হামি ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার কারসাজি; জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি
মেহেদী হাসান
প্রকাশিত : ০৬:৫৯ পিএম, ১৮ মে ২০২৪ শনিবার | আপডেট: ০৭:১৭ পিএম, ১৮ মে ২০২৪ শনিবার
ইমাম বাটন তথা হামি ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারকারসাজির বিষয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন- বিএসইসির নিরবতায় হতাশ বাজার বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বন্ধ কোম্পানির উৎপাদন শুরু ও মুনাফার বানোয়াট সংবাদ দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সাথে ভয়াবহ প্রতারণা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতারণার ঘটনা ফাঁস হওয়ার পরও নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিরব থাকলে বাজারের প্রতি আস্থা হারাবেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। পাশাপাশি কারসাজিচক্র আরও আস্কারা পাবে।
একইসঙ্গে শাস্তির বদলে কারসাজির মূলহোতা কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসিব হাসানের ৫০ লাখ নতুন শেয়ার ইস্যুর একটি আবদার বিএসইসি আমলে নিয়ে তা যাচাই করার সিদ্ধান্তেও অবাক তারা।
এর আগে ডিএসইর তদন্তে মূল্যসংবেদনশীল তথ্যের নামে মিথ্যা ও জাল তথ্য প্রকাশের বিষয়টি ধরা পরে। এ ঘটনাকে লিস্টিং রুলসের ৪৫ ধারা ও সিকিউরিটিজ আইনের স্পষ্ট লংঘন উল্লেখ করে বিএসইসিতে প্রতিবেদনও জামা দিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ- ডিএসই। বিষয়টি নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে একুশে টেলিভিশনও। নামমাত্র মূল্যে আগেই কোম্পানিটির কয়েক লাখ শেয়ার কিনে মিথ্যা মুনাফার তথ্য দিয়ে ওইসব শেয়ারের দাম বাড়ানোর পর বড় অংশই বিক্রি করে দিয়েছেন হাসিব হাসান ও তার সহযোগীরা। বাজার থেকে তুলে নিয়েছেন বিপুল অর্থ।
কিন্তু তারপরও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা। উল্টো এ ঘটনা প্রকাশের পর দফায় দফায় হাসিব হাসান বিএসইসি কার্যালয়ে গেছেন। পুনঃনিয়োগ পাওয়ার পর সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আর নিজের নামে ৫০ লাখ নতুন শেয়ার ইস্যুর ব্যাপারে তদবিরও অব্যাহত রেখেছেন।
৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ দেখিয়ে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে ইমাম বাটনের (বর্তমানে হামি ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসি) ৫০ লাখ নতুন শেয়ার ইস্যুর আবেদন আগেই করেছিলন হাসিব হাসান। এই শেয়ার ইস্যু করে দিলে তার বর্তমান বাজার মূল্য হবে ৬৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিতে নামমাত্র অর্থ বিনিয়োগ করেই বিপুল অর্থের মালিক বনে যাবেন হাসিব হাসান। পাশাপাশি নিজের ছেলের নামে কুক্ষিগত এই কোম্পানিতে তার একচ্ছত্র মালিকানাও প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
হামি ইন্ডাস্ট্রিজের গুরুতর অনিয়ম খতিয়ে দেখতে কোন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে কিনা? জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগের বিপরীতে ৫০ লাখ নতুন শেয়ার ইস্যুর যে আবেদন করেছে তা যাচাই-বাছাই করে দেখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তদন্তকারী দল তার মাছের খামার ও চট্টগ্রামের কারখানা পরিদর্শ করে বিনিয়োগের সত্যতা যাচাই করে দেখবে। তারপর তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন।
ইমাম বাটন তথা হামি ইন্ডাস্ট্রিজের প্রকৃত মালিক চট্টগ্রাম ভিত্তিক ইমাম গ্রুপ। যার মালিক মোহাম্মদ আলীর হাতে কোম্পানির ১৮ দশমিক ১১ শতাংশ এবং তার স্ত্রী জেবুন্নেসা আকতারের হাতে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ শেয়ার আছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ইমাম গ্রæপের ৮শ’ কোটি টাকারও বেশি খেলাপি ঋণের কারণে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়ের করা ৫৫ মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলে স্বস্ত্রীক দেশ ছেড়ে পালান মোহাম্মদ আলী। তারপর থেকেই বন্ধ ইমাম বাটনের কারখানা।
২০২২ সালের অক্টোবরে ইমাম বাটনের মালিকানা পরিবর্তনের আবেদন করেন হাসিব হাসান। তার আগেই উইংস্ফিন, এনএলআইসহ আরও কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউজে নামে বেনামে থাকা তার বিও অ্যাকাউন্টে কোম্পানিটির কয়েক লাখ শেয়ার কিনে জড়ো করেন তিনি। ইমাম বাটন ‘জেড’ ক্যাটাগরির শেয়ার হলেও কয়েকটি অ্যাকাউন্টে আইন ভঙ্গ করে মার্জিন ঋণ ব্যবহারের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে এরই মধ্যে হাসিব হাসানের প্রতিটি বিও অ্যাকাউন্টের তথ্য সংগ্রহ করেছে ডিএসইর তদন্তকারী দল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এ তদন্ত এখনো ঝুলে আছে।
এদিকে কোম্পাানি সূত্রে জানা গেছে, বিনিয়োগের সত্যতা যাচাইয়ের বিএসইসির উদ্যোগের পর নতুন করে নড়েচড়ে বসেছেন হাসিব হাসান। বড়গুনার আমতলির শুকনো পুকুরে পানি ছেড়ে তাতে মাছের পোনা ছেড়েছেন। মাছের ফিড, পোনা কেনা-বেচার অনেক ভাউচার তৈরি করেছেন। পাশাপাশি চট্টগ্রামের কারখানার জন্য চামড়াসহ কাঁচামাল কিনেছেন। কারখানায় নতুন করে ২৫ জন কর্মচারি নিয়োগের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত বিএসইসির তদন্ত যাতে কারখানা ও কথিত মাছের খামার খুঁজে পায় সেই চিন্তা থেকেই হাসিব হাসানের এই তৎপরতা। অভিযোগ উঠেছে, পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও বিএসইসির কিছু অসাধু কর্মকর্তা বেনামে হামি ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার ধারণ করছেন।
এ ব্যপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও পুঁজিাবাজার বিশেষজ্ঞ আল আমিন জানান, প্রথমত এ ধরণের ঘটনার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্রæত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কারণ এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো যদি নতুন শেয়ার ইস্যু করে কারসাজির সাথে জাড়িতদেরই পুরুস্কৃত করা হয়, তবে বাজারে কারসাজি চক্র আরো উৎসাহিত হবে। আর সব মিলিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি এ ধরণের ঘটনায় নীরব থাকে তবে অন্যান্য শিল্প উদ্যোক্তাদের ব্যাপারেও নানা চক্র গড়ে উঠবে।
তাই বাজারের স্বচ্ছতার স্বার্থেই নতুন শেয়ার ইস্যু তো দূরের কথা, তদন্ত সাপেক্ষে অনিয়ম ও জালিয়াতির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
এদিকে, কারসাজিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে কেন উল্টো নতুন শেয়ার ইস্যুর আবদার নিয়ে তৎপর বিএসইসি এ বিষয়ে জানতে কমিশনার অধ্যাপক শেখ সামসুদ্দিন আহমদের মোবাইলে ফোন ও এসএমএস দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
এমএম//