ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

সংযম ও আত্মশুদ্ধির মাস রমজান

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:৫৯ এএম, ২০ মার্চ ২০২৪ বুধবার

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি রোজা। রমজান মাসে রোজা রাখা প্রত্যেক সুস্থ ও সক্ষম মুসলমানের জন্যে ফরজ। নবীজী (স) বলেছেন, ‘তোমরা রোজা রাখো যেন সুস্থ থাকতে পারো’। তাই নবী-রসুলরা এ মাসটি রোজা রাখা, আত্মশুদ্ধি ও সৃষ্টির সেবার মাঝে কাটাতেন।

মাহে রমজানের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি

> সারাদিন না খেয়ে থাকা মানে রোজা রাখা নয়। ভরপেট সেহরি-ইফতার করাতেও রোজার মাহাত্ম্য বাড়ে না। রমজানে প্রয়োজন আত্মশুদ্ধির আপ্রাণ চেষ্টা। তাই শুধু খাবারে নয়−চিন্তা, কথা ও আচরণেও সংযমী হোন।

> আরেকটি রমজান মাস পাওয়ায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে করুন। দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণে পরিকল্পিতভাবে এ মাসটিকে কাজে লাগান।

> রমজানকে কেনাকাটাসর্বস্ব করে তুলবেন না। রমজান আসার আগেই ঈদের কেনাকাটা সম্পন্ন করুন।

> কীভাবে রমজানের প্রতিটি দিন অতিবাহিত করবেন তার রুটিন করুন। এসময় রোজা রাখা ও আনুষঙ্গিক ইবাদতকেই প্রাধান্য দিন।

> সঠিক নিয়মে রোজা রাখলে আপনার দেহে অটোফেজি প্রক্রিয়ায় যেমন বিষাণু বা টক্সিনের বিনাশ ঘটবে, তেমনি মনও হবে আবর্জনামুক্ত। চিত্ত হবে প্রশান্ত। আত্মা অনুভব করবে পরমাত্মার রহমতের ছায়া।

সেহরিতে রমজানে খাবার মেন্যু

> পরিমিত ভাত-সবজি/ কলা-খেজুর/ দই-চিড়া খান।

> মাছ-গোশত জাতীয় প্রোটিন এবং তেলেভাজা খাবার বর্জন করুন। প্রোটিন পানির তৃষ্ণা বাড়ায়।

> সেহরিতে পর্যাপ্ত পানি পান করুন। তাহলে ভালো বোধ করবেন এবং সারাদিনে পানির তৃষ্ণা কম অনুভূত হবে।

> সেহরিতে ডাল ও ডিম সম্ভব হলে এড়িয়ে যান।

> সেহরিতে খিচুড়ি খাবেন না। খিচুড়ি পানির তৃষ্ণা বাড়ায়। তাই সারাদিন পানি পান না করার ফলে শরীরে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

ইফতারে  খাবার মেন্যু

> মাগরিবের আজান দিলে খেজুর ভালোভাবে চিবিয়ে খেয়ে পানি পান করুন; যা শরীরে এনে দেবে তাৎক্ষণিক প্রাণশক্তি। চিনির শরবতের কোনো প্রয়োজন নেই।

> মাগরিবের নামাজ পড়ে রাতের খাবার−ভাত, শাকসবজি, মাছ/ গোশত/ ডিম, ডালসহ অন্যান্য সুষম খাবার, সালাদ, লেবু, ছোলা, টক দই (ইয়োগার্ট) খান।

> ঢেঁকিছাঁটা লাল চালের ভাত বেশি উপকারী। কোষ্ঠকাঠিন্য ও এসিডিটি থেকে মুক্তি পেতে খাবারে শাকসবজির পরিমাণ বাড়িয়ে দিন।

> গোগ্রাসে নয়, ধীরেসুস্থে ভালোভাবে চিবিয়ে খান। এতে হজম ভালো হবে।

> রমজানে যত খুশি খাও, এ মাসে খাবারের কোনো হিসাব নেই−এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন।

> প্যাকেটজাত জুস বা ব্লেন্ডারে তৈরি রসের পরিবর্তে দেশীয় ফল চিবিয়ে খান। কলা বাঙ্গি আনারস পাকা পেঁপে বা যে-কোনো মৌসুমি ফল আপনার সারাদিনের পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করতে পারে।

> বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা থেকে রেহাই পেতে ইফতারে নিয়মিত কলা খান। কলায় আছে পটাশিয়াম, যা এসিডিটি নির্মূলে কাজ করে।

> বর্জন করুন ভাজাপোড়া (পেঁয়াজু চপ বেগুনি পাকোড়া ইত্যাদি), মশলাদার, গুরুপাক ও অস্বাস্থ্যকর খাবার। এ খাবারগুলো হজমে অসুবিধা করে, বুক জ্বালাপোড়া ও এসিডিটির সমস্যাও বাড়ায়।

> পোলাও বিরিয়ানি তেহারি মোগলাই হালিম, চাইনিজ ফুড, গরু ও খাসির গোশত এ মাসে যত কম খান তত ভালো।

> রাতে ঘুমানোর আগে সম্ভব হলে এক গ্লাস দুধ পান করুন।

> সারাদিন শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকলে ইফতারে দই-চিড়া ও গুড় খেতে পারেন।

বর্জন করুন ইফতার ও সেহরি পার্টি

> খাদ্য-উৎসবের নয়, খাদ্যসংযমের মাস রমজান।

> স্ট্যাটাস বাড়াতে বা ভোজন-উৎসব করতে বিলাসবহুল হোটেল/ রেস্তোরাঁ/ খাদ্যমেলায় ইফতার/ সেহরি পার্টিতে অংশ নেবেন না।

> দাওয়াতে গেলে খেজুর ও পানি দিয়ে ইফতার করুন। রকমারি ভাজাপোড়া তৈলাক্ত ও গুরুপাক খাবার থাকলে কৌশলে এড়িয়ে যান। মেজবান জোর করলে বিনয়ের সাথে বলুন, এগুলো আপনি এখন খেতে চাচ্ছেন না।

> দাওয়াতে ভাজাপোড়া তৈলাক্ত অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন দেখে মন্তব্য করবেন না। অন্যদের সামনে কোনো যুক্তি-ব্যাখ্যা দেয়ারও প্রয়োজন নেই। কিছু সময় অন্য আলাপচারিতা শেষে নিজ বাসায় এসে স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে নিন।

সেহরির পরে করণীয়

> দাঁত ব্রাশ ও ওজু করে কিছুক্ষণ বজ্রাসনে বসুন।

> আল কোরআন বাংলা মর্মবাণী অডিও শুনতে থাকুন।

> ফজরের নামাজ আদায়ের পর যতক্ষণ ইচ্ছা আল কোরআন বাংলা মর্মবাণী শুনতে/ পড়তে পারেন।

> সেহরির পর না ঘুমানোই ভালো। কিছুক্ষণ হাঁটুন। প্রাণায়াম করুন। ভোরের মেডিটেশন করে দিনের কাজ শুরু করুন।

ইফতারের আগে পালনীয়

> গৃহকর্মী ও অধীনস্থদের নিয়ে পরিবারের সবাই একসঙ্গে ইফতার করুন।

> ইফতারের ১৫ মিনিট আগে খেজুর-পানি সামনে নিয়ে সবাই মিলে বসুন। মাগরিবের আজানের আগ পর্যন্ত আল কোরআনের বাংলা দোয়ায় নিমগ্ন হোন।

> নিজের জন্যে বিশেষ প্রার্থনায় ডুবে যান। অন্যের জন্যেও দোয়া করুন। এটি দোয়া কবুলের একটি উৎকৃষ্ট সময়।

রোজার শারীরিক উপকারিতা

> আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এজিংয়ের নিউরোসায়েন্টিস্ট মার্ক ম্যাটসন ও তার গবেষণা সহযোগীরা বলেছেন, মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকায় মস্তিষ্কের বয়সজনিত রোগ যেমন− আলঝেইমার্স, হান্টিংটন্স বা পার্কিনসন্স-এর ঝুঁকি কমে।

> রোজা বা উপবাস তারুণ্যকে ধরে রাখে। কারণ অনাহারের ফলে যে সাময়িক শক্তি-সংকট হয়, তা মস্তিষ্কের কোষগুলোকে প্রোটিন উৎপাদনে উৎসাহ জোগায় এবং দেহে ইনসুলিন ছড়িয়ে পড়ে ভারসাম্যপূর্ণ মাত্রায়।

> রোজার প্রাথমিক প্রাপ্তি দৈহিক সুস্থতা। এ সুস্থতার প্রক্রিয়া ঘটে ‘অটোফেজি’-র মধ্য দিয়ে। শরীর যখন ন্যূনতম ১২-১৬ ঘণ্টার উপবাসকাল পার করে তখনই সূচনা ঘটে এ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার। (অটোফেজি নিয়ে গবেষণা করে ২০১৬ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন জাপানের কোষ-জীবতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. ইউশিনোরি ওসুমি)

> রোজা বা উপবাস দেহের অভ্যন্তরে সৃষ্ট টক্সিনের বিনাশ ঘটায়।

> মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইবনে সিনা তার বহু ক্রনিক রোগীকে টানা তিন সপ্তাহ রোজা পালনের পরামর্শ দিতেন। এ কালের বিজ্ঞানীরা দেখছেন যে, রোজা রাখলে শরীরের অতিরিক্ত ওজন হ্রাস পায় এবং বিপাকক্রিয়া শক্তিশালী হয়, যা ডায়াবেটিসকে প্রতিহত করে।

> এসিডিটি, আলসার, উচ্চ রক্তচাপ, পেটব্যথার উপশমেও রোজা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রক্তে অস্বাভাবিক কোলেস্টেরল ও  শরীরের অতিরিক্ত মেদ বা চর্বি নিয়ন্ত্রণ করে।

> লিভার, প্লীহা, কিডনি, মূত্রথলি ও পরিপাকতন্ত্রের সুস্থতায় রোজা বিশেষভাবে কার্যকরী। দেহের প্রজনন অঙ্গসমূহকে নব জীবনীশক্তি দান করে। হাঁপানি, হৃদরোগ, মহিলাদের পিরিয়ডের গোলযোগ, আর্টিকেরিয়া (এক ধরনের চর্মরোগ), মাইগ্রেনের নিরাময়ে রোজা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

> ধূমপান ও অন্যান্য নেশা এমনকি ভার্চুয়াল ভাইরাস আসক্তি থেকে মুক্তির জন্যেও রমজানে রোজা পালন একটি সুন্দর চর্চা।

রমজানে বর্জনীয়

> এতক্ষণ পানি পান না করে থাকতে হবে!−এ ধরনের চিন্তা।

> ‘রোজা লেগেছে’/ ‘রোজায় ধরেছে’ মন্তব্য করা।

> দেরিতে ইফতার করা।

> ইচ্ছাকৃতভাবে সেহরি না খাওয়া/ ইফতার ও সেহরিতে বেশি বেশি খাওয়া।

> ক্ষুধায় কাতর হয়ে অন্যদের সাথে খিটখিটে আচরণ করা।

> শেষের ১০ দিন কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকা।

> দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে/ স্ক্রিনের সামনে কাটানো।

> আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত ইফতার আয়োজনে ব্যস্ত থাকা।

রমজানে ইবাদত

> রমজান মাসের নফল ইবাদত ফরজ আদায়ের সমান সওয়াবের। আর একটি ফরজ ইবাদত ৭০টি ফরজ আদায়ের সমান সওয়াবের। এ মাসের প্রথম ১০ দিন রহমতের, পরের ১০ দিন মাগফেরাতের আর শেষ ১০ দিন হলো নাজাত অর্থাৎ জাহান্নাম থেকে মুক্তির। −বায়হাকি

> রোজার মূল লক্ষ্য আল্লাহ-সচেতনতা (তাকওয়া)। আল্লাহ-সচেতনতার অর্থ আল্লাহকে ভালবেসে প্রতিটি কাজে তাঁর বিধান অনুসরণ করা। কোরআন চর্চা আল্লাহ-সচেতনতা বাড়ায়। মহাগ্রন্থ কোরআন নাজিলের মাস হিসেবে রমজান মর্যাদায় অনন্য। তাই ফজরের নামাজের পরে ও সারাদিনে অন্তত ৩০ মিনিট পড়ুন আল কোরআন বাংলা মর্মবাণী।

> নামাজ আদায়ের পর নীরবে ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’, ৩৩ বার ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবর’ পড়ুন।

> নবীজীর (স) সুন্নত হিসেবে তারাবীহ পড়তে সচেষ্ট হোন।

> সেহরির আগে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় উত্তম ইবাদত।

> নবীজী (স) বলেছেন− ‘এ মাসে এমন একটি রাত (শবে কদর) আছে, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।’ তাই রমজানের শেষ ১০ দিনের প্রত্যেক বেজোড় রাতকে কদর-এর মহিমান্বিত রাত মনে করে ফজর না হওয়া পর্যন্ত ইবাদতে মগ্ন থাকুন, ডুবে যান কোরআনের মর্মবাণীর গভীরে।

> ইফতারের আগে ও তাহাজ্জুদের সময় নিজের অতীত ভুলত্রুটির জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করুন। প্রতিজ্ঞা করুন এ ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি না করার।

> নবীজী (স) সৃষ্টির সেবায় কাজ করাকে রমজানে এতেকাফের চেয়েও বেশি সওয়াবের বলে উল্লেখ করেছেন।

> দিন শুরু করুন দান করে। অসহায়-বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে নিজে দান করার পাশাপাশি অন্যকেও দানে উৎসাহিত করুন।

> রক্তদান অত্যন্ত পুণ্যের। বিশিষ্ট মুফতিদের অভিমত হচ্ছে, ইফতারের পরে বা শারীরিক সামর্থ্য থাকলে রোজা রেখেও রক্ত দেয়া যায়। তাই মুমূর্ষের জীবন বাঁচাতে রক্তদান করুন।

> রমজান মাসেই সঙ্ঘবদ্ধভাবে যাকাত আদায়ে সচেষ্ট থাকুন। যাকাত−দাতার সম্পদে বরকত আনে, গ্রহীতার দারিদ্র্য দূর করে।

> আল কোরআন বাংলা মর্মবাণী চারপাশের ৪০ ঘরে পৌঁছে দিন। প্রতিটি পরিবারে পৌঁছে যাক শান্তি কল্যাণ ও সমমর্মিতার শাশ্বত বাণী।

> আল্লাহর মহিমা ও গুণাবলি নিয়ে ভাবুন। তাঁর নৈকট্যলাভের উপায় নিয়ে চিন্তা করুন। তাঁর কাছে নিজেকে সঁপে দিন।

> এ মাস রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও জান্নাত লাভের মাস। তাই যত বেশি সম্ভব পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করুন।

আত্মশুদ্ধির পথে ধাপে ধাপে

> সমমর্মিতা অনুশীলনের এ মাসে পরচর্চা ও গীবত নিজে করবেন না। অন্যেরা করলেও আপনি অংশ নেবেন না।

> ধৈর্য ও সহনশীলতা অনুশীলনের মাস রমজান। আর ধৈর্যের প্রতিদান জান্নাত। রোজাদার অবস্থায় অপ্রয়োজনীয় কথা বিতর্ক ঝগড়া উত্তেজনা চেঁচামেচি ও দুর্ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। অন্যেরা করলেও প্রশান্ত থাকুন।

> আপনার সাথে কেউ যেচে এসে বিবাদ করতে চাইলে বিনীতভাবে তাকে বলুন যে, আপনি রোজাদার।

> খাদ্যে ভেজাল, ওজনে কম দেয়া, রমজান ও ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত মুনাফা, অসহায়ের ওপর জুলুম করা থেকে বিরত থাকুন।

> স্মার্টফোন থেকে ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, স্ন্যাপচ্যাট, ভার্চুয়াল গেম, ইনস্টাগ্রাম, নেটফ্লিক্স ইত্যাদি অ্যাপগুলো ডিলিট করুন। ভার্চুয়াল ভাইরাস থেকে মুক্তির এ প্রয়াস আপনাকে সবসময় আল্লাহর রহমতের ছায়ায় রাখবে।

> রমজান মাসে আল্লাহর নৈকট্যলাভের নিয়তে আত্মিক পবিত্রতা অর্জনকেই বেশি গুরুত্ব দিন। নিয়মিত দুবেলা মেডিটেশন করুন।

> রমজানে যে সু-অভ্যাসগুলো আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছেন, তা ধরে রাখুন রমজান-পরবর্তী সময়েও। তাহলে এই সু-অভ্যাসের অফুরন্ত রহমত ও বরকত আপনি পেতে থাকবেন বছরজুড়ে।

এমএম//