খননে ২৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ের পর সংকুচিত ভৈরব নদ
বেনাপোল প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ১১:১০ এএম, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সোমবার
জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় খনন করা হয়েছে যশোরের ভৈরব নদ। এতে ব্যয় হয়েছে ২৭৯ কোটি ১২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। তবে খননের আগে নদটি পাড়সহ ছিল ২৬৩ ফুট। খননের পর এখন ১০০ ফুটে এসে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া নদের বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিত ৫২টি সেতুর কারণে ভৈরব নদের নৌ-যোগাযোগ স্থাপন এবং জোয়ার-ভাটা প্রবাহ নির্বিঘ্ন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন নদী বিশেষজ্ঞরা। ভৈরব নদের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের অদূরদর্শিতাকেই দায়ী করছেন তারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ভৈরব নদের জলাবদ্ধতা নিরসন ও পানিপ্রবাহ নির্বিঘ্ন করতে ২০১৬ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। ৭২ কোটি ৮১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা ব্যয়ে নদ খননকাজ শুরু হয় ওই বছরের ১ জুলাই। পরে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তখন ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৭৯ কোটি ১২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
প্রকল্পের আওতায় চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর থেকে সদর উপজেলার বসুন্দিয়া পর্যন্ত ৯২ কিলোমিটার নদ পুনঃখনন হয়েছে। এছাড়া বসুন্দিয়া থেকে আফ্রা ঘাট পর্যন্ত চার কিলোমিটার নদ ড্রেজিং করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় শহরের প্রাণকেন্দ্র ভৈরব নদের তীরে ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০০ মিটার এলাকা সৌন্দর্যবর্ধনের কাজও করা হয়েছে। তবে নদের ওপর নির্মিত ৫২টি সেতুর দৈর্ঘ্য ১৬ দশমিক ৪ থেকে ১২০ ফুটের মধ্যে। একটি মাত্র সেতুর দৈর্ঘ্য ১৭৭ দশমিক ১১২ ফুট। অথচ নদের প্রশস্ততা ১৫০-২৫০ ফুট। এ কারণে নৌ-যোগাযোগ স্থাপন এবং জোয়ার-ভাটা প্রবাহ নির্বিঘ্ন করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, ‘সঠিকভাবে ভৈরব নদ খনন করা হয়েছে। কিন্তু নদের ওপর নির্মিত অপ্রশস্ত ৫২টি সেতুর কারণে জোয়ার আসছে না। সেতুগুলো অপসারণ করে নদের প্রশস্ততা অনুযায়ী পুনর্নির্মাণের জন্য সেতুসংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় চিঠি দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত দপ্তরগুলোর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। নদটি কচুরিপানায় ভরে আছে। সেতুগুলোর তলায় অনেক মাটি রয়েছে। নদ দিয়ে যাতে জোয়ার আসতে পারে সেজন্য বর্ষা মৌসুমের আগে কচুরিপানা এবং সেতুর নিচের মাটি অপসারণ করা হবে।’
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মুরটি গ্রামে পদ্মার শাখা জলঙ্গি থেকে ভৈরব নদের উৎপত্তি। মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে নদীটি। চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর, যশোরের তাহেরপুর, আফ্রা ও অভয়নগর এবং খুলনার ফুলতলা, দীঘলিয়া ও দৌলতপুর হয়ে খুলনা নগরীর কাস্টম ঘাট এলাকায় ভৈরব মিশেছে রূপসা নদীতে। চৌগাছার তাহেরপুরে কপোতাক্ষের উৎসমুখ থেকে খুলনার রূপসা-ভৈরবের মিলনস্থল পর্যন্ত ভৈরবের মোট দৈর্ঘ্য ১৩৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে রূপসা-ভৈরবের সঙ্গমস্থল থেকে যশোরের বসুন্দিয়া পর্যন্ত ৪১ কিলোমিটার প্রবহমান। আর বসুন্দিয়া থেকে সদর উপজেলার রূপদিয়া পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার ক্ষীণধারায় প্রবহমান। সেখান থেকে চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুরের কপোতাক্ষের উৎসমুখ পর্যন্ত ৭১ কিলোমিটার প্রবাহহীন।
সরজমিন আফ্রা ঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, নদ ভরে আছে কচুরিপানায়। সদর উপজেলার মাথাভাঙ্গায় সংকীর্ণ সেতুর সামনে বাঁশের লাঠি পুঁতে কচুরিপানা আটকে মাছ চাষ করা হচ্ছে। বাঘারপাড়া উপজেলার ছাতিয়ানতলা পর্যন্ত নদের স্রোত কিছুটা বেশি। ছাতিয়ানতলায় নদের ওপর নির্মিত পুরনো সেতু ভেঙে নতুন একটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। সেতু নির্মাণ করতে নদের মাঝখানে কিছুটা জায়গা ফাঁকা রেখে দুই পাশে মাটি দিয়ে বাঁধ দেয়া হয়েছে।
স্কুল শিক্ষক এবাদুল হক বলেন, ‘নদ খনন করে কোনা লাভ তো হয়নি বরং ক্ষতি হয়েছে। খননের পর নদের পাশের সব জায়গা দখল হয়ে গেছে। আগে নদটি পাড়সহ ছিল ২৬৩ ফুট। খননের পর এখন দাঁড়িয়েছে ১০০ ফুটের মতো। এখন নদে পাঁচ-ছয় ফুট পানি আছে।
এদিকে নদের ওপর সরু সেতুগুলো দ্রুত সম্প্রসারণে পানি উন্নয়ন বোর্ড গত বছরের ২ ফ্রেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, ভৈরব নদের ওপর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের ২৩টি, ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তরের ১৯টি, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের তিনটি, সড়ক ও জনপথের পাঁচটি, রেলওয়ে ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের একটি করে সরু সেতু রয়েছে। এসব সেতুর কারণে নৌ-যোগাযোগ স্থাপনসহ জোয়ার-ভাটা প্রবাহ নির্বিঘ্ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘ভৈরব নদের ওপর নির্মিত সেতুগুলো দীর্ঘ করার কাজ শুরু হয়েছে। তিনটি সেতু সম্প্রসারণে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র পাওয়া গেছে। আরও একটি সেতুর ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করা হয়েছে। ছাড়পত্র পাওয়া তিনটি সেতুর মধ্যে দুটির প্রকল্প প্রস্তাবনা এবং একটি সেতুর নকশা তৈরি করে অনুমোদনের জন্য প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।’
এএইচ