কালীপূজা ও খোকসার কালী
ডা. উজ্জ্বল কুমার রায়
প্রকাশিত : ০৭:০৪ পিএম, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বৃহস্পতিবার
মাঘের অমাবস্যার গভীর রাত। আকাশে ঘনকালো মেঘ জমেছে অসময়ে। কনকনে ঠান্ডা এবং চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। তারই মাঝে বেজে চলেছে গুরুগুরু শব্দে ঢাক,কাঁসর,শঙ্খধ্বনি। ভক্তি ধর্মের বাহন। ধর্মের মধ্যে তাই ভক্তিকে মূর্ত হয়ে উঠতে দেখা যায়।পৃথিবীর সব ধর্মেই ভক্তি আছে।তবে সব ধর্মে ভক্তি নিবেদনের মাধ্যম হিসেবে নির্মল সৌন্দর্যের প্রতীক, পুষ্পকে গ্রহণ করা হয়েছে। তাই পূজা পুষ্পের ভেতর দিয়েই সম্পন্ন হয়।পূজা অর্থাৎ পুষ্পকর্ম, ফুল দিয়ে অর্চনা। আসলে বনফুলে পূজা হয় না-মনফুলেই পূজা করতে হয়।মনফুলকে প্রত্যক্ষভাবে দেবতার পায়ে অর্পণ করতে না পেরে আমরা বনফুলের সাথে মনফুল অঞ্জলি হয়ে থাকে।মনকে দেবতার পায়ে নিবেদন করবার উপযুক্ত সুন্দর শুভ্র মাধ্যম পুষ্প।তাই বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন - পুষ্প আপনার জন্যে ফোটে না, তোমার হৃদয় কুসুমকে পরের জন্যে প্রস্ফুটিত করিও।প্রাচীনকালে সনাতন ধর্মে ফুল দিয়ে অর্চনা অর্থাৎ পূজা ছিলো না।উপনিষদের ঋষিগণ নিরাকার ব্রম্মের চিন্তায় মগ্ন থাকতেন।কিন্ত কালক্রে ফুল দিয়ে অর্চনা আরম্ভ হয়।পুরাণের উপাসনার নামও পূজা কেবল পরিবার - পরিজনের মঙ্গলের জন্যে নয়,বিশ্বের কল্যাণের জন্যেই অনুষ্ঠিত হয়।সনাতন ধর্মে বিভিন্ন প্রকারে পূজা হয়ে থাকে।কেউ ফুলে - জলে করেন, আবার কেউ ষোড়শোপচারেও পূজা করেন তাঁরা গরমের দিনে পাখার বাতাস আর শীতের দিনে পশমী কাপড়ে মূর্তিকে অবরিত করতে দ্বিধা করেন না।যিনি শীত ও গ্রীষ্মের জন্মদাতা, যাঁর শাসনে চন্দ্র - সূর্য, গ্রহ- তাঁরা,আকাশ - বাতাস সর্বদা নিজ নিজ কাজে নিযুক্ত রয়েছে,তিনি যে শীত ও গ্রীষ্মে কষ্ট পান - এটা কল্পনা। ভাবগ্রাহী জনার্দন - ভাবের ভিখারি, ভক্তির কাঙ্গাল - দ্রব্যের নয়। ভক্তি ভাব টুকুই তিনি গ্রহণ করেন।সাকারকে অবলম্বন করেই মূখ্যত পূজা হয়ে থাকে।সাকার পূজা করতে করতে মন নির্মল হয়।বুদ্ধি উন্নত হয় আর নিরাকার নির্গুণ স্বরুপের ধারণা শক্তি জন্মে।মনের ভাবধারার বিকাশ সাধন করাই হচ্ছে পূজার আসল উদ্দেশ্য।আর সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যেই ভগবানকে রক্ষকত্বে বরণ করতে হবে, তাঁকে একান্তভাবে আত্নসর্ম্পণ করতে হবে।
এতক্ষণ গেলো পূজার কথা। এবার আসা যাক কালীর কথায়।কালীর কথা বলতে গেলেই শক্তি উপাসনার কথায় আসতে হয়।সমগ্র বিশ্ববিধানের অন্তরালে একটি সর্বশক্তিময়ী মাতৃকাবোধের প্রভাব অতি প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতায় স্বীকৃতি লাভ করে আসছে।ঋকদেবেও এই আদ্যশক্তির উল্লেখ আছে।মার্কন্ডেয়পুরাণ, দেবী ভাগবত, ব্রম্ম বৈরর্ত পুরাণ কালিকা পুরান প্রভৃতি গ্রন্থে এই দেবীর আখ্যান নানাভাবে উল্লেখিত হয়েছে।পান্জাবের হরপ্পা ও সিন্ধুর মহেন্জোদারো নগরে শক্তিপূজা প্রচলিত ছিল।এই দুই নগরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে অসংখ্য মৃণ্ময়ী দেবীমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।নারী শক্তির পূজা মূখ্যত প্রাচীনকালের মাতৃতান্ত্রিক পরিবার থেকেই শুরু হয়।তখন নারীরাই ছিলো পরিবারের প্রধান।আজ থেকে আট হাজার বছর পূর্বে ভোগলা নদীর তীরে প্রথম একটি মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের পরিচয় পাওয়া যায়।যে পরিবারের কর্তী ছিলেন, নিশা"। আবার সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বেও মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের কর্তীর সন্ধান পাওয়া যায় - এমন একটি পরিবারের প্রধানের নাম ' দিবা'। এই নারীর জন্যেই জনের ( প্রজাতন্ত্র) সব প্রকার প্রতিষ্ঠা আসতো বলে সকলেই তাকে শ্রদ্ধা করতো।নারীর শক্তি ও মাতৃত্ব এমনিভাবে বহুকাল পূর্ব থেকেই পূজা পেয়ে আসছিল।বাঙালির শিরায় শিরায় শক্তি - ভাবধারা দীর্ঘকাল থেকে প্রছন্নভাবে বয়ে আসছে।অনেককাল থেকেই এদেশ তন্ত্রধান মাতৃকাপূজার পীঠস্থান, উপরন্ত প্রাচীর বৈদীক যুগ থেকে পৌরাণিক যুগের মধ্যে দিয়ে মধ্যযুগ পর্যন্ত গোটা ভারতবর্ষেই আদ্যশক্তির কোন না কোন প্রকার পূজা উপাসনা চলে আসছে।নারী শক্তির পূজার একটা বিশেষ স্হান দখল করে আছে,দূর্গা। দূর্গা চন্ডীরই নাম বিশেষ। ঋকবেদে দূর্গা অরুযী ( অরুণ বর্ণ) নামে পরিচিত। ঋকবেদে এই দেবী পূজার ব্যবস্হা নেই- তবে স্তব আছে।একথা মনে করার যথেষ্ট হেতু আছে যে, এই দেবীর পূজা দেবের কাল সাধারণ লোকসমাজে প্রচলিত ছিল।ঋকবেদে উষার উপাসনা থেকে পরবর্তীকালে দূর্গা পূজার উৎপওি হয়েছিল।পার্বতী বা দূর্গা গুহার মধ্যে থাকলে তিনি কালী,গুহামুখে অর্থাৎ গুহার বাইরে থাকলে তিনি গৌরী।জন সমাজে পূজা পাবার জন্যে দেবী গুহামুখেই থাকেন গৌরীরুপে।তাই তাঁর এক নাম দ্বারবাসিনী। দূর্গার এই দ্বারবাসিনী গৌরিরুপেই আমরা পূজা করি।দেবীর এই ভিতরে কালো আর বাইরে সাদা রুপের উল্লেখ মার্কন্ডেয় পুরাণে দেবীর কাহিনীতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।শুম্ভ- নিশুম্ভ বধের আগে দেবী পার্বতী দেবতাদের দ্বারা স্তত্নত হয়ে তাঁর " অম্বকা স্বরুপ" ( গৌরীরুপ) প্রকট করলেন- তখন দেবতাদের মনে হয়েছিলো তারদেহ থেকে অম্বিকা সও্বা বেরিয়ে আসবার পর যে খোলস দেহ রইলো তা কালী হয়ে গেল( ৮৫ অধ্যায়, মার্কন্ডেয় পুরাণ)পার্বতী হলেন পর্বতবাসিনী দেবী যাকে কঠ উপনিষদে বলা হয়েছে হৈমবতী উমা, আর পুরাণে বলা হয়েছে দেবী শারদা। ঋকদেবের বর্ণনায় দেবী হলেন আসলে গুহাবাসিনী আশ্রয়দাএী অন্ধকারের - রাএির দেবী।তিনি প্রকাশ হন উষারুপে।মার্কন্ডেয় পুরাণের কাহিনীতেও তাই।এই দেবী আরাধনার বিশেষ তাৎপর্য আছে।দশম দলে কুলুকুগুলিনীতে হাদিনী শক্তির অবস্হান। এই হাদিনীক জাগ্রত করেই সাধনা করতে হয়।শক্তি উর্দ্ধেদেশে গিয়ে পরম শিবের সাথে মিলিত হয়ে সাধককে সিদ্ধপদবাচ্য করে।শক্তি ব্যতিত কোন কাজ হয় না। কালী শক্তির প্রতীক। অসুরকে বা অশুভকে বিনাশ করতে হলে শক্তির প্রয়োজন। কালী নারীরুপিনী কেন? নারী যদি অসুর বা অশুভকে আশ্রয় দেয় তাহলে আর কেউ তাকে বধ করতে পারে না । তাই নারীরই কর্তব্য জীবন ও জগৎকে সুস্হ ও স্ফুর্ত করে তুলতে অসুর ও অশুভকে নাশ করা।
শুধু কালী পূজাতেই এই সত্য সীমাবদ্ধ নয়। আজো যদি বিশ্বে কেউ শান্তি আনতে পারে তাহলে সে নারী। নারীই পারে আসন্ন পারমাণবিক যুদ্ধ বন্ধ করতে।তাই আজকের বারুদখানা বিশ্বে শান্তির জন্য প্রয়োজন কল্যাণী নারীর চির কল্যাণময়ী হস্ত। ধ্বংসোন্মুখ পৃথিবী তাই চেয়ে আছে কল্যাণী নারীর দিকে। ব্রম্ম শক্তি। তাই ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছেন -" যেমন জল ও তাহার তরলতা, দুগ্ধ ও তাহার ধবলত্ন মণি ও তাহার জ্যোতি, সমুদ্র ও তাহার তরঙ্গ অভিন্ন।ব্রম্ম ও শক্তিও তেমনি অভেদ।যিনি কালী, তিনিই ব্রম্ম। তাইতো সাধক রামপ্রসাদের কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে -কালী ব্রম্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি। এক সময় আর্য- সমাজে সাকার উপাসনা ছিল না।কালক্রমে সাকার উপাসনা প্রবেশ করে। জীবনে যখন জটিলতার পথে অনেকখানি এগিয়ে গেল - তখন মানুষ নিরাকারে আর মনস্হির করে রাখতে পারলো না।ফলে চিন্ময়ীর ধ্যান থেকে মৃণ্ময়ীর উৎপওি হোল।শুধু কালীপূজা নয় - সনাতন ধর্মে এমন অনেক সাকার উপাসনার পদ্ধতি বিরাজমান।কিন্ত তাই বলে সনাতন ধর্মে সাকার নিরাকারের কোন দ্বন্দ্ব নেই।বরং এক উদার দার্শনিক আধ্যাত্মিক আর্দশ এই ধর্মের সকল মত ও পথকে এক মিলন মহাসাগরে লীন করেছে।সনাতন ধর্ম তার নিজের ও অপর ধর্মের কোন মত পথকে কখনো অশ্রদ্ধা করে না।সনাতন ধর্ম সাকার নিরাকার, লৌকিক - বৈদিক, যুক্তিমার্গ ভক্তিমার্গ, স্বধর্ম - পরধর্ম, স্বদেশ বিদেশ সকলকে শ্রদ্ধার উদার আসনে বসিয়ে চিরকাল ধরে অখণ্ড মানব মিলন মেলার রাগিনীই বাজিয়ে চলেছে।৯ ফেব্রুয়ারি খোকসার ঐতিহ্যবাহী ৬ শত বছরের শ্রী শ্রী রটন্তিকা কালীপূজা অনুষ্ঠিত হবে।