কবি ভক্তের মন্দির, কালের সাক্ষী কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি
তানভীর সুমন
প্রকাশিত : ০৯:৫০ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সোমবার | আপডেট: ০১:২৯ পিএম, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বৃহস্পতিবার
জোড়াসাঁকো থানা কলকাতার প্রাচীনতম থানাগুলির অন্যতম। ১৭৮৫ সালে শহরের পৌর প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের জন্য যে ৩১টি থানা সৃষ্টি করা হয়েছিল, জোড়াসাঁকো ছিল তার অন্যতম।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠা নীলমণি ঠাকুরের হাতে। পরবর্তীতে দ্বারকানাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকোর জমিতে তৈরি করেছিলেন ‘ভদ্রাসন বাড়িটি', যেখানে ১৮৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন। সেটি এখন ‘মহর্ষি ভবন’ নামে পরিচিত। ১৮২৩ সালে পাশ্চাত্যের অতিথিদের জন্য দ্বারকানাথ ‘বৈঠকখানা বাড়ি’ নামে আরেকটি ভবন তৈরি করেছিলেন। গিরীন্দ্রনাথ তাতে পরিবার নিয়ে বাস করতেন। গগনেন্দ্রনাথ এবং অবনীন্দ্রনাথ সেখানে থাকতেন, শিল্পচর্চা করতেন। পরে ভেঙে ফেলা হয় ভবনটি। ১৮৯৭ সালে ‘মহর্ষি ভবন’-এর পশ্চিমে ‘বিচিত্রা ভবন’ তৈরি করিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সে সময় বাড়িতে ছিল বাংলার শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।
আদি ব্রাহ্মসমাজ, জোড়াসাঁকো ভারতী নাট্যসমাজ, কলিকাতা হরিভক্তিপ্রদায়িনী সভা, মিনার্ভা লাইব্রেরি, ওরিয়েন্টাল সেমিনারি প্রভৃতি ইতিহাস খ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলি জোড়াসাঁকো অঞ্চলেই স্থাপিত হয়েছিল। ১৯২৯ সালে শিক্ষাবিদ গৌরমোহন আঢ্য প্রতিষ্ঠিত ওরিয়েন্টাল সেমিনারি ছিল কলকাতার প্রাচীনতম বেসরকারি ও প্রথম শ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। হিন্দুদের দ্বারা চালিত এই বিদ্যালয়ে কেবলমাত্র মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত হিন্দু ছাত্ররাই পড়াশোনার সুযোগ পেতেন।
১৯৬২ সালে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি প্রাঙ্গনে কলকাতার তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। প্রথম দিকে এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সঙ্গীত ও চারুকলা শিক্ষাকেন্দ্র; পরবর্তীকালে এখানে কলা ও মানবীয় বিদ্যা পঠন-পাঠন শুরু হয়।
তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এই বাড়িতেই জন্ম নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব। যৌবন এবং পরবর্তীকালেও অনেকটা সময় তিনি এই বাড়িতে থেকেছেন। কখনও শিলাইদহ, কখনও শান্তিনিকেতনে বাস করেছেন, কখনও বা ঘুরে-বেরিয়েছেন দেশে-বিদেশে। কিন্তু বাড়িকে ভুলতে পারেননি। বিশ্বকবির মহাপ্রয়াণ হয় এখানেই।
সোমবার এবং সরকারি ছুটির দিন বাদে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সংগ্রহশালা খোলা থাকে। প্রবেশমূল্য ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য ১০ টাকা, প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয় নাগরিকদের জন্য ২০ টাকা। সার্কের অন্তুর্ভুক্ত দেশের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ২০ টাকা, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৩০ টাকা। বিশেষভাবে সক্ষম দর্শক, পথশিশু এবং পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের প্রবেশমূল্য লাগে না। ক্যামেরা ব্যবহারের জন্য প্রতি ক্যামেরা ৫০ টাকা দিতে হয়। অবশ্য মিউজিয়ামের ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ।
ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস ও ঐতিহ্য লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায় অনন্তকাল। এ বাড়িতে পা দেয়ার পরে, চোখ বন্ধ করলে আপনি অনেক কিছু উপলব্ধি করতে পারবেন। এই মিউজিয়ামটিতে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ প্রমুখের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী। শিল্পকলা নিয়ে দুটি গ্যালারি আছে। রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত কয়েকটি গ্যালারিও মুগ্ধ করবে। এছাড়াও দেশে দেশে রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণের স্মৃতি বহন করছে জাপান গ্যালারি, চায়না গ্যালারি, ইউএস গ্যালারি এবং হাঙ্গেরি গ্যালারি। ব্রাহ্ম সমাজেরও ইতিহাসের নিদর্শন পাওয়া যাবে।পুরো বাড়িটি জুড়ে যেন বিভিন্ন দেশের শিল্প ও সংস্কৃতির ছাপ লেগে রয়েছে। প্রতি বছর এখানে ঘটা করে উদযাপিত হয় বাংলা বর্ষবরণ, পঁচিশে বৈশাখ এবং বাইশে শ্রাবণ। এখানে কবিগুরুকে অনেকেই দেবতার আসনে বসিয়ে নিত্য নৈমিত্তিক প্রার্থনা করছেন। কারণ তাদের চোখে তিনিই নমস্য ব্যক্তি। যার আরাধনায় ভক্ত মনে প্রেমের সঞ্চার হয়। গীতের সঞ্চার হয়। সঞ্চার হয় মানব ও মানবতার।