাপুর বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বন্দর। (সাংহাই বন্দর সিঙ্গাপুর বন্দরকে ছাড়িয়ে গেছে।) এছাড়াও, সিঙ্গাপুর ইলেকট্রনিক্সে গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু তারা কম্পিউটার পণ্যের একটি প্রধান নির্মাতা। সিঙ্গাপুরের ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব রয়েছে। বহির্বিশ্বের উপর এর নির্ভরতা দেশটিকে একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করতে বাধ্য করে। ভারত মহাসাগর এবং দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্যে অবস্থিত সিঙ্গাপুর সেই কৌশলগত অবস্থানের উপর ভিত্তি করে শিল্প গড়ে তোলে।
শিক্ষাখাতে মনোযোগ:
স্বাধীনতার পরপরই দেশটির শিক্ষা খাতকে ঢেলে সাজানো হয়। উদার শিক্ষা বৃত্তি নীতির মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যাবস্থা করা হয় এবং বিদেশ থেকে পাস করার পর কমপক্ষে দুই বছর সরকারী চাকরি করা বাধ্যতামূলক করা হয়। এছাড়াও মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার জন্য বেতন ব্যবস্থা উন্নত করা হয়।
অবকাঠামো উন্নয়ন:
বর্তমানে দেশটিতে ধনকুবের (মিলিওনিয়ার) সংখ্যা দেড় লাখের মত এবং ২০১৮ সাল নাগাদ এই সংখ্যার সাথে আরো ও ৩০ হাজার যোগ হবে। এর মানে দাঁড়ায়, সিঙ্গাপুর এ প্রতি ৩৬ জনে ১ জন লাখপতি। মাথাপিছু ব্যবসা উদ্যোগকারির দিক থেকে শুধু যুক্তরাষ্ট্র সিঙ্গাপুর থেকে এগিয়ে।
সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য, ‘ আমার সামনে তো মাত্র দুটো অপশন ছিল। এক, নিজের পরিবারের উন্নতির চেষ্টা না করে দেশের উন্নতির জন্য কাজ করা। আর দুই, দেশের উন্নতি না করে নিজের পরিবারের উন্নতি করা। তো আমি প্রথম অপশনটাই বেছে নিয়েছিলাম‘।
এসবি/