ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

মেডিটেশন করুন অর্জন করুন টোটাল ফিটনেস

অধ্যাপক ড. মো. মাসুদুল হক সিদ্দিকী

প্রকাশিত : ০৭:০১ পিএম, ২৪ মে ২০২৪ শুক্রবার

যে-কোনো কিছু জয় করার জন্যে প্রয়োজন টোটাল ফিটনেস। প্রয়োজন শারীরিক মানসিক সামাজিক ও আত্মিকÑ জীবনের প্রতিটি দিকের সুন্দর সমন্বয়। নিউরো সায়েন্টিস্টদের ২৫ বছরের গবেষণার সারকথা হচ্ছে, মেডিটেশন বা ধ্যান হলো ব্রেনের ব্যায়াম। ধ্যান ব্রেনের কর্মকাঠামোকে সুবিন্যস্ত, সুসংহত, গতিময় ও প্রাণবন্ত করে। ব্রেনকে বেশি পরিমাণে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করার সামর্থ্য বাড়ায়। মেডিটেশন রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে এবং মনকে প্রশান্ত করে, অস্থিরতা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ও হতাশা থেকে মুক্ত করে। অসহিষ্ণুতা রূঢ়তা ও অমানবিকতার পরিবর্তে আচরণে আনে বিনয় এবং সমমর্মিতা।

শুধু তা-ই নয়, ধ্যান মানুষকে জীবনের পরম সত্য উপলব্ধি করার স্তরে নিয়ে যায়। সত্যটা তখন আপন হয়। অন্তরে যে সুপ্ত শক্তির ভা-ার রয়েছে সে ভা-ারের দ্বার উন্মোচন করে দেয় ধ্যান। জীবনকে আশাবাদে ভরিয়ে দেয়। বিশুদ্ধ সম্ভাবনার বলয়ের সাথে আপনার সত্তাকে সংযুক্ত করে। সব মিলিয়ে ধ্যান বা মেডিটেশন টোটাল ফিটনেস অর্থাৎ শারীরিক মানসিক সামাজিক ও আত্মিক ফিটনেসের পথ উন্মোচন করে। ছন্দময় জীবনের জন্যে শারীরিক ফিটনেস নির্দিষ্ট মাপ ওজন বা আকার নয়, শারীরিক ফিটনেস নির্ভর করে একজন মানুষ ক্লান্তিহীনভাবে কতক্ষণ কাজ করতে পারেন, তার ওপর। তাই দেহের আকার-ওজনের ফ্যান্টাসি থেকে মুক্ত হয়ে গুরুত্ব দিন আপনার এনার্জি লেভেল ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার দিকে। শারীরিক ফিটনেসের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো আহার অর্থাৎ কী খাবেন, কতটুকু খাবেন কিংবা কখন খাবেন সে সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।

কী খাবেন? টিনজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের পরিবর্তে প্রাকৃতিক খাবারে অভ্যস্ত হোন। খাবারে পর্যাপ্ত শাকসবজি রাখুন। চিনির পরিবর্তে গুড় খান, খেজুর খান। মৌসুমি ফল খান। দুধ চায়ের পরিবর্তে বেছে নিন গ্রিন টি। কতটুকু খাবেন? পরিমিত খাবারই স্বাস্থ্যকর। নবীজীর (স) সুন্নত অনুসারে পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাবার, এক-তৃতীয়াংশ পানি এবং এক-তৃতীয়াংশ ফাঁকা রাখুন। কখন খাবেন? দিনের শুরুতে ভরপেট খাবার, দুপুরে তার চেয়ে কম আর রাতে আরো কম খান। হাঁটা, দৌড়ানো ও যোগব্যায়াম প্রতিদিন ৩০ মিনিট সময় রাখুন হাঁটা ও দৌড়ানোর জন্যে। এতে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকবে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমবে। যোগব্যায়াম চর্চায় মাথা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত প্রতিটি স্নায়ু-পেশি শিথিল হয়। দেহে ভারসাম্য আসে। জন্স হপকি মেডিসিনের গবেষণা রিপোর্ট অনুসারে, যোগব্যায়াম ব্যাকপেইন ও আর্থ্রাইটিস নিরাময় ও প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দেহকে টক্সিনমুক্ত করতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো বিকল্প নেই। অগণিত ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসের প্রকোপ থেকে বাঁচারও উপায় এটি। তাই দাঁত চুল নখ চোখ নাক মুখ পরিষ্কার করুন। পরিচ্ছন্ন থাকুন।

প্রতিদিন স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে গোসল করুন। এছাড়া নিয়মিত দমচর্চা বা ব্রিদিং এক্সারসাইজ করুন। বাড়বে দেহ-মনের সুস্থতা। মানসিক ফিটনেস মানসিক ফিটনেসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দৃষ্টিভঙ্গি বা ভাবনা। কারণ আমরা যা ভাবি আমরা তা-ই। ভাবনাকে যত বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল রাখা সম্ভব হবে, মানসিক ফিটনেস তত বাড়বে। বার বার শুরু করার সামর্থ্য যে মাটিতে মানুষ আছাড় খায়, সেই মাটি ধরেই আবার সে উঠে দাঁড়ায়Ñ এই উঠে দাঁড়ানোর সামর্থ্যই মানসিক ফিটনেস। এ সামর্থ্য জন্মগত নয়, নিজের ভেতরে এর উন্মেষ ঘটানো সম্ভব। তাই ব্যর্থতাকে নিয়তি হিসেবে মেনে না নিয়ে বার বার চেষ্টা করুন। সকল দ্বিধা ঝেড়ে আবার শুরু করুন। মনে রাখবেন, জীবন মানে বার বার শুরু করা। ছোট ছোট বিষয় থেকে আনন্দ খুঁজে নেয়া মানসিক ফিটনেসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি হলো সুখের অনুভূতি। সব অর্জনের পরও যদি মনে শূন্যতার অনুভূতি হয় তবে সে মানুষটি আপাতদৃষ্টিতে সফল হতে পারে কিন্তু সুখী নয়। আর পাহাড়সম মানসিক সামর্থ্যকে নিঃশেষ করে দিতে এই শূন্যতাবোধই যথেষ্ট। প্রধান দুই মানদ- প্রথমত, নিন্দা ও প্রশংসা দুটোকেই আপনি সহজভাবে নিতে পারেন কিনা।

হাততালি বা কটাক্ষ-কটুকথা তা যদি আপনার কাজে কোনো প্রভাব বিস্তার না করে, তাহলে আপনি মানসিকভাবে ফিট। দ্বিতীয়ত, যে-কোনো পরিস্থিতিতে আপনি ঠা-া মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কিনা। প্রতিকূল সময়ে উত্তেজিত হয়ে রি-অ্যাক্ট করে ফেলেন নাকি সহজভাবে পরিস্থিতি সামলে নিতে পারেন? বিরক্তিকে জয় করে করণীয় কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারাই মূলত মানসিক ফিটনেস। জীবনকে গভীরভাবে দেখতে শিখুন। যা আছে তার জন্যে কৃতজ্ঞ হোন। ছোট ছোট বিষয় থেকে আনন্দ খুঁজে নিন। এই কৃতজ্ঞ ও পরিতৃপ্ত হৃদয়ই হবে ভবিষ্যৎ অর্জনের পথে সবচেয়ে বড় শক্তি। সামাজিক ফিটনেস সোশ্যাল নিউরো সায়েন্সের প্রবক্তা ড. জন টি ক্যাসিওপ্পো।

তিনি বলেন, দেহের পেশিগুলোর মতো প্রতিটি মানুষের অদৃশ্য একটি পেশি আছে। তা হলো ‘সোশ্যাল মাসল’। এই মাসল আমরা যত কাজে লাগাব, আমাদের সুখের পরিমাণ তত বাড়বে। শুধু একতরফাভাবে নেয়ার মাঝে কারো বিকাশ ঘটে না। মানুষ সবচেয়ে সুন্দরভাবে বিকশিত হয় যখন একইসাথে ভালবাসা ও মমতা দেয় এবং নেয়। একাকিত্ব মানে শুধু পাওয়ার পথ বন্ধ হওয়া নয়, একাকী জীবনের অর্থ হলো অন্যকে দেয়ার পথও রুদ্ধ হয়ে যাওয়া। আর এই বিচ্ছিন্নতা আমাদের সুখ ও সামগ্রিক ভালো থাকাকে ব্যাহত করে।

মানুষ আপনাকে দেখলে কতটা তটস্থ থাকে, সালাম দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ায় এটা আপনার সোশ্যাল ফিটনেস নয়। তারা আপনাকে কতটা আপন মনে করে, আপনার উপস্থিতি তাদের কতটা তৃপ্তি দেয় এটাই আপনার সোশ্যাল ফিটনেসের ব্যারোমিটার। আত্মিক ফিটনেস ‘একটি প্রদীপ যেমন আগুন ছাড়া প্রজ্বলিত হতে পারে না, তেমনি আত্মিক শূন্যতা নিয়ে কোনো মানুষ বাঁচতে পারে না’ কথাটি হাজার বছর আগে বলে গেছেন মহামতি বুদ্ধ।

পণ্য পদমর্যাদা প্রাচুর্য প্রতিটি প্রত্যাশা পূরণের পরও যে শূন্যতা আর হাহাকার, সেটি দূর করতেই প্রয়োজন আত্মিক উন্নয়ন। আত্মিক উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তিই হলো আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে সমাজকেন্দ্রিক হওয়া। শুধু নিজের জন্যে নয়, চারপাশে সবার জন্যে বাঁচা, সবার কথা ভাবা। একজন ধার্মিকের জীবন এবং ধর্ম সম্পর্ক উদাসী ব্যক্তির তুলনা হতে পারে দুটি গাছের সাথে। একটি গাছ শিকড়ের সাথে যুক্ত বলে তা সজীব, সতেজ ও অপার্থিব আনন্দের উৎস। অপরটি শিকড়বিচ্ছিন্ন বলে শুষ্ক, রুক্ষ ও বেদনার্ত। তাই আত্মিকভাবে ফিট হতে শাশ্বত ধর্মের সত্যিকার জ্ঞানে জ্ঞানী হোন এবং তা অনুসরণ করুন। যিনি সহজে অন্যকে ক্ষমা করতে পারেন, অন্যের ব্যাথায় সমব্যাথী, মানবতার কল্যাণে নিজের মেধাকে সেবায় রূপান্তরিত করেন, তিনিই আত্মিকভাবে ফিট। ধ্যান করুন। অটুট রাখুন ভাবনার শক্তিকে। অর্জন করুন টোটাল ফিটনেস।

লেখক- অধ্যক্ষ, গোদাগাড়ী সরকারি কলেজ, রাজশাহী।