ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ নিয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম বই

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৬:৪৫ পিএম, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বৃহস্পতিবার

‘হসপিস ও প্যালিয়েটিভ কেয়ার: পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ নামের এই বইটি লিখেছেন আসিফ হাসান নবী। বইটিতে মৃত্যুপথযাত্রীদের সেবা কীভাবে দেয়া হয় সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় এ বিষয়ের ওপর লেখা এটাই প্রথম বই। মৃত্যুর আসন্ন আগমণের জন্য রোগীর অমানুষিক যন্ত্রণা এবং তা উপশমের জন্য যে যত্ন, লক্ষণ ব্যবস্থাপনা, ব্যথা উপশম, রোগীর স্বাচ্ছন্দ্য এবং জীবনযাত্রার মানের উপরে ভিত্তি করে নির্ধারিত লক্ষ্যগুলিকেই প্যালিয়েটিভ কেয়ার বলা হয়ে থাকে। একটি ঘরে প্যালিয়েটিভ রোগী থাকলে প্রাথমিকভাবে সেই রোগীকে কিছুটা প্রশমন সেবা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া আছে বইটিতে। 

শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ একটি মুহূর্ত ঘটনা, কিন্তু মৃত্যু একটি প্রক্রিয়া, যা জন্ম থেকেই শুরু হয়! অমোঘ মৃত্যু অভিজ্ঞতা সৃষ্ট প্রতিক্রিয়াই বিয়োগ শোক! অপরিণত প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুকে যেমন মেনে নেয়া যায় না, তেমনি অনিরাময়যোগ্য মৃত্যু অবধারিত জেনেও ব্যর্থ নিরাময় চিকিৎসার পেছনে ছুটে চলা অযৌক্তিক। কিন্ত ঠিক এ কাজটি করেই গত ১০০ বছর ধরে মৃত্যুকে ভয়াবহ অমর্যাদা করে নিরাময়কেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয়েছে পৃথিবীজুড়ে মানুষ। নিরাময় অযোগ্যতাকে গ্রহণ করতে শিখছি না। পৃথিবীজুড়ে এই অবস্থা, এটাই বের হয়ে এসেছে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের উপর ল্যানসেট কমিশন রিপোর্ট আর তার পরেই একই জার্নালে প্রকাশিত ‘ভ্যালু অফ ডেথ’ নিবন্ধে। 

দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই মানসিকতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজ জীবনে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যখন অর্থনৈতিকভাবে উন্নত বিশ্ব অল্প-বিস্তর সোচ্চার হচ্ছে, তখনও দরিদ্র বিশ্ব নিরব প্রায়। তাই প্যালিয়েটিভ কেয়ার, হসপিস কেয়ার একটি আলোচনাঅযোগ্য বিষয়। বই-পুস্তক রচনা, গবেষণা তো অনেক দূরের কথা। এই অবস্থায় বাংলায় হাতে গোনা ২-৩ টা বইয়ের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন আসিফ হাসান নবী, প্রায় দুঃসাহসী এক পদক্ষেপ। অভিনন্দন, তার এই যাত্রা আরো এগিয়ে যাক। 

আর দুইটি কথা। আমরা চিকিৎসা বাণিজ্যে ঢুকে গেছি। একজন নিরাময়ে অযোগ্য মানুষের ভোগান্তি কমানোর গল্পগুলো ক্রমান্বয়ে আমাদের ক্যানভাস থেকে মুছে যাচ্ছে। উঠে আসছে অযৌক্তিক এবং খানিকটা অমানবিকভাবে ব্যর্থ নিরাময়ের পেছনে ছুটতে, হতাশ হতে এবং সর্বস্বান্ত হতে। শুনেছি বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসায় আউট অব পকেট এক্সপেন্স ৬৪.৩০%! নিরাময়অযোগ্য রোগীটি মারাতো গেলেন বটে, কিন্তু তিনি কি তার সাথে সাথে পরিবারটিকেও পথে বসিয়ে গেলেন? এই মুনাফার বাণিজ্য সংস্কৃতি যদি বন্ধ না হয় তবে এর প্রবক্তা এবং নীতি নির্ধারকদেরও কোনো একদিন শূন্য ঝুলি হাতে দাঁড়াতে হবে মানুষের সামনে। তাই বর্তমানে জনস্বাস্থ্য বলছে ‘মমতাময় সমাজ’ তৈরি এখন সময়ের দাবি, যেখানে মানুষ শুধু জানাজায় এগিয়ে আসবেন না; বরং নিরাময়অযোগ্য মানুষটি যেদিন বিছানায় পড়বেন সেদিন থেকেই মমতার হাত বাড়াবেন। তাই প্যালিয়েটিভ কেয়ার একটি সামাজিক আন্দোলন! 

আমরা বহুবার শুনেছি প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা বলছে, ‘রোগটি আর ভালো হবে না, বাড়ি নিয়ে যান!’ স্বাস্থ্যকর্মী বাড়ি পাঠিয়ে খালাস। কিন্তু বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পরে রোগীটির রোগ ভালো করা না গেলেও তার কষ্ট কমানোর বিজ্ঞানসম্মত উপায়ের নাম প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা সহজ বাংলায় প্রশমন সেবা। শুধু  রোগী নয়, রোগীর পরিবারের যতœও চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই শাখাটি করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রস আধানোম বলেছিলেন, Palliative Care is the best kept secret in medical science। সেই জন্যই কি স্নাতক চিকিৎসা এবং নার্সিং শিক্ষায়, প্রশিক্ষণে নিরাময়অযোগ্যতার কোনো স্থান নেই? ভেবে দেখা ভালো এই যে মমতা, পরিচর্যা, যতœ কিন্তু আমাদের ঐতিহ্যেরই অংশ ছিল, এখনো কিছুটা আছে। শুধু দরকার ছিল ঔপনিবেশিক মানসিকতা মুক্ত হয়ে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় অংশটুকু এই মমতার ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত করা।
স্বাস্থ্যকর্মীর বৃত্ত পেরিয়ে আপামর জনসাধারণের জন্য প্যালিয়েটিভ কেয়ার একটি সামাজিক আন্দোলন! কারণ ÔDeath is everyone’s businessÕ| 
পরিসংখ্যান বলছে আমাদের দেশে প্যালিয়েটিভ রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আমরা একটু চোখ বুজলেই দেখতো পাবো আমাদের চারপাশের অন্তত ৫টি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবারে একজন বা একাধিক এই রোগী আছেন। একটি সংসারে একজন প্যালিয়েটিভ রোগী থাকলে রোগীসহ সেই পরিবারের আর সদস্যদের যে কী পরিমাণ ভোগান্তি হয় তা ভুক্তভোগীরাই একমাত্র জানে। একজন প্যালিয়েটিভ রোগীর তখন দরকার হয় একটি সম্পূর্ণ সেবার। সম্পূর্ণ সেবা বলতে এখানে ৪টি উপাদানকে বোঝানো হয়েছে: (১) শারীরিক:  ব্যথা, দৈহিক যন্ত্রণা, কাশি, জ্বর, দুর্বলতা (২) মানসিক:  উদ্বিগ্নতা, ভয়, বিষণন্নতা, রাগ (৩) সামাজিক: পরিবার, খাদ্য, কাজ, বাসস্থান ও পারস্পরিক সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা (৪) আত্মিক: জীবন ও মৃত্যুর অর্থ খোঁজা এবং শান্তিতে বেঁচে থাকার ব্যাকুলতা। এই উপাদানগুলোর কতটুকু আমরা পূরণ করতে পারি? বাংলাদেশে ডাক্তার এবং প্যারামেডিক্সের যে অনুপাত তাতে অন্য রোগীদের সেবা দেওয়ার পাশাপাশি এই বিশালসংখ্যক প্যালিয়েটিভ রোগীর সেবা দেয়ার মত প্রশিক্ষিত জনবল অপ্রতুল। 

তথ্যসূত্র বলছে বাংলাদেশে প্রতিবছর মোট মৃত্যুর প্রায় ৫৯ শতাংশরই মৃত্যু হয় অসংক্রমণ রোগে। দেশে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ রোগীর প্যালিয়েটিভ সেবার প্রয়োজন হয়। জীবনের শেষ প্রান্তে এই ধরনের রোগে আক্রান্তদের সেবা দেয়ার জনকাঠামো দেশে এখনও গড়ে উঠেনি। অথচ খুব অল্প প্রশিক্ষণে দেশের স্বাস্থ্যকর্মী বা স্বেচ্ছাসেবক সমন্বয়ে একটি প্রশিক্ষিত ‘সেবা দেওয়ার জনসম্পদ’ তৈরি করা সম্ভব। যারা, আরোগ্যাতীত রোগীদের ব্যথাহীন মৃত্যু নিশ্চিত করা, শ্বাসকষ্টে আরাম দেয়া, দুর্গন্ধযুক্ত ক্ষতস্থান পরিষ্কার করাসহ সাধারণ সেবা দিতে সক্ষম হবে।

অধুনা বিশ্বে কমিউনিটি বা সমাজভিত্তিক প্যালিয়েটিভ সেবা দেয়ার একটি ধারণা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ভারত ছাড়াও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এই পদ্ধতিতে প্যালিয়েটিভ সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এই পদ্ধতি প্রয়োগে উল্লিখিত দেশগুলোতে বেশ সফলতাও এসেছে। পাশর্^বর্তী দেশ ভারতের কেরালায় এই কর্মসূচি বেশ জনপ্রিয়। এই কর্মসূচিতে পরিবারের বাইরে সমাজের বিত্তশালী এবং জনপ্রতিনিধিরাও সম্পৃক্ত হচ্ছেন, একইসাথে সরকারেরও সমর্থন আছে। স্থানীয় আগ্রহীদের স্বল্প প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। আমাদের দেশে এ পদ্ধতিটি ২/১টি বস্তিতে চলমান থাকলেও এর সার্বজনীনতা পায়নি বা পাচ্ছে না নানা কারণে। সবেচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো দেশে সীমিত পর্যায়ে প্যালিয়েটিভ সেবা চালু থাকলেও প্রান্তিক পর্যায় যেখানে বিশাল জনগোষ্ঠির বাস তারা এ বিষয়ে অবহিত নন বা এ বিষয়ে সেসব এলাকায় কোনো কর্মসূচিও নেই। এ বিষয়ে মিডিয়ার যে ভূমিকা থাকার কথা তার অপ্রতুলতাও দৃশ্যমান।

‘হসপিস ও প্যালিয়েটিভ কেয়ার: পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ নামের এই বইটি লিখে আসিফ হাসান নবী কঠিন পথে একটি পদক্ষেপ ফেললেন। পথ চলার রাস্তাটি তৈরি করা আমাদের সবার দায়িত্ব। 

লেখক- অধ্যাপক ডা. নিজামউদ্দিন আহমদ
উপদেষ্টা, প্যালিয়েটিভ কেয়ার সোসাইটি অব বাংলাদেশ (পিসিএসবি)
সাবেক বিভাগীয় প্রধান, প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিভাগ, 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।