সীতাকুণ্ডের ৩৭ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে বিকল্প প্রস্তাবনা
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৬:১০ পিএম, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ বুধবার
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ৩৭ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে সরকারের কাছে বিকল্প প্রস্তাবনা তুলে ধরেছে সীতাকুণ্ড নাগরিক সমাজ।
আজ বুধবার (২৪ এপ্রিল) চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সীতাকুণ্ড নাগরিক সমাজের পক্ষে সদস্য সচিব ও বিশিষ্ট শিল্পপতি মাস্টার আবুল কাশেম।
বলা হয়, সরকার সীতাকুণ্ড উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত চার লেইনের জাতীয় মহাসড়ককে দশ লেইনে উন্নীত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কোন দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির জন্য সড়ক, মহাসড়ক, এক্সপ্রেসওয়ের কোন বিকল্প নেই। জাতীয় স্বার্থে এবং দেশের নাগরিক হিসাবে এই উন্নয়নে সীতাকুণ্ডবাসীও গর্বিত অংশীদার হতে আগ্রহী। কিন্তু চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাসিন্দাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে বিকল্প থাকা সত্ত্বেও ঘনবসতিপূর্ণ সীতাকুণ্ড এলাকার বিদ্যমান চারলেইন সড়ককে দশ লেইনে উন্নীত করার ঘোষণায়।
স্বাধীনতার পূর্বে তৎকালীন সরকার এলাকাবাসীর বাড়ী-ঘর ও জমি অধিগ্রহণ করে বর্তমান মহাসড়ক তৈরীর জন্য। একই ভাবে সরকারী-বেসরকারী স্থাপনা, বড় বড় মিল-কারখানা স্থাপনের কারণেও বসতি ও নিজের বাপ-দাদার ভূমি হারাতে হয় সীতাকুণ্ডের মানুষকে। সেই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
২০১৬ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করণের কাজ শেষ হয়। এতে সীতাকুণ্ডের মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিশেষতঃ এই মহাসড়কের পাশে চলাচলের জন্য সার্ভিস লেইন নির্মাণ না করে বন্ধ করে দেয়া হয় যুগ যুগ ধরে চলাচলরত রিক্সা, অটোরিক্সাসহ ধীর গতির যানবাহন। এতে বিপাকে পড়েন এখানকার লাখ লাখ মানুষ।
নতুন করে দশ লেইন করা হলে অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকার বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা, হাট-বাজার, বাড়ী-ঘর, মসজিদ-মন্দির, কবরস্থান, শ্মশানসহ শত শত গুরুত্বপূর্ণ, ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহি স্থাপনা চিরতরে হারিয়ে যাবে। এ ছাড়াও মহাসড়কের দুই পাশে থাকা হাজার হাজার বিরল প্রজাতির বৃক্ষ এবং জীববৈচিত্র অধিগ্রহণের মধ্যে পড়ে ধংস হয়ে যাবে।
আমরা দেশের ইকোনমিক লাইফ লাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দশ লেইন করার বিপক্ষে নই। কারণ এটির সঙ্গে দেশের অগ্রগতি ও উন্নতি জড়িত। কিন্তু পূর্বে পাহাড়, পশ্চিমে সন্দ্বীপ চ্যানেল বেষ্টিত উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত সীতাকুণ্ড উপজেলার আয়তন প্রায় ৪৮৪ বর্গ কিলোমিটার। ছলিমপুর, ভাটিয়ারী ও সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কোন কোন এলাকার ব্যাস সন্দ্বীপ চ্যানেল থেকে পাহাড় পর্যন্ত দুই কিলোমিটারেরও কম। সমুদ্র ভাঙ্গনের কারণেও সীতাকুণ্ডের উপকূলীয় এলাকার মানুষ হারিয়েছে তাদের হাজার হাজার একর জমি ও বসতভিটা।
সীতাকুণ্ডের উপকূলীয় এলাকা এমনিতেই ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক ক্ষতির জন্যও সংবেদনশীল। সীতাকুণ্ড বাংলাদেশের সবচেয়ে সক্রিয় সিসমিক ফল্ট লাইন সীতাকুণ্ড-টেকনাফ ফল্টে অবস্থিত। তাই বিদ্যমান মহাসড়ক দশ লেইন না করে উপকূলীয় এলাকা দিয়ে মেরিনড্রাইভ নির্মাণ করা হলে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে এই জনপদ যেমন রক্ষা পাবে তেমনি দশ লেইন সড়কের জন্য বিপুল অংকের ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি অধিগ্রহণও করতে হবে না। আর ভূমিকম্প বা অন্য কোন প্রকৃতিক দুর্যোগে বিকল্প হয়ে উঠতে পারে উপকূলীয় (মেরিন ড্রাইভ) সড়ক বা পাহাড়ের পাশে বিকল্প মহাসড়ক। এতে রক্ষা পাবে অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসাসহ অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান।
ঘোষিত দশ লেইন মহাসড়ক করা হলে সীতাকুণ্ড উপজেলার বাসিন্দাদের পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম এবং পশ্চিম দিক থেকে পূর্বে স্বাভাবিক যাতায়াত বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ বর্তমান চার লেইনের মহাসড়কে কোন আন্ডারপাস ও সার্ভিস সড়ক না থাকায় এখনই এই অবস্থার সৃস্টি হয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় ও যাতায়াতের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় প্রতিবছর সড়ক পারাপারে দুর্ঘটনায় বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। দশ লেইন হলে এই মহাসড়কে প্রতিদিন মানুষের প্রানহানির সংখ্যা আরও অত্যধিক বৃদ্ধি পাবে।
জনবহুল সীতাকুণ্ড এলাকার উপর দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন থেকে দশ লেইনে উন্নীত না করে এর কতিপয় বিকল্প প্রস্তাব সংবাদ সম্মেলনে পেশ করা হয়।
প্রথম বিকল্প: বর্তমানে পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত এবং মীরসরাই ইকোনমিকজোনের উপকূল হয়ে সীতাকুণ্ডের ১নং সৈয়দপুর ইউনিয়নের উত্তর বগাচতর পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এখন বাকি আছে ফৌজদারহাট থেকে সীতাকুণ্ডের ১নং সৈয়দপুর ইউনিয়নের উত্তর বগাচতর পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, এই প্রকল্পের সবকিছু চূড়ান্ত করা আছে সরকারের সংশ্লিস্ট দপ্তরে। এই মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করা হলে নির্বিঘ্নে যানবাহন চলাচলের পাশাপাশি জনদুর্ভোগ ও সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে।
দ্বিতীয় বিকল্প: বিদ্যমান চার লেইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশ (সিটি গেইট থেকে বড় দারগাহাট পর্যন্ত) চার বা ছয় লেনের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ। এটি করতে দশ লেইনের চেয়ে খরচ কম হবে বলে সড়ক নির্মাণ বিশেষজ্ঞদের ধারনা। এতে বিপুল সরকারী অর্থ ব্যয়ে মানুষের জমি ও বড় বড় স্থপনা অধিগ্রহণও করতে হবে না। সার্ভিস লেইন ও আন্ডার-ওভারপাস ছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার ওপর দিয়ে আট/দশ লেনের মহাসড়ক করার নজীর কোন দেশে আছে বলে আমাদের জানা নেই। বরং জনসাধারণকে বাঁচাতে দেখা যায় ভিন্ন নজীর। উল্লেখ্য যে, থাইল্যাণ্ডের রাজধানী ব্যাংকক থেকে পর্যটন নগরী পাতায়া যেতে প্রায় ১৪৭ কিলোমিটার ব্যাপী ১২ লেইনের এক্সপ্রেসওয়ের মধ্যে প্রায় ৯৪ কিলোমিটারই উড়াল সড়ক। এর দুই পাশে চলাচলের জন্য রাখা হয়েছে পর্যাপ্ত সড়ক ও উড়ালপথ।
তৃতীয় বিকল্প: ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল লাইনের পূর্বে (ফৌজদারহাট থেকে চিনকি আস্তানা) পাহাড়ের পাশ দিয়ে মহাসড়ক নির্মাণ।
সংবাদ সম্মেলনে সীতাকুণ্ড নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক ও ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. ফসিউল আলম, শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর, সীতাকুণ্ড নাগরিক সমাজ এর সমন্বয়ক লায়ন মো. গিয়াস উদ্দিন, সীতাকুণ্ড সমিতি-চট্টগ্রামের সভাপতি মো. নাছির উদ্দিন মানিক, এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার আবুল হাসনাত, সীতাকুণ্ড প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ফোরকান আবু, সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম শিল্পী, ননী গোপাল দেবনাথ, এড জহির উদ্দিন মাহমুদ, আবুল খায়ের মো. ওয়াহিদী, সাংবাদিক কামরুল ইসলাম দুলু, ফারুক মোনাদিন চৌধুরী, তুষার কান্তি চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার মো. আলমগীর, শিমুল চৌধুরীসহ বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন।
এএইচ