হারিয়ে গেছে গ্রামীণ শীতকালীন ঐতিহ্য
মোহাম্মদ মাসুদ খান
প্রকাশিত : ০৪:১১ পিএম, ১ জানুয়ারি ২০২৪ সোমবার
চৌদ্দশ ত্রিশ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসের সতের দিন গত হয়েছে। ঋতু চক্রে এটা শীতকাল। একটা সময় ছিলো আবহমান বাংলার গ্রাম-গঞ্জে এই সময়টাতে চলতো পিঠা-পুলি বানানোর ধুম। খেজুর গাছ থেকে আহরণ করা হতো খেজুরের রস। তা দিয়ে তৈরি হতো সুস্বাদু রসের পায়েস আর মজাদার মিঠাই। শহুরে বাসিন্দারা এই সময়টাতে যার যার গ্রামে বেড়াতে যেতেন। কারণ তাদের ছেলেমেয়েদের বার্ষিক পরীক্ষা তখন শেষ। তাই গ্রামে বেড়ানোটা ছিলো এক রকম রীতি। কেউ কেউ আবার এক-দেড় মাস যাবত গ্রামে থাকতেন। বিংশ শতাব্দীর আশি’র দশক পর্যন্ত এ ধারাটা প্রবলভাবে দেখা গেছে।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে সেই চিরাচরিত নিয়মের ছন্দপতন ঘটেছে। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে স্বপরিবারে গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার রীতি এখন সেভাবে দেখা যায় না। শহুরে মানুষগুলো বন্দী হাজার-বারোশ স্কয়ার ফিট ফ্ল্যাটের ভিতর। কেউ কেউ হয়তো এশিয়া ইউরোপ বেড়াতে যান। তবে তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। সামর্থ অনুযায়ী কিছু কিছু মানুষ শহরের আশে পাশে ভ্রমণ করেন। কেউবা ডে ট্যুর আবার কেউবা রিসোর্টে এক দুই দিনের রাত্রি যাপন করেন। অনেকে পছন্দ করেন পর্যটন শহর খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন বা চায়ের রাজধানী সিলেট যেতে। ভ্রমণ পিপাসুদের কেউ কেউ ঘুরতে পছন্দ করেন উত্তর বঙ্গের জেলা রাজশাহী-বগুড়া কিংবা সর্ব উত্তরের জনপদ পঞ্চগড়।
এসব ট্যুরে পাওয়া যায় না পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে গ্রামে বেড়ানোর সেই ফ্লেভার। কতইনা আনন্দময় ছিলো গ্রামে বেড়ানোর সে দিনগুলো। শীতের সময় শীত নিবারনের জন্য গ্রামের মানুষের তেমন জামা কাপড় ছিলো না। বড়জোর একটা চাদর পেঁচিয়ে শীত থেকে তারা রক্ষা পাবার চেষ্টা করতেন। শীতে কাতর মানুষগুলো সকাল-সন্ধ্যায় খড়কুটো জ্বালিয়ে দলবেঁধে আগুন পোহাতেন, চলতো তাদের সুখ দুঃখের যত আলাপ-চারিতা। পড়ন্ত বিকেলে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার জন্য গাছিরা খেজুর গাছে হাড়ি দিতেন। পরদিন সকাল বেলা সে হাড়ি রসে ভরে যেতো। কখনো কখনো দুষ্ট ছেলের দল হাড়িতে পাট খড়ি ঢুকিয়ে রস টেনে খেয়ে ফেলতো। যা ছিলো তাদের কাছে এক অন্যরকম এডভেঞ্চার।
গাছ থেকে সংগ্রহ করা খেজুর রস একদিন গেরস্থ এবং এক দিন গাছি ভাগাভিগি করে নিতেন। রস দিয়ে গৃহিণীরা তৈরি করতেন হরেক রকম মিষ্টি পিঠা যেমন গোটা পিঠা, ধুপি পিঠা, পাটি সাপটা পিঠা, মুগ-পাকন পিঠা, রস পিঠা, রস চিতই পিঠা ইত্যাদি নানা ধরনের মজার পিঠা। কোন কোন দিন রস দিয়ে তৈরি করা হতো খেজুরের মিঠাই। বিশাল বড় আকারের পাত্রে দীর্ঘ সময় জ্বাল দিয়ে প্রস্তুত করা হতো মিষ্টি স্বাদের খেজুরের মিঠাই। কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চলের অধিবাসীরা খেজুর গুড় তৈরি করার বড় পাত্র কে বলতেন ‘জালা’।
সত্তর আশি দশকে গ্রামীণ জনপদের অধিকাংশ ঘর ছিলো কাঁচা ঘর। পাট খড়ি, বাঁশ ও ছন দিয়ে তৈরি ঘরগুলো যেন ঠিক পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের আসমানীদের ঘরের মতো। যেখানে বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি আর শীতের দিনে কুয়াশা ঘরগুলোতে হানা দিতো। অবস্থাপন্ন গেরস্থের ঘর গুলো ছিলো টিন ও কাঠের তৈরি। শীতের রাতে গ্রামের মানুষ কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাতেন। সেই কাঁথায় শীত নিবারণ হতো না। কারো কারো ভাগ্যে সেই কাঁথা জুটতো না।
শীতের সময় কোন কোন গ্রামে ওয়াজ-মাহফিল অনুষ্ঠিত হতো। ওয়াজ মাহফিল কে কেন্দ্র করে সেখানে বসতো অস্থায়ী দোকান পাট। দোকানীরা নানা রকম পসরা সাজিয়ে বসতেন। মুরালী, নিমকি, জিলাপী, রসগোল্লা, চকলেট, চানাচুরসহ অনেক কিছু সেখানে পাওয়া যেতো। মনে হতো মেলা বসেছে। ছেলে বুড়োদের কাছে ওয়াজ শোনার চেয়ে অস্থায়ী দোকানে খোশ-গল্পে মেতে ওঠা এবং টং দোকানে কেনা-কাটাই যেন মুখ্য হয়ে ওঠতো তখন।
গ্রামের বাড়িতে শহুরে লোকজনের পচিশ- ত্রিশ দিনের ছুটি কিভাবে যে কেটে যেতো টেরই পাওয়া যেতো না।
বাংলার গ্রামগুলোতে আজ সেই চির চেনা চিত্র হারিয়ে গেছে। গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে না। গৃহিণীরা আগের মতো পিঠা পুলি বানায় না। গ্রাম এখন শহর কেন্দ্রিক। আগে শহরের মানুষ গ্রামে যেতো আর এখন গ্রামের মানুষ শহরে যায়। শহরের মানুষ ছুটি কাটাতে ছোটে দেশের বাহিরে কিংবা শহর থেকে দূরে কোন রিসোর্টে অথবা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন বা অন্যকোন পর্যটন স্থানে।
এই হালের কারণ কি? এক কথায় উত্তর পাওয়া যাবে না। তবে বৈশ্বিক এবং আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন এর মূল কারণ বলে প্রতীয়মান হয়।
আমার গ্রাম চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের মদনের গাঁও গ্রামে একজন প্রখ্যাত গাছি ছিলেন হাশিম মামা। তিনি সত্তর-আশি দশক জূড়ে শীতকালে খেজুর গাছে হাড়ি দিতেন। এখন তিনি নেই। তার পরবর্তী বংশধরেরা এই কাজের সাথে এখন আর যুক্ত নেই। তাদের মতে গাছির কাজ খুবই ঝুঁকিপুর্ণ ও কষ্টসাধ্য। সে তুলনায় পারিশ্রমিক অনেক কম। সে সাথে যুক্ত হয়েছে খেজুরের রসে নিপাহ ভাইরাসের প্রকোপ।
দাদী-নানী, চাচী-মামীরা পয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে রাত-ভোর পীঠা বানাতেন এবং তাদের আত্মীয়-পরিজনদের আপ্যায়ন করাতেন। প্রতিটি পিঠার সাথে মিশে থাকতো তাদের পরিশ্রম, আন্তরিকতা ও ভালোবাসা। তারা ছিলেন সত্যিকার অতিথিপরায়ন মানুষ। আপ্যায়ন করাতে তারা দারুন ভালবাসতেন।
সময়ের সাথে সাথে এই রীতির পরিবর্তন হয়েছে। পিঠা তৈরি অনেক সময় সাপেক্ষ, সেই সাথে ব্যয়বহুলও বটে। এতো সময় এই সময়ের গৃহিণীদের হাতে নেই। গ্রাম বাংলায় সেই দাদী-নানী, চাচী-মামীরা আর নেই। তাই গ্রামে বেড়ানোর সেই ফ্লেভার আজ আর নেই।
সাত বছর আগে শীতকাল নিয়ে একটি ছড়া লিখেছিলাম যা আমার ১ম বই “ছড়াটিম ছড়াটুম” এ স্থান পেয়েছিলো। আমার রচিত সেই ছড়াটি এই লেখার সাথে উল্লেখ না করে পারলাম না। ছড়াটি ছিলো এমন :
“শীতের সময় নানা বাড়ি
খেজুর গাছের লম্বা সারি,
পিঠা পুলি রসের ধুম
কাঁথা মুড়ি গভীর ঘুম,
হাড় কাঁপানো হিমেল হাওয়া
ক্ষেতের মাঝে হেঁটে যাওয়া,
আগুন পোহানো সকাল সাঁঝে
খোশ গল্প সবার মাঝে,
ঘন কুয়াশায় ঢাকা ঘোর
শিশির সিক্ত শুভ্র ভোর,
সেই অপরূপ নানা বাড়ি
পাবো কি তাকে হাকিয়ে গাড়ি।”
এমনিভাবে একদিন হারিয়ে যাবে শীতের সময়ে গ্রামে বেড়ানোর রেওয়াজ। হারিয়ে যাবে আমাদের চিরায়ত বাংলার পিঠা-পুলি খাওয়ার উৎসব। বিলীন হয়ে যাবে গাছিদের খেজুর গাছ থেকে রস আহরণের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি।
এএইচ