নদী প্রকৃতির দান যা কোন শহরের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ
তানভীর সুমন
প্রকাশিত : ১১:৩৯ এএম, ১৭ মে ২০২৪ শুক্রবার | আপডেট: ১১:৫৫ এএম, ১৭ মে ২০২৪ শুক্রবার
পৃথিবীর অধিকাংশ শহর গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। যেমন ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত অন্যতম প্রধান টেমস নদী,যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব নিউইয়র্কের মধ্য দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে হাডসন নদী, মিশরের নীলনদ, ভারতের গঙ্গা ইত্যাদি। ব্যাংকক শহরের মধ্যেও এরকমই আশীর্বাদ স্বরূপ চাও নদী। থাইল্যান্ডের মানচিত্রে চাও ফ্রেয়া নদীর নাম মেনাম বা মি । এখানে থাই ভাষায় মি অর্থ মা এবং নাম অর্থ পানি।
ব্যাংকক বা সমস্ত থাইল্যান্ড একটি পরিকল্পিত দেশ, যে দেশ খুব দ্রুত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
থাই রাজ পরিবার এ নদীটিকে গ্রান্ড ডিউক নামে অভিহিত করতেন।যার ইংরেজি অর্থ নদীদের রাজা। চাও ফ্রাওকে এখন থাইরা নদীদের রাজা হিসেবেই চেনেন। এই নদী বাম দিকে বেঁকে হয়েছে ‘পা সাক’ এবং ডানে ‘সাকেই ক্রাং’ নদী।
‘সাফান তাকসিন’ ব্যাংককে ‘চাও ফ্রেয়া’ নদীর একটি ঘাট। এখানে চারটি ঘাটে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়ার নৌকা রয়েছে। এই ঘাট থেকে নদীর পার্শ্ববর্তী চাট্রিয়াম, মান্দারিন ওরিয়েন্টাল, সাংগ্রিলার মতো পাঁচতারকা হোটেলগুলোর নিজস্ব নৌকা রয়েছে হোটেলে যাওয়া-আসার। এছাড়াও বড় ক্রুস রয়েছে পর্যটন চত্বর ‘এশিয়াটিক’-এ যাওয়ার।
ব্যাংকক শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে এ নদী। থাইল্যান্ডের নাখোন সাওন প্রদেশের পিং এবং নান নদীর মিলনস্থল থেকে চাও ফ্রেয়া নদীর উৎপত্তি। এরপরের ৩৭২ কিলোমিটার এটি ব্যাংকক শহরের মধ্য দিয়ে থাইল্যান্ডের দক্ষিণে শেষ পর্যন্ত বয়ে গেছে। এই নদীটির বেশ কয়েকটি শাখা নদী এবং খাল রয়েছে। এর মধ্যে খুলং খাল থাইল্যান্ডের ধান চাষে বড় ভূমিকা রাখছে।
১৬ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ নদীতে বেশ স্রোত রয়েছে। সাফান থাকসিন থেকে এশিয়াটিক যেতে ২০ মিনিটের ভ্রমণ। ব্যাংককের বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া এ নদী দিয়েই চলছে প্রায় দু’শ’ মিটার দীর্ঘ ফিশিং কার্গো। এতো ধীরে এ কার্গোগুলো যায়, ভালো করে না দেখলে বোঝা যায় না এটি যে চলছে। এটা মালবাহী ট্রেনের মতোই। মূল ইঞ্জিন নৌকাটি স্পিড বোটের মতো ছোট। আর পেছনে কয়েকটি কার্গো মিলে লম্বা এক ফিশিং কার্গো। ব্যাংকক থেকে থাইল্যান্ডের উপকূলীয় অঞ্চলে মাছ আনা-নেওয়ার কাজ করে এসব কার্গো।
চাও ফ্রেয়ার পার ধরে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। দু’ধারে রেস্টুরেন্ট, ক্লাব, বাজার, শপিং মল। এই নদীর প্রকৌশল কার্যক্রম বেশ পরিকল্পিত। নদীকে স্বাভাবিক রাখতে কিছু কৃত্রিম খালও খনন করা হয়েছে।
রাতে অপরুপ সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয় চাও ফ্রেয়া। পানির স্রোতের ওপর প্রতিচ্ছবি পড়ে আলো ঝলমলে ব্যাংককের। হু হু বাতাসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেন ব্যাংককবাসী। শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীকে সর্বোচ্চ কাজে লাগিয়েছে তারা। কিন্তু অল্প কিছুদিন আগেও ব্যাংককের চাও নদী ছিল প্লাস্টিক দূষণে জর্জরিত। এই নদীতে প্রাণ ফেরাতে ২০১৩ সালে ডাচ উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবক বোয়ান স্লাট এই আন্তর্জাতিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করান। তার লক্ষ্য ছিল প্লাস্টিক বর্জ্য নদ-নদী বেয়ে যেন সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে ।
ব্যাংককে ওশেন ক্লিনআপ প্রজেক্ট শুরু করতে বছর দুয়েক সময় লেগে যায়। চুলালংকর্ন ইউনিভার্সিটির সাথে মিলে ওশেন ক্লিনআপ নদীটির স্রোতের গতিবিধি বের করে। এতে বোঝা যায় কোথায় ইন্টারসেপ্টর জলযানটিকে স্থাপন করলে তা সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য আটকে ফেলতে পারবে। প্রায় ষাটটি শাখা-উপশাখা এসে মিলিত হয়েছে, নদীর এমন একটি জায়গায় স্থাপনা করা হয় জলযানটিকে। ট্রেডমিলের মাধ্যমে নদী থেকে বর্জ্য চলে যায় এই জলযানের ভেতরে, এরপর এসব বর্জ্য স্থলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তা সরিয়ে নেয়।
আমাদের শহর ঢাকার বুকেও আছে বুড়িগঙ্গা আর তুরাগ নদী। যে নদী দুটিকে ধীরে ধীরে বিষ দিয়ে ও গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে।তবে আমাদের এই নদী দূষণে শুধু প্লাস্টিকই দায়ী নয়। নদীতে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পানি থেকে রাসায়নিক দূষণ দূর করাও জরুরি, শিল্পকারখানা এবং কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিক এসে পড়ে এই নদীতে, যার ফলে দূষিত হচ্ছে নদী। এমনকি নদীর পানি অসহনীয় গন্ধ। এখনই সময় ঘুরে দাঁড়ানোর। না হলে অস্তিত্বের সংকটে ভুগবে নগরবাসী। তবে সরকারের একার পক্ষে নদীগুলো রক্ষা করা অসম্ভব। তাই সরকারের পাশাপাশি জনসাধারণকে হতে হবে সচেতন।