ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

থ্যালাসেমিয়া পেশেন্টস এন্ড প্যারেন্টস মিট-আপ অনুষ্ঠিত 

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৪:৫১ পিএম, ১০ মার্চ ২০২৪ রবিবার

জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে গত ৮ মার্চে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো উই আর নট এলোন (আমরা একা নই)-WANA আয়োজিত তৃতীয় থ্যালাসেমিয়া পেশেন্টস এন্ড প্যারেন্টস' মিট-আপ ২০২৪। এই অনুষ্ঠানে সারা বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক থ্যালাসেমিয়ার রোগী ও তাদের অভিভাবকগণ অংশগ্রহণ করেন। যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বরগুনা-২ আসনের সংসদ সদস্য সুলতানা নাদিরা। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক ওয়াকার আহমেদ খান। 

কী-নোট স্পিকার হিসেবে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক ডা: মো: বেলায়েত হোসেন। অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ডা: তাসনিম আরা, ডা: মঞ্জুর মোর্শেদ, ডঃ মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন, ডা: সালমা সাদিয়া, মোঃ শফিকুর রহমান সহ বিশিষ্ট অতিথিগণ তাদের মূল্যবান বক্তব্য রাখেন।

মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কেক কাটা, কুইজ প্রতিযোগিতা, র‍্যাফেল ড্র ও পুরষ্কার বিতরণী সহ নানা আকর্ষণীয় আয়োজনের মধ্য দিয়ে সকলে দিনটি আনন্দে কাটান। এছাড়াও ছিল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণকে সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ।

প্রধান বক্তা হিসেবে অধ্যাপক ডাঃ মোঃ বেলায়েত হোসেন থ্যালাসেমিয়া রোগীদের সামগ্রিক শারীরিক, সামাজিক ও আর্থিক সমস্যা এবং ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরেন। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত পরিবারের দুর্দশার কথা উল্লেখ করে তিনি বর্তমান সরকারকে প্রতিটি বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের অনুরোধ জানান এবং ওষুধ ও চিকিৎসার খরচ বহনে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। 

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ১০ থেকে ১২% মানুষ অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি জনগণ এই রোগের বাহক যাদের বিয়ের আগে হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস টেস্ট করে তাদের সন্তানদের এই রোগ থেকে বাঁচানোর সুযোগ আছে। এ রোগ প্রতিরোধে উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি জেলা সরকারি হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য অন্তত দুটি শয্যা সংরক্ষিত রাখার দাবি জানান তিনি। কবিরাজ ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের মিথ্যা আশ্বাসে কোনো রোগীকে বিভ্রান্ত হয়ে ভুল চিকিৎসা না নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

ওয়ানার সভাপতি কামরুন নাহার মুকুল সংগঠনটির পক্ষ থেকে রোগীদের দাবি-দাওয়া পেশ করেন যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের প্রতিটি রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য নিরাপদ রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা, বাংলাদেশের সকল থ্যালাসেমিয়া রোগীর সরকারি নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান, থ্যালাসেমিয়ার জন্য সকল প্রকার ওষুধ বিনামূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে নিশ্চিত করা এবং দেশের সকল জনগণের জন্য বাহক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা। রোগীরা চায় বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী আইন ২০১৩-এর প্রতিবন্ধী সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হোক। 

সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়মিত কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করা এবং থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে সমাজের কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা দূর করে তাদের জীবনযাত্রার উন্নতি করাও প্রয়োজন। WANA বাংলাদেশের সকল থ্যালাসেমিয়া রোগী এবং চিকিৎসকদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ডিএনএ ল্যাব স্থাপন করে গর্ভস্থ ভ্রূণ পরীক্ষার পরিধি বাড়াতে হবে যাতে বাবা-মা উভয়েই থ্যালাসেমিয়া বাহক হলে স্ত্রীর গর্ভাবস্থায় পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করা যায়। দেশের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা গর্ভবতী মহিলা এবং তাদের স্বামীদের প্রথম ভিজিটের সময় অন্যান্য পরীক্ষার পাশাপাশি হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস পরীক্ষা নিশ্চিতকরণে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন।

তারপরে তিনি আগামীদিনের জন্য WANA-এর কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেন, যার মধ্যে রয়েছে ঢাকার বাইরের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি, বিভিন্ন সমাজসেবা সংস্থা এবং বিভিন্ন পেশাজীবীদের সহায়তায় যৌথভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সাথে সংযোগ স্থাপন করে থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসার মান উন্নয়ন, থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি এবং রোগীর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ডোনার পুল তৈরি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা, সব ধর্মের ধর্মীয় উপাসনালয়ে ধর্মীয় নেতাদের সহায়তায় সচেতনতামূলক প্রচারণা, যাকাত এবং অনুদান সংগ্রহের মাধ্যমে দরিদ্র থ্যালাসেমিয়া রোগীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং রোগীদের জন্য কর্মমূখী প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা।

তিনি থ্যালাসেমিয়া রোগীদের মধ্যে বিদ্যমান কিছু ভুল ধারণা দূর করার চেষ্টা করেন। যেমন, অনেকে মনে করেন থ্যালাসেমিয়া রোগী বিয়ে করতে পারবে না যা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। থ্যালাসেমিয়া রোগীরা অন্য একজন সুস্থ ব্যক্তিকে বিয়ে করে সন্তান ধারণ করতে পারে এবং এক্ষেত্রে শিশুর থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এছাড়াও অনেকের ধারণা থ্যালাসেমিয়া রোগীরা বেশি দিন বাঁচে না। কিন্তু নিয়মিত সহায়ক চিকিৎসার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগীরা এখন মোটামুটি স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন, উচ্চশিক্ষা লাভ করছেন, চাকুরি/ব্যবসায় কাজ করছেন বা বিয়ে করছেন এবং সংসার শুরু করছেন। থ্যালাসেমিয়া কোনো ক্যান্সার নয়, এটি সংক্রামক বা রক্তবাহিতও নয়। থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত এবং জন্মগত রোগ।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সংসদ সদস্য সুলতানা নাদিরা থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির আহ্বান জানান। তিনি বলেন ২০১৮ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থ্যালাসেমিয়া বাহক দম্পতিদের জন্য বিনামূল্যে গর্ভস্থ ভ্রূণ পরীক্ষা এবং থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য একটি জাতীয় নিবন্ধন কর্মসূচি গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। সরকার ঘোষণা করেছে ২০২৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে থ্যালাসেমিয়া নির্মূল করা হবে। তিনি এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে জাতীয় পর্যায়ে সকল থ্যালাসেমিয়া রোগীর নিবন্ধন সমাজের সকল ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের অংশগ্রহণ এবং কর্মসংস্থানসহ সকল ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ সুবিধা প্রদানকে সহজতর করবে। তিনি এই রোগ তিনি এই রোগীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার এবং কম খরচে নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন ও ওষুধ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বিয়ের বয়সের আগেই স্কুল/কলেজ পর্যায়ে হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস পরীক্ষার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ার বাহক শনাক্ত করার জন্য সাধারণ জনগণকে আহ্বান জানান যাতে সঠিক কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য অভিভাবকদের সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়।

অনুষ্ঠানের অতিথি ডক্টর মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন তার বক্তৃতায় থ্যালাসেমিয়া নিয়ে তার গবেষণার কথা উল্লেখ করে বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের থ্যালাসেমিয়া রোগীদের ৬৩ শতাংশ মা বিষণ্ণ। বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করেন তিনি। ডাঃ মঞ্জুর মোর্শেদ তার বক্তব্যে প্রধান অতিথিকে তার আশ্বাসের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, রক্তগ্রহণ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের প্রধান চিকিৎসা হলেও নিরাপদ রক্ত দেশে একটি সমস্যা। তিনি চিকিৎসক হিসেবে তার সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নের দাবি জানান। থ্যালাসেমিয়া নিবাস, মিরপুর ১২-এ একটি আশ্রয়কেন্দ্র যেখানে ঢাকার বাইরে থাকা থ্যালাসেমিয়া রোগীরা চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসার সময় বিনামূল্যে থাকতে পারেন, এটি পরিচালনা করেন ডাঃ মনজুর মোর্শেদ।

অধ্যাপক ওয়াকার আহমেদ খান তার মূল্যবান বক্তব্যে বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসা ও প্রতিরোধে ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে বলেন, হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস ও ডিএনএ ল্যাব সুবিধা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ ব্যাপারে সরকার এগিয়ে আসবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। থ্যালাসেমিয়া যোদ্ধাদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান অধ্যাপক ডাঃ তাসনিম আরা। তিনি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত পরিবারের সকল সদস্যকে হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন। তিনি থ্যালাসেমিয়াকে আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করার জন্য এবং থ্যালাসেমিয়া কোনো বাধা নয় বলে বিশ্বাস করে তাদের সন্তানদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার জন্য অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে থ্যালাসেমিয়া রোগী ও তাদের পরিবার ছাড়াও চিকিৎসক, গবেষক ও বিশেষজ্ঞ, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি, ডায়াগনস্টিক ল্যাব, ব্লাড ব্যাংক ও চিকিৎসা কেন্দ্র, থ্যালাসেমিয়া অ্যাক্টিভিস্ট ও শুভানুধ্যায়ীসহ আরও অনেকে অংশ নেন। এই আয়োজনের স্পনসর হিসেবে ছিল জেনফার বাংলাদেশ, বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস এবং ডিএনএ সলিউশন লিমিটেড। অনুষ্ঠানে মিডিয়া পার্টনার ছিল ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস এবং এটিএন নিউজ। ডিজিটাল পার্টনার হিসেবে ছিল ট্র‍্যাশ বক্স ডিজিটাল। 

২০২১ সালে ওয়ানার যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে, তারা প্রতি বছর মিট-আপ প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করে আসছে। এটি তৃতীয় থ্যালাসেমিয়া পেশেন্টস' মিট-আপ। ২৫ শে ডিসেম্বর ২০২১-এ প্রথমটি আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে শতাধিক রোগী, অর্ধশত থ্যালাসেমিয়া পরিবারের সদস্য এবং কিছু বিশিষ্ট চিকিৎসক সহ ২০০ জনেরও বেশি অংশগ্রহণকারী উপস্থিত ছিলেন। ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ তারিখে দ্বিতীয় মিট-আপ প্রোগ্রামটি সাজানো হয়েছিল, যেখানে আরও বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল।
কেআই//