ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪,   আশ্বিন ৪ ১৪৩১

যশোরে নৌকার কান্ডারিদের কাঁপিয়ে দিচ্ছেন স্বতন্ত্ররা

বেনাপোল প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ০৩:০৭ পিএম, ৫ জানুয়ারি ২০২৪ শুক্রবার

আর মাত্র একদিন পরই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এবারের নির্বাচন দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে। খোদ সরকার প্রধানের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের পাশাপাশি সত্যিকার অর্থে একটি অর্থবহও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ আসছে বার বার। সে কারণে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে দলীয় প্রার্থীর পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরকেও উৎসাহিত করা হয়েছে।

বলা হয়েছে, দল মনোনীত প্রার্থীদের বাইরেও যদি কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে চান তাহলে তার বিরুদ্ধে দলীয় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। যার প্রতিফলন দেখা গেছে নির্বাচনে। প্রায় প্রতিটি আসনে দলের নেতাদের মধ্য থেকে একাধিক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছেন। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে এসেছে এসব প্রার্থীদের মধ্য থেকে যারা তুলনামূলক জনপ্রিয় তারা মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজেদেরকে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। 

এই পরিস্থিতি যশোর জেলার ছয়টি আসনের মধ্যে পাঁচটিতে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তবে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে নৌকার প্রার্থীরা স্বতন্ত্রদের হারাতে সর্বোচ্চ চেষ্টার কমতি করছেন না।

ছয়টি আসনের মধ্যে একমাত্র যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর-বসুন্দিয়া) আসনে বলা চলে নৌকা মার্কার প্রার্থী এনামুল হক বাবুল স্বস্তিতে রয়েছেন। যদিও তাকে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এ পর্যায়ে আসতে হয়েছে। প্রার্থী হিসেবে তার বৈধতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। যে কারণে ইসি এবং হাইকোর্ট থেকে এনামুল হক বাবুলের প্রার্থিতা বাতিল হয়। কিন্তু, তিনি আপিল বিভাগে যেয়ে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছিলেন। সেটাও পুনরায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। শেষ পর্যন্ত সেই চ্যালেঞ্জ জয় করেই ভোটের মাঠে ফিরে এসেছেন এনামুল হক বাবুল। চূড়ান্ত রায় পক্ষে আসায় স্বতন্ত্র প্রার্থী রণজিৎ রায় তাকে সমর্থন জানিয়ে ভোটের মাঠ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার পর এনামুল হক বাবুলের জয়লাভ এখন সময়ের ব্যাপার বলেই মনে করছেন এই আসনের ভোটাররা। 

যশোর-১ আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার প্রার্থী শেখ আফিল উদ্দিন। তিনি বর্তমানসহ টানা তিনবার এই আসনের এমপি। এর আগে মাত্র একবারই তাকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল। নিজের প্রথম নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থেকে মাত্র পাঁচ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন। এরপরের দুই নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেছেন সুস্পষ্ট ব্যবধানে। কিন্তু, এবারের নির্বাচনে তাকে চ্যালেঞ্জে ফেলেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী বেনাপোল পৌরসভার সাবেক মেয়র আশরাফুল আলম লিটন। এই আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আক্তারুজ্জামান শুধু খাতাকলমেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছেন।

যশোর-২ আসনটিতে সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের পর স্থানীয়ভাবে আর কোনো নেতা আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন লাভ করেননি। এই আসন থেকে গত নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন লাভ করে এমপি নির্বাচিত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর ডাক্তার নাসির উদ্দিন। এবার মনোনয়ন লাভ করেছেন ডাক্তার মো. তৌহিদুজ্জামান তুহিন। এই দুইজনেরই জন্ম সংসদীয় আসনের ঝিকরগাছায়। কিন্তু, তাদের বর্তমান বাস ঢাকায়। কেউই এলাকায় থাকেন না দীর্ঘ বছর। সে কারণে এলাকার মানুষ বিশেষ করে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা হতাশা সবসময়ই রয়ে গেছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে আবির্ভূত হন চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা এসএম হাবিবুর রহমান এবং যশোর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম। এসএম হাবিবুর রহমান শেষ পর্যন্ত আর নির্বাচনের ময়দানে প্রার্থী হিসেবে থাকেননি। তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে নৌকার সমর্থনে ভোটের ময়দানে সক্রিয়। এই শূন্যস্থান পূরণে তৎপর হয়ে উঠেছেন ট্রাক প্রতীকের অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম। তিনি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছেন নৌকার মো. তৌহিদুজ্জামান তুহিনকে। আসনটির অন্য তিনজন প্রার্থী জাতীয় পার্টির ফিরোজ শাহ, বাংলাদেশ কংগ্রেসের আব্দুল আওয়াল এবং বিএনএফের শামছুল হক ভোটারদের মধ্যে এখনো পর্যন্ত তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেননি। 

একইভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন যশোর-৩ আসনের বর্তমানসহ পরপর দুই বারের এমপি কাজী নাবিল আহমেদ। নৌকার এই প্রার্থীকে এবার চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন আওয়ামী লীগের যশোর জেলা সদস্য ও সদর উপজেলা সভাপতি মোহিত কুমার নাথ। মোহিত কুমার নাথ এক সময় যশোর জেলার রাজনীতিতে পরস্পর বিরোধী দুটি বলয়ের একটির নেতা এমপি কাজী নাবিল আহমেদের সাথেই ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এখনও তিনি সে বলয়েই সক্রিয়। দীর্ঘদিন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবেও তার ইউনিয়ন পর্যায়ে একটি পরিচিতি রয়েছে। সেইসব কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী ময়দান চষে বেড়াচ্ছেন মোহিত কুমার নাথ। নিজের ঈগল প্রতীকের সমর্থনে তিনি সাথে পেয়েছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও আরবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহারুল ইসলামসহ জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকে। ইতিমধ্যে তৃণমূলের ভোটারদের কাছে পৌঁছে গেছেন কাজী নাবিল। 

এবারের নির্বাচনে যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়েছেন বর্তমানসহ পর পর দুইবারের এমপি ও প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য। এবারও নৌকা নিয়ে ভোটের ময়দানে থাকা এই বর্ষিয়ান নেতা দিনরাত চষে বেড়াচ্ছেন সংসদীয় আসনের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। সকাল থেকে গভীর রাত তিনি ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন। ভোটারদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন তার সময়ে করা কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের বিভিন্ন প্রকল্প, স্কুল, মাদ্রাসা, মন্দির, রাস্তাঘাটসহ নানা উন্নয়নের কথা। আহবান জানাচ্ছেন অসমাপ্ত উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত করতে।  আগামীতেও নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে তাকে নির্বাচিত করতে। কিন্তু, স্বতন্ত্র প্রার্থী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্ম-বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ও জেলা কৃষকলীগের সহ-সভাপতি এসএম ইয়াকুব আলী বড় ফ্যাক্টর। ঈগল প্রতীকের প্রার্থী ইয়াকুব আলীও কম যাচ্ছেন না। তিনিও সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছেন ভোটারদের কাছে। এই আসনে জাতীয় পার্টির এম এ হালিম, ইসলামি ঐক্য জোটের মাওলানা নুরুল্লাহ আব্বাসি এবং তৃণমূল বিএনপির মেজর বনিকে নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে তেমন কোনো আলোচনাই শোনা যায়নি।

জেলার কেশবপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত যশোর-৬ আসন। এই আসনের বর্তমান এমপি যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। তিনি এবারও এই আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন লাভ করেছেন। তবে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এইচএম আমির হোসেন এবং উপজেলা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত যুগ্ম আহবায়ক আজিজুল ইসলাম। এই আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে জিএম হাসান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তিনি তেমন একটা আলোচনায় নেই। এই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন শাহীন চাকলাদারের নৌকা এবং আমির হোসেনের কাঁচি।  

সব মিলিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যশোরের পাঁচটি আসনে ভোটের মাঠকে উৎসব মুখর আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ করে তুলেছেন। আর অপেক্ষায় আছেন ৭ জানুয়ারি রাতে কার গলায় উঠবে ফুলের মালা। 

এএইচ