হজের শুদ্ধাচার
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:২৩ পিএম, ১৫ মে ২০২৪ বুধবার
হজের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো অন্তরের বিশুদ্ধতা ও পবিত্রতা অর্জন করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ করে এবং অশ্লীল ও গুনাহর কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়। আর মকবুল হজের পুরস্কার জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুই নয়।’ (বুখারি : ১/২০৬)
অন্তরের বিশুদ্ধতা ও হজ্জে মাবরুরই মূলত আল্লাহ তায়ালা গ্রহণ করেন। হাদিসে একথাই বলেছেন আল্লাহর প্রিয় হাবিব। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, সর্বাধিক উত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ওপর ইমান আনয়ন করা। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, এরপর কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, হজে মাবরুর বা মকবুল হজ আদায় করা।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস : ১৪২৯)
তাই হজ করতে গিয়ে তা যেন শুধু কোনও ট্যুর বা ভ্রমণ না হয়ে একান্ত আল্লাহর ইবাদতের সফর হয় এদিকে খেয়াল রাখতে হবে সবার। কেননা অন্তর থেকে যদি আল্লাহর জন্য কিছু করা না হয়, তা কোনো কাজে আসে না, আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত কখনো আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তার কাছে তোমাদের আল্লাহভীতিই পৌঁছে।’ (সূরা হজ : ৩৭)।
কেউ যদি অলসতা করে কিংবা অহংকারবশত কাবা শরিফে গমন না করে এবং আল্লাহর এই শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি না দেয়, হজ আদায় না করে; তাদের ব্যাপারে হাদিস শরিফে হুঁশিয়ারি বর্ণিত হয়েছে।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘বায়তুল্লাহর হজ করার জন্য যে ব্যক্তির পথসম্বল আছে এবং বাহন ইত্যাদির ব্যয় বহনের সামর্থ্য আছে অথচ সে হজ সম্পাদন করে না, সে ইহুদি কিংবা খ্রিস্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করুক, তাতে কিছু যায়-আসে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৮১২; বায়হাকি, হাদিস : ৩৬৯২)
উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি বাহ্যিক স্পষ্ট কোনো প্রয়োজন কিংবা অত্যাচারী বাদশাহ অথবা প্রতিবন্ধক সৃষ্টিকারী কোনো রোগের কারণে হজে গমনে বাধাগ্রস্ত হওয়া বিনে হজ না করে মৃত্যুবরণ করল, সে চাইলে ইহুদি হয়ে মরতে পারে। চাইলে খ্রিস্টান হয়ে মরতে পারে।’ (দারেমি, হাদিস : ১৮২৬; বায়হাকি, হাদিস : ৩৬৯৩)
হাদিসের মর্মকথা অনুয়ায়ী নিজের মুসলমানিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অবশ্যই হজ পালন করতে হবে। তবে তিনটি কারণে হজে যেতে অপারগ হলে তা আল্লাহর কাছে মার্জনীয় হবে—এক. পাথেয় অথবা পরিবহন সমস্যা; দুই. অত্যাচারী রাজা-বাদশাহ বা সরকারের ক্ষতির আশঙ্কা; তিন. ব্যাধির কারণে হজযাত্রায় অপারগতা। উল্লিখিত কারণগুলো ছাড়া কেউ হজ পালনে বিরত থাকলে তার মৃত্যুকে ইহুদি-খ্রিস্টানের মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছা করে, সে যেন তাড়াতাড়ি আদায় করে নেয়। কারণ যেকোনো সময় সে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে বা বাহনের ব্যবস্থাও না থাকতে পারে; অথবা অন্য কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৮৩৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৮৮৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৭৩২)
উপরন্তু যে সচ্ছল সামর্থ্যবান ব্যক্তি দ্রুত হজ আদায় করে না, একটি হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা তাকে হতভাগা ও বঞ্চিত আখ্যায়িত করেছেন।
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি আমার বান্দার শরীরকে সুস্থ রাখলাম, তার রিজিক ও আয়-উপার্জনে প্রশস্ততা দান করলাম। পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যদি সে আমার ঘরের হজের উদ্দেশ্যে আগমন না করে তাহলে সে হতভাগ্য, বঞ্চিত।’ (ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৩৬৯৫; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদিস : ১০৩১; তবারানি, হাদিস : ৪৯০)
শুধু তা-ই নয়, একসময় বায়তুল্লাহ উঠিয়ে নেওয়া হলে মানুষ হজ করতে পারবে না—এই আশঙ্কার কারণেও আল্লাহর রাসুল উম্মতকে তাড়াতাড়ি হজ করার হুকুম করেছেন। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা হজ ও ওমরাহর মাধ্যমে এই ঘরের (বায়তুল্লাহ) উপকার গ্রহণ করো। কেননা তা এর আগে দুইবার ধ্বংস হয়েছে। তৃতীয়বারের পর উঠিয়ে নেওয়া হবে। ’ (ইবনে খুজাইমা, হাদিস : ২৫০৬; ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৬৭১৮; মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস : ১০৭২; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস : ১৬৫২)
হজ করার শক্তি-সামর্থ্য ও অর্থবিত্ত থাকার পরও যে ব্যক্তি হজ করে না, তার সম্পর্কে হাদিস শরিফে কঠোর হুমকি প্রদান করা হয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করার সামর্থ্য রাখে তবু হজ করে না, সে ইহুদি হয়ে মৃত্যুবরণ করুক বা খ্রিস্টান হয়ে—তাতে আল্লাহর কিছু যায়-আসে না।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ১/৫৭৮)
ওপরে উল্লিখিত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর এই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে সামর্থ্য থাকার পরও যেসব মুসলমান হজ করে না, কিয়ামতের দিন তারা কী কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হবে। সেদিন শত অবকাশ চাইলেও তাদের আর হজ আদায়ের সুযোগ দেওয়া হবে না। ফলে তারা নিদারুণ শাস্তি ভোগ করবে।
মোদ্দাকথা, হজ পালনে বিলম্বের কোনো অবকাশ নেই। এ ব্যাপারে সামান্য উদাসীনতা সীমাহীন শাস্তি ও আজাবের কারণ হতে পারে। হজ ত্যাগকারীর বিরুদ্ধে রাসুল (সা.) ‘বিধর্মী হয়ে মৃত্যুবরণ’ করার মতো চূড়ান্ত মাত্রার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তাই কোনো প্রকৃত ঈমানদার হজ ফরজ হওয়ার পর কালবিলম্ব করতে পারে না। কারণ, হজ পালনের সামর্থ্য লাভের পর যদি হজ না করে এবং হজ করার সক্ষমতা পরবর্তী সময়ে হারিয়ে ফেলে তাহলে জীবনে সেই অপরাধ মোচনের কোনো সুযোগ থাকে না। তখন আক্ষেপ আর হতাশা ছাড়া ভাগ্যে কিছুই জোটে না।
পক্ষান্তরে হজ-ওমরাহর দ্বারা মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের কথা হাদিস শরিফে সুস্পষ্টভাবে বিধৃত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে উপযুক্ত সময়ে হজ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএম//