অবৈধপথে ইতালি, ১০ বছরে মাদারীপুরে নিহত শতাধিক যুবক
কালকিনি (মাদারীপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ১০:১৮ এএম, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১০:২০ এএম, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বৃহস্পতিবার
অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাবার ঘটনায় বাড়ছে প্রাণহানি। দালালের প্রলোভনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুবকরা সমুদ্রপাড়ি দিতে গিয়ে পড়ছে মৃত্যুর মুখে। এতে নিঃশ্ব হচ্ছে অনেকে পরিবার। গেল ১০ বছরে মাদারীপুরে ৩২৯টি মানবপাচার মামলা হলেও একটিরও হয়নি বিচার। ফলে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে দালালচক্র।
সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলে এই অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব বলে দাবি পুলিশের।
ভুক্তভোগী পরিবার ও বেশ কয়েকটি এলাকাঘুরে জানা যায়, কোনভাবেই থামছে না অবৈধপথে ইতালি যাবার প্রবণতা। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে বাড়ছে প্রাণহানী। গেল ১০ বছরে মারা যাবার মধ্যে মাদারীপুরের রয়েছে শতাধিক যুবক। এখনও নিখোঁজ অনেকেই।
সবশেষ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তিউনিসিয়ায় নৌকায় আগুন ধরে মারা যাওয়া ৮ বাংলাদেশির মধ্যে ৫ জনই ছিল মাদারীপুরের বাসিন্দা।
স্থানীয়রা জানায়, এলাকার অল্প বয়সী তরুণ ও যুবকরা দালালদের প্রলোভনে ভিটেমাটি বিক্রি করার পাশাপাশি সুদে টাকা এনে বিদেশে পাড়ি দেয়। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে পরিবারগুলো।
মানবধিকার কর্মীরা বলছেন, দালালচক্রকে নির্মূল না করায় একের পর এক নৌকাডুবিতে মারা যাচ্ছে মানুষ। প্রতিরোধে প্রয়োজন জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিকতা আর সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় জেলাজুড়ে গড়ে উঠেছে একাধিক দালালচক্র। থানায়ও রয়েছে বড় সিন্ডিকেট। যদিও পুলিশ বলছে, শুধু আইনের প্রয়োগেই থামবে না এই অপরাধ। গড়ে তুলবে হবে সামাজিক আন্দোলন।
জেলা পুলিশের তথ্য মতে, গেল ১০ বছরে মাদারীপুরে ৩২৯টি মানবপাচার মামলা হয়েছে। এরমধ্যে মীমাংসা হয়েছে ১১১টি মামলার। বিচার হয়নি একটিরও। এমন দুর্ঘটনায় নিহতের স্বজনদের অনেক সময় মামলাও করতে দেয়ানা দালালচক্র। সামান্য কিছু টাকা দিয়ে মীমাংসার চেষ্টা চালায় তারা। এতে কমছে না এমন দুর্ঘটনায় প্রাণহানীর সংখ্যা।
একাধিক সূত্র জানায়, ২০১৩-২০২৩ এই ১০ বছরে মাদারীপুরে আদালত ও থানায় মানবপাচারের মোট মামলা হয়েছে ৩২৯টি। এরমধ্যে জেলার বিভিন্ন থানায় মামলার সংখ্যা ২৯২টি ও আদালতে ৩৭টি মামলা দায়ের হয়। মামলায় মোট আসামি ১৪৬৬ জন হলেও গ্রেফতার হয় মাত্র ২৮৭ জনকে। আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয় ৯৬টি মামলার, আর আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা পড়ে ৮৭টি মামলার।
এছাড়া এখন পর্যন্ত ১১১টি মামলা মীমাংসা হওয়ায় বাদী মামলা প্রত্যাহার করেছেন। গত ১০ বছরে অবৈধপথে ইতাতি পাড়ি জমিয়েছে ৫৫০০ জন।
বিভিন্ন মামলা, ভুক্তভোগী স্বজন ও জেলা পুলিশ সূত্রে দালালদের তালিকায় যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন- গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের সুন্দরদী গ্রামের মোশারফ কাজী, একই উপজেলার গজারিয়া গ্রামের রহিম শেখ, মাদারীপুর সদর উপজেলার কুমড়াখালী গ্রামের এমদাদ বেপারী, একই উপজেলার বড়াইলবাড়ীর জামাল খান, দক্ষিণপাড়ার সামাদ বেপারী, চর-নাচনার আতিবর মোড়ল ও কাশেম মোড়ল, বড়াইলবাড়ী গ্রামের সবুজ মীরা, জামাল খান, রুবেল খাঁ, সুমন মীরা, শ্রীনাথদি বাজিতপুরের জাহাঙ্গীর হাওলাদার, চাছার গ্রামের ইউসুফ খান জাহিদ, গাছবাড়িয়া গ্রামের নাসির শিকদার, রাজৈর উপজেলার বদরপাশা গ্রামের জুলহাঁস তালুকদার, একই উপজেলার তেলিকান্দি গ্রামের মনিকা বেগম, শাখারপাড়ের কামরুল মোল্লা ও এমরান মোল্লা, আমগ্রাম কৃষ্ণারমোড় এলাকার শামীম ফকির ও সম্রাট ফকির, শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া গ্রামের শহিদুল মাতুব্বর ও সিরাজ মাতুব্বর।
মানবধিকারকর্মী মশিউর রহমান পারভেজ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অবৈধপথে ইতালিতে যাবার সময় মাদারীপুরের যুবকরা মৃত্যুর মুখে পড়ে যায়। অনেক সময় মারাও গেছে অনেকেই। দালালদের বিচার না হওয়ার কারণেই এই অপরাধ কমছে না। মানবপাচারের ঘটনায় দালালদের কঠিন বিচার হলে সমাজ থেকে এই অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব।
মাদারীপুর আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুলাহ আল মামুন বলেন, এলাকাভিত্তিক গড়ে উঠেছে দালালচক্র। এই চক্রটি শক্তিশালী হওয়ায় বাদীকে অনেক সময় মামলা তুলে নিতে ভয়ভীতি দেখায়। এতে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে দালালরা।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম জানান, শুধু আইনের প্রয়োগ করেই দালালকে নির্মূল করা সম্ভব না। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন, পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের সচেতনাবৃদ্ধি করতে হবে। তাহলে সমাজ থেকে দালাল নির্মূল হবে। এছাড়া মানবপাচার মামলায় অনেক দালাল গ্রেফতারের পর জামিনে বেড়িয়ে এসে আবারও একই কাজে লিপ্ত হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুললেই এই ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি হবে না।
এএইচ